ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে কঠোর অবস্থানে সরকার

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ০০:৪৬, ১২ জুন ২০২৫

পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে কঠোর অবস্থানে সরকার

পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে কঠোর অবস্থানে সরকার 

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই সেই অর্থ বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। পাচারকৃত এই অর্থের পরিমাণ ১৮-২০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৮০০ কোটি থেকে ২ হাজার কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যা ২ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। পাচার হওয়া এই অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ লক্ষ্যে আমলতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে আনতে এ সম্পর্কিত আইন পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

যেসব দেশে টাকা পাচার হয়েছে সেসব দেশের সরকার প্রধানের কাছে পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে সহযোগিতা চাওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠান শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, পাচারের অর্থ ফেরত আনতে হবে, এ ধরনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য নতুন। আমরা কেউ এ ধরনের কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। পাচারের অর্থ ফেরত আনার কাজ গতিশীল করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। সেজন্য আইনে পরিবর্তন আনা হবে। ১১টি গ্রুপ নিয়ে যৌথ তদন্ত চলছে। তিনি বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য, পাচারকারীদের ওপর চাপ তৈরি করা, যাতে আদালতের বাইরে গিয়ে অর্থ উদ্ধার করা যায়। কাউকে জেলে নিয়ে হয়রানি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কারও ব্যবসা বন্ধ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা কারও ব্যবসা বন্ধ করিনি। যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়েছে, অন্য কারণে তা হয়েছে। 
এদিকে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মোট ১৭ হাজার ৩৪৫টি সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রতিবেদন (এসটিআর/এসএআর) দাখিল হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় যা প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি। এতে বোঝা যায়, অর্থ পাচার প্রতিরোধ কার্যক্রমে প্রতিবেদন প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সচেতনতা ও দক্ষতা বেড়েছে। এছাড়া বিএফআইইউ গত অর্থবছরে ১১৪টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে। আইন প্রয়োগকারী, নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ মোট ১ হাজার ২২০টি তথ্য বিনিময়ও হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় যা ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি।
যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে তিন সংস্থার চিঠি ॥ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যেসব দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে এর মধ্যে যুক্তরাজ্য অন্যতম। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমান যুক্তরাজ্য সফরে রয়েছেন। তার এই সফরে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যুক্তরাজ্য সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হবে। এছাড়া যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ জব্দ করে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী তিন সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), স্পটলাইট অন করাপশন ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকে। সংস্থাগুলো ব্রিটিশ সরকারের প্রতি এই আহ্বান জানায়। বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার শান্তি পুনরুদ্ধার ও জবাবদিহি নিশ্চিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্যদিকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব ‘অর্থ পাচারের স্বর্ণযুগ শেষ হয়েছে’ বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন।
এদিকে, বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে পাচার হওয়া অবৈধ অর্থ জব্দ করে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানায় সংস্থা তিনটি। টিআইবি সম্প্রতি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তিন সংস্থা যুক্তরাজ্য সরকারকে সে দেশে অবস্থানরত সন্দেহভাজন অর্থ পাচারকারী বাংলাদেশি অলিগার্ক, যাদের দুর্নীতি ও চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারে দেশটির আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টা জোরদার করতে বলেছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও জবাবদিহিমূলক সুশাসনের পথে অগ্রযাত্রার অভূতপূর্ব সম্ভাবনার বর্তমান সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্য সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের চলমান উদ্যোগ, বিশেষ করে দুর্নীতির কার্যকর নিয়ন্ত্রণের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে পাচার হওয়া সম্পদ বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিতে যুক্তরাজ্যকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এর মাধ্যমে এমন জোরালো বার্তা দিতে হবে যে চূড়ান্ত বিবেচনায় অর্থ পাচারকারীদের শুধু উৎস হিসেবে বাংলাদেশই নয়, গন্তব্য যুক্তরাজ্যেও কার্যকরভাবে জবাবদিহি করতে হয়।
স্পটলাইট অন করাপশনের নির্বাহী পরিচালক সুসান হাওলি বলেন, সময় নষ্ট না করে তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাজ্য সরকারের উচিত বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ জব্দে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একইসঙ্গে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও অর্থ পুনরুদ্ধারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। উল্লেখ্য, দ্য অবজারভার ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকের তদন্তে যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের মালিকানাধীন কমপক্ষে ৪০ কোটি পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) ইতোমধ্যে ৯০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদ জব্দ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দুর্নীতি নির্মূল ও শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে পাচার হওয়া কোটি কোটি পাউন্ড পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এদিকে, বিএফআইইউর প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম বলেন, অর্থ পাচার ও হু-ি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও লেনদেন ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই প্রবণতা। অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে কাজ চলছে। ১১টি গ্রুপ নিয়ে যৌথ তদন্ত চলছে। এ কাজে পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের এসটিএআর, যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডোজ, আইএসিসিসি ও আইসিএআরের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এমনকি বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে অর্থ পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। তবে প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল হওয়ায় সময় লাগবে।

×