ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সূর্যমুখী চাষে নতুন সম্ভাবনা 

এসএম মুকুল

প্রকাশিত: ০১:০৫, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

সূর্যমুখী চাষে নতুন সম্ভাবনা 

.

প্রথমবারের মতো সুনামগঞ্জের হাওড় অঞ্চলের উঁচু জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ শুরু হয়েছে। সূর্যমুখী ফুলের বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার ও বীজ প্রণোদনার মাধ্যমে জেলার ৮ উপজেলায় এ বছর ২৭ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, হাওড়াঞ্চলে ধান চাষ খুব একটা লাভজনক নয়। ধান চাষ করতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, সেই টাকার ধান পাওয়া যায় না। তাই অন্যান্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখী চাষে বেশি লাভের  প্রত্যাশা করছেন তারা।
সূর্যমুখী ফুলের চাষ করলে ফুল থেকে তেল, খৈল ও জ্বালানি পাওয়া যায়। প্রতিকেজি বীজ থেকে কমপক্ষে আধা লিটার তৈল উপাদন সম্ভব। প্রতিকেয়ারে ৭ মণ থেকে ১০ মণ বীজ উৎপাদন হয়। তেল উপাদন হবে প্রতিকেয়ারে ১৪০ লিটার থেকে ২০০ লিটার পর্যন্ত। প্রতিলিটার তেলের সর্বনিম্ন বাজার মূল্য ২৫০ টাকা। প্রতিকেয়ার জমিতে খরচ হয় সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ হাজার টাকা। সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলায় ১০ বিঘা জমিতে সূর্যমুখী চাষ হয়েছে। উপজেলার সুরমা, জাহাঙ্গীরনগর,  রঙ্গারচর, মোল্লাপাড়া ও গৌরারং ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে এই সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন কৃষকরা। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নে ও সলুকাবাদ ইউনিয়নে ২০ বিঘা জমিতে সূর্যমুখী চাষ হয়েছে। জামালগঞ্জ উপজেলার রামপুর, শাহপুর, বাহাদুরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ২০ বিঘা জমিতে এবার সূর্যমুখী ফুলের চাষ হয়েছে। 
নতুন জাতের সূর্যমুখী চাষে বিজ্ঞানীদের সফলতা
খাটো নতুন জাতের বারি-৩ সূর্যমুখী ফুল চাষ করে কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন যশোর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। মানবদেহের জন্য উপকারী লিনোলিক এসিড সমৃদ্ধ, হƒদরোগ ও ক্যানসার প্রতিষেধক, নারীদের বন্ধ্যত্ব দূরীকরণ ছাড়াও ত্বকের সৌন্দর্যের জন্য অধিক উপকারী বারি সূর্যমুখী-৩। এ জাতটি সংগ্রহ করতে কৃষকরা এখন ভিড় জমাচ্ছেন যশোর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রটিতে। উন্নতমানের শতভাগ নিরাপদ সূর্যমুখীর এ জাতটি আগামী বছরে কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের তৈলবীজ কেন্দ্র থেকে ২০১৯ সালের প্রথম দিকে উন্নত জাতের বারি-৩ নামের এ সূর্যমুখী ফুলের জাতটি অবমুক্ত করা হয়। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা তাদের তত্ত্বাবধানে জাতটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় যশোর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে বারি-৩ সূর্যমুখী ফুলের ট্রায়াল শুরু হয়। গত এক বছর ধরে জাতটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে ব্যাপক সফল হয়েছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের মতে, খাটো জাতের এ  রোগ প্রতিষেধক গুণসম্পন্ন সূর্যমুখীর জাতটি কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পারলে দেশে  স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ ভোজ্যতেল উৎপাদনে ব্যাপক সহায়ক হবে। 
বাজার তালিকায় ঢুকছে সূর্যমুখী তেল
বাংলাদেশে রান্নায় কমবেশি ছয় ধরনের ভোজ্যতেল ব্যবহৃত হয়। চার দশক আগেও সরিষা ছিল প্রধান ভোজ্যতেল। নব্বই দশক থেকে পাল্টে যেতে থাকে তেলের ব্যবহার। ধীরে ধীরে প্রধান ভোজ্যতেল হিসেবে জায়গা করে নেয় সয়াবিন ও পামতেল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বা ৫২ শতাংশ চলে পামতেল। বাজারে ৩৮ শতাংশ অংশীদারিত্ব নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সয়াবিন তেল। সরিষার তেল ও ধানের কুঁড়ার তেল মিলে ৯ শতাংশ বাজার দখল করে নিয়েছে। পঞ্চম অবস্থানে আছে সূর্যমুখী  তেল। এই তেলের অংশীদারিত্ব দশমিক ২ শতাংশ। ভোজ্যতেলের বাজারে সূর্যমুখী তেলের অংশীদারিত্ব খুবই সামান্য। সয়াবিনের চেয়ে দাম দ্বিগুণের কমবেশি হলেও এই তেলের চাহিদা বাড়ছে সবচেয়ে বেশি হারে। গত পাঁচ বছরের আমদানির তথ্য অনুযায়ী, বছরে গড়ে ৩৭ শতাংশ হারে বাড়ছে সূর্যমুখী তেল আমদানি। যেখানে একই সময়ে সয়াবিন ও পামতেলের চাহিদা বাড়ার হার সাড়ে ৭ শতাংশের মতো। সুস্থ থাকার জন্য মানুষের খাদ্যাভ্যাসে যে পরিবর্তন ঘটছে, তারই প্রভাব পড়েছে ভোজ্যতেলের বাজারেও। এক দশক আগেও সূর্যমুখী তেলের বোতল দেখা যেত সুপার শপ আর অভিজাত দোকানের তাকে। শহরের অভিজাত শ্রেণি ছিল এই তেলের মূল গ্রাহক। এখন শহরে বাড়ির পাশের দোকানের তাকেও ঠাঁই পাচ্ছে এই তেল।  স্বাস্থ্যসচেতনতার কারণে অভিজাত শ্রেণির পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও নিয়মিত বা মাঝেমধ্যে রান্নার তালিকায় রাখছেন এই তেল। প্রচলিত তেলের চেয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় পুষ্টিবিদদের এমন পরামর্শেও রান্নার তেল হিসেবে তা জায়গা করে নিচ্ছে। নতুন নতুন গ্রাহক যুক্ত হয়ে বেড়ে যাচ্ছে এই তেলের চাহিদা। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, বাজারে বোতলজাত সূর্যমুখী তেল আসছে আটটি দেশ থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হচ্ছে ইতালি, মালয়েশিয়া, ইউক্রেন, তুরস্ক, স্পেন, গ্রিস, সাইপ্রাস ও রাশিয়া থেকে। গত অর্থবছর বন্দর দিয়ে সূর্যমুখী তেল আমদানি হয় ৫৪ লাখ কেজি বা ৫৯ লাখ লিটার। পাঁচ বছর আগে আমদানি হয় প্রায় ১৯ লাখ কেজি বা ২১ লাখ লিটার। এ হিসাবে প্রায় ৪৬ কোটি থেকে বাজার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩০ কোটিতে।  যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য, গত মৌসুমে বিশ্বে ২০ কোটি টন ভোজ্যতেল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে সূর্যমুখী তেলের পরিমাণ ১ কোটি ৯৭ লাখ টন। এর অর্ধেকের বেশি উৎপাদিত হয় ইউক্রেন ও রাশিয়ায়।

×