ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

পদ্মা সেতু চালুর পর ব্যবহারকারীদের আগ্রহ বেড়েছে

মোংলা বন্দরের চলমান উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান

আহসান হাবিব হাসান, মোংলা

প্রকাশিত: ০১:১৩, ৮ ডিসেম্বর ২০২৩

মোংলা বন্দরের চলমান উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান

মোংলা বন্দরের চলমান উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান

সেতু চালুর পর ঝিমিয়ে থাকা বন্দরটিতে প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে। রাজধানী থেকে সবচেয়ে কাছের সমুদ্রবন্দর মোংলা।
দূরত্ব মাত্র ১৭০ কিলোমিটার। ফলে পদ্মা সেতু চালুর পর মোংলা বন্দর ব্যবহারে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বাড়ছে। মোংলা-খুলনা রেললাইন উদ্বোধন হয়েছে। 
মোংলা বন্দরে গত ১০ বছরে বছরওয়ারি জাহাজ আসার সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। দেশের অর্ধেকের বেশি আমদানি করা গাড়ি এখন মোংলা বন্দর দিয়ে আসে। বেশির ভাগ এলপিজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি হয় মোংলা বন্দর দিয়ে।
 মোংলা বন্দরের এখন যত জাহাজ ভিড়ে, তার এক-তৃতীয়াংশই এলপিজির জাহাজ। পদ্মা সেতুর কল্যাণে সর্বশেষ এ বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহনে নতুন করে যুক্ত হয়েছে পোশাক। পদ্মা সেতু চালুর এক বছরেই এই বন্দর দিয়ে পোশাক রপ্তানি তিন গুণ বেড়েছে।
১৯৫০ সালে চালনা বন্দর নামে প্রথম বন্দরটির গোড়াপত্তন হয়। ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর পশুর নদের জয়মণির ঘোল এলাকায় দ্য সিটি অব লিয়নস নামে জাহাজ নোঙরের মাধ্যমে বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ১৯৫১ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত চালনায় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ১৯৫৪ সালে খুলনা শহর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে পশুর নদের পূর্ব তীরে মোংলা চ্যানেল বন্দরটির কার্যক্রম স্থানান্তর হয়। মোংলার সম্ভাবনা নিয়ে বন্দরের সদস্য (হারবার ও মেরিন) ক্যাপ্টেন মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আগামী বছরের জুনের পর পশুর নদের ইনার বারে ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হলে এই বন্দরে বেশি গভীরতার (ড্রাফটের) জাহাজ ভিড়তে পারবে।

তখন মোংলা বন্দর ব্যবহারে আরও আগ্রহী হবেন ব্যবসায়ী, তথা ব্যবহারকারীরা। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথাটি মাথায় রেখে আমরা নানা ধরনের হ্যান্ডেলিং যন্ত্রপাতি কিনে প্রস্তুত হচ্ছি। মোংলা-খুলনা রেললাইন চালু হলে (রেললাইন উদ্বোধন হয়েছে তবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি) দেশের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ভারত, নেপাল ও ভুটানের ব্যবসায়ীরাও এ বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হবেন।’
সম্প্রতি বন্দর এলাকা সরেজমিনে দেখা যায়, একদিকে চলছে গাড়ি খালাসের কাজ। অন্যদিকে আধুনিক ক্রেন দিয়ে ইয়ার্ডে কনটেনার পরিবহন করা হচ্ছে। বন্দরজুড়েই কর্মচাঞ্চল্য আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আমদানিকারকের প্রতিনিধিদের আনাগোনায় সরব এখন বন্দর এলাকা।
১০ বছর আগে, ২০১৩ সালে এই প্রতিবেদক যখন মোংলা বন্দর এলাকায় সরেজমিনে গিয়েছিলেন, তখন বন্দরের জেটি এলাকাটি ছিল অনেকটাই নীরব। যখন জাহাজ আসত, ওই কয়েক দিন শুধু কর্মচাঞ্চল্য। এখন নতুন শেড হয়েছে। পণ্য খালাসে যুক্ত হয়েছে সাতটি আধুনিক মোবাইল হারবার ক্রেন।
মোংলা বন্দরের সমস্যা হলো, এখনো বন্দর থেকে খুলনা শহর পর্যন্ত যোগাযোগের প্রধান সড়কটি সরু। তাতে পণ্যবাহী যানবাহন পরিবহনে কিছুটা সমস্যা হয়। আবার বন্দর এলাকায় আবাসন সুবিধা না থাকায় বন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বেশির ভাগকে খুলনা বা বাগেরহাট থেকে গিয়ে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। পণ্য খালাসেও দীর্ঘসূত্রতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অভিযোগ আছে বন্দর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
গত ৯ বছরের ব্যবধানে মোংলা বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন বেড়ে আড়াই গুণ হয়েছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে মোংলার হিস্যাও বাড়ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সমুদ্রপথে মোট ৫ কোটি ২৫ লাখ টন পণ্য পরিবহন হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবহন হয় ৯২ শতাংশ বা ৪ কোটি ৮১ লাখ টন পণ্য। আর মোংলা বন্দর দিয়ে পরিবহন হয় ৪৪ লাখ টন বা ৮ শতাংশ। সেখানে সদ্যবিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোংলা বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন হয় ১ কোটি ১২ লাখ টন, যা সমুদ্রপথে দেশের মোট পণ্য পরিবহনের ১০ শতাংশ।

একই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবহন হয় ১০ কোটি টন পণ্য, যা সমুদ্রপথে মোট পণ্য পরিবহনের ৮৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত মোংলা দিয়ে মূলত গাড়িই বেশি আসে। ১৫ বছর আগে; অর্থাৎ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ২৫৫টি গাড়ি নিয়ে প্রথম একটি জাহাজ ভিড়ে এ বন্দরে। গাড়ি আমদানির সেই শুরু, আর থামেনি। মোংলা বন্দরের প্রাক্কলন হলো, ২০২৫ সাল নাগাদ এই বন্দর দিয়ে বছরে ৩০ হাজার গাড়ি আমদানি হবে। গাড়ি ছাড়া মোংলা বন্দর দিয়ে সরকারের কেনা সার ও গম, সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল, এলপিজি, কয়লা ইত্যাদি পণ্যই বেশি আমদানি হয়।
এক বছরে পোশাক রপ্তানি বেড়ে তিন গুণ, পোশাক রপ্তানিকারকেরা আগে খুব বেশি মোংলা বন্দর ব্যবহার করতেন না। কিন্তু পদ্মা সেতুর জন্য পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে। পদ্মা সেতু চালুর পর রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশের পোশাক কারখানার মালিকেরা পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে এ বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাতে পদ্মা সেতু চালুর পর এক বছরে এ বন্দর দিয়ে পোশাক রপ্তানি তিন গুণ বেড়েছে। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোংলা বন্দর দিয়ে ৩৯৮ টন পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এর আগের বছর যার পরিমাণ ছিল মাত্র ১৩৭ টন। মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী মো. আহসান হাবিব হাসান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। তাই বিকল্প হিসেবে মোংলাকে ব্যবহার করা যেতে পারে।

এ ছাড়া দক্ষিণবঙ্গে যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে, সেখান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহন করা হবে সময়সাপেক্ষ। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় রাজধানী ও তার আশপাশের ব্যবসায়ীরা সহজেই মোংলা ব্যবহার করতে পারছেন। হাসান মনে করেন, মোংলা বন্দরের সঙ্গে রেলসংযোগ চালু হলে ভারত, নেপাল ও ভুটানও বন্দরটি ব্যবহারে আগ্রহী হবে।
এখন পর্যন্ত মোংলা বন্দরের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, পলি জমার কারণে এ বন্দরে বেশি গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারে না। জাহাজের গভীরতার হিসাব করা হয়, জাহাজের যেটুকু অংশ পানির নিচে থাকে, সেটির হিসাবে। ১০ মিটার পর্যন্ত ড্রাফটের জাহাজ যেন মোংলা বন্দরে ভিড়তে পারে, সে জন্য ৭৯৩ কোটি টাকার ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
 মোংলা বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হবে। তখন স্বাভাবিক সময়ে সাড়ে আট মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দর জেটিতে ভিড়তে পারবে। আর জোয়ারের সময় পানি আরও দুই মিটার পানি বাড়লে সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজও ভিড়তে পারবে।

×