
ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ ভারতের মহীশূর রাজ্যের মুসলিম শাসক টিপু সুলতান ছিলেন তার পিতা হায়দার আলীর যোগ্য উত্তরসূরি। হায়দার আলী সেনাপতি থেকে শাসকের পদে আরোহণ করেন এবং তার নেতৃত্বেই মহীশূর রাজ্যের ভিত্তি মজবুত হয়।
টিপু সুলতান দাক্ষিণাত্যের মহীশূরে শ্রীরঙ্গপত্তনম দুর্গ (বর্তমানে শ্রীরঙ্গপত্তনম গ্রাম দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের মান্ডিয়া জেলার অন্তর্গত) থেকে তার রাজ্য পরিচালনা করতেন। ফরাসি কিংবদন্তি সেনানায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন।
টিপু সুলতান বাঘের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। তার শাসন দক্ষতা, কৌশল এবং অসীম সাহসিকতার জন্য স্বয়ং ইংরেজরাই তাকে 'মহীশূরের বাঘ' বা 'শের-ই-মহীশূর' নামে অভিহিত করে। তার রাজ্যের প্রতীক ছিল বাঘ এবং তার রাজ্যের পতাকায় কন্নড়ি ভাষায় লেখা ছিল 'বাঘই ঈশ্বর'।
বাবার তৈরি সিংহাসন বদলে তিনি নিজের জন্য 'ব্যাঘ্রাসন' নামে নতুন একটি সিংহাসন নির্মাণ করান, যা সম্পূর্ণ সোনার পাতে মোড়া এবং বাঘের আকৃতির ছিল। এমনকি তার ব্যবহৃত তলোয়ার, সৈন্যদের পোশাক এবং রাজ্যের প্রধান প্রধান সড়কের বাড়িগুলোর দেয়ালেও বাঘের ছবি আঁকানো ছিল বাধ্যতামূলক।
ইংরেজদের সঙ্গে টিপু সুলতানের বহু যুদ্ধ হয়। ১৭৮১ সালে দ্বিতীয় মহীশূর যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি হেক্টর মুনরোর বাহিনীর কাছে পরাজিত হন টিপু ও তার পিতা। এই পরাজয়ে টিপুর ক্ষোভ তীব্রতর হয়। হেক্টর মুনরোর পুত্র সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে নিহত হলে টিপু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে 'টিপু'স টাইগার' নামে একটি বিশেষ খেলনা তৈরি করেন। ফরাসি কারিগরদের নির্মিত এই খেলনায় দেখা যায়, একটি বাঘ এক ইংরেজকে আক্রমণ করছে এবং ক্লকওয়ার্ক সিস্টেমে তৈরি শব্দে শোনা যায় বাঘের গর্জন ও ইংরেজের আর্তনাদ। এটি তার ইংরেজ বিরোধিতা এবং বাঘের প্রতি গভীর ভালবাসার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
১৭৯৯ সালে চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে টিপু সুলতান ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হন। টিপুর মৃত্যুর পর তার পরিবারের সদস্যদের বন্দি করে ভেলোর দুর্গে রাখা হয়। সেখানে ১৮০৬ সালে এক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, যা শতাধিক ইংরেজ সেনার মৃত্যু ঘটায়। বিদ্রোহ দমনের পর ব্রিটিশরা টিপুর পরিবারের অনেক সদস্যকে হত্যা করে এবং বাকি সদস্যদের কলকাতায় নির্বাসনে পাঠায়।
খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ইউরোপীয়রা যখন ভারতবর্ষে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, তখন এই দেশটি মুসলিম শাসকদের শাসনে ছিল। সেই সময়ে স্থানীয় হিন্দু বিত্তশালীরা নিজেদের স্বার্থে এসব বিদেশি শাসকদের দাসত্ব করতেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিযুক্ত সেনাপতি ও গভর্নর লর্ড কর্ণওয়ালিশ টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে যখন কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন, তখন শহরের গণ্যমান্য হিন্দু বাঙালীরা তাকে ফার্সি ভাষায় একটি অভিনন্দনপত্র প্রদান করেন।
হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের "কলিকাতা- সেকালের ও একালের" গ্রন্থের ৬৯৬ নম্বর পৃষ্ঠায় অভিনন্দনপত্রটির উল্লেখ পাওয়া যায়। অভিনন্দনপত্রে লর্ড কর্ণওয়ালিশের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও প্রশংসা যা বলা হয়, গ্রন্থটির লেখক তার বঙ্গানুবাদ করেছিলেন এভাবে:
"অসীম সম্মানাস্পদ, অমিত বীরচূড়ামণি, শ্রীল শ্রীযুক্ত আরল্ কর্ণওয়ালিস কে, জি, গভর্ণর জেনারেল বাহাদুর বরাবরেষু-
টিপু সুলতানের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপনি তাঁহার সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হন। আমাদের স্থির বিশ্বাস ছিল, ভগবান আপনাকে জয়যুক্ত করিবেন। যাহাতে আপনি রণজয়ী হইয়া বিজয়-গৌরব লাভ করেন, তজ্জন্য আমরা ভগবৎসমীপে চিরদিন প্রার্থনা করিয়া আসিয়াছি।
আপনি মহাবল-চমু লইয়া শত্রুর রাজ্য আক্রমণ করেন। অসীম সাহসে শত্রুবিজয় করিয়া আপনি এখন যশস্বী। যেমন অগ্নিসংযোগে, তৃণের সম্পূর্ণ ধ্বংশসাধন হয়, আপনার অমিতবিক্রমে শত্রুসৈন্য সেইরূপ ধ্বংস হইয়াছে। ইহাতে আপনি যশোগৌরবে অমরত্বলাভ করিয়াছেন এবং এই বিজয়-ব্যপারে আপনার প্রজাগণের সম্পত্তি, সম্মান ও স্বাধীনতা রক্ষা করিয়াছেন।"
ইতিহাসের পাতা থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলেও টিপু সুলতান তার অসাধারণ বীরত্ব, দেশপ্রেম এবং আত্মমর্যাদার জন্য আজও স্মরণীয়। তার সেই বিখ্যাত উক্তি, 'ভেড়া বা শিয়ালের মত দু'শ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মত দু'দিন বেঁচে থাকাও উত্তম", তার জীবন দর্শনের প্রতীক হিসেবে আজও মানুষের হৃদয়ে অনুরণিত হয়। পাশাপাশি সেকালের ভারতবর্ষে ইংরেজদের দাসত্বকারী কতিপয় বাঙালির লজ্জাজনক ইতিহাসও মানুষের মনে ঘৃণার উদ্রেক ঘটায়।
এম.কে.