ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১

৭২ প্রজাতির দেশী মাছ বিলুপ্ত প্রাকৃতিক জালাধার চলনবিল

বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ৯ আগস্ট ২০২৪

৭২ প্রজাতির দেশী মাছ বিলুপ্ত  প্রাকৃতিক জালাধার চলনবিল

.

দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাধার চলনবিলসিরাজগঞ্জ পাবনা ও নাটোর জেলার সাত উপজেলা নিয়ে এ বিলের বিস্তৃতিবর্ষায় এই বিল পানিতে ভরে ওঠেযতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানিবর্ষা মৌসুমে এই চলনবিলকে কেন্দ্র করে মস্যজীবীরা জীবন-জীবিকায় নির্বাহ করে।  চলনবিল অধ্যুষিত এই সাত উপজেলার মানুষের মূল পেশা বিলকেন্দ্রিক কৃষিকাজ ও মাছ ধরাপাওয়া যায় প্রচুর মাছবিশেষত বর্ষাকালে যখন বাড়তি পানিতে চলনবিল কানায় কানায় ভরে ওঠে, তখন সবচেয়ে বেশি মাছ পাওয়া যায়এ কারণে উত্তরবঙ্গে মাছের অন্যতম প্রাকৃতিক ভা-ার হিসেবে বিবেচনা করা হয় চলনবিলকে

তবে চলনবিলের দেশী জাতের মাছ উপাদন ক্রমেই কমছেএর অন্যতম কারণ খাল, বিল, মজা পুকুর ও শাখা নদীগুলো দখল করে ভরাট করাএতে মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছেএকই সঙ্গে ফসলের খেতে অবাধে কীটনাশক ও রাসায়নিক প্রয়োগ করায় বর্ষায় তা চলনবিলের পানিতে পড়ছেফলে মিঠা পানির দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে গেছেঅন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে প্রজননেহারিয়ে যাচ্ছে এসব মাছইতোমধ্যেই প্রায় ৭২ প্রজাতির প্রাকৃতিক প্রজননের মাছ বিলুপ্ত  হয়ে গেছে

তবে মাছের এ প্রাকৃতিক ভা-ার এখন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেচলনবিলে ক্রমান্বয়ে কমে আসছে দেশী মাছের পরিমাণবাড়ছে চাষযোগ্য মাছ উপাদনচলনবিলে মাছ উপাদন প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভ্রর করেবর্ষায় পানি বাড়লে মাছের প্রজননের জন্য উত্তম পরিবেশ তৈরি হয়এতে একদিকে যেমন মাছের সংখ্যা বাড়ে, তেমনি জেলেরাও বাড়তি মাছ পানতবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চলনবিল থেকে মিঠা পানির দেশী মাছপ্রাপ্তি আশঙ্কাজনক হারে কমছে২০১৩ সালে এ বিল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ২০ হাজার টন দেশী মাছ পাওয়া গিয়েছিল২০১৪-১৭ সালে এ বিল থেকে দেশী জাতের মাছপ্রাপ্তির সর্বোচ্চ পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার টনআর গত বছর এর পরিমাণ ১০ হাজার টনে নেমে এসেছে

মানুষ স্বাদের কারণে পুঁটি, খোলসে, মলা, ঢেলা, কই, বোয়াল, মৃগেলসহ বিভিন্ন ধরনের মিঠা পানির দেশী জাতের মাছ খেতে পছন্দ করেবাজারে এসব মাছের চাহিদাও রয়েছেএর পরও প্রাকৃতিক উপায়ে বেড়ে ওঠা দেশী জাতের মাছ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে নাচলনবিল অঞ্চলে এসব মাছের উপাদন ক্রমান্বয়ে কমে আসছে

চলনবিলে দেশী জাতের মাছ উপাদন কমার পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেন তিনিমাহবুবুর রহমানের মতে, দেশী জাতের মাছ উপাদন কমার পেছনে মূল কারণ মানুষের অসচেতনতাদেশীয় মাছের আবাস হিসেবে চিহ্নিত খাল, বিল, মজা পুকুর ও শাখা নদীগুলো দখল করে ভরাট করার কারণে এসব মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছেএকই সঙ্গে ফসলের খেতে অবাধে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করায় বৃষ্টিতে সেটা ধুয়ে চলনবিলের পানিতে পড়ছেফলে মিঠা পানির দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে আসছেঅন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে তাদের প্রজননেহারিয়ে যাচ্ছে এসব মাছ

চলনবিল অঞ্চলের গাজনার বিল এলাকার মস্যজীবী অর্জুন হালদার জানান, সত্তরের দশকে চলনবিল ও গাজনার বিলে প্রচুর পরিমাণ মাছ পাওয়া যেতসারা রাত জেলেরা বিলে মাছ ধরতেনসকালে এসব মাছ ট্রেনে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হতো

বর্তমানে দেশী জাতের অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছেদেশী জাতের মাছের বিকল্প হিসেবে সামনে এসেছে বিদেশী ও চাষের মাছএসব মাছের খাবার হিসেবে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক অনেক উপাদান ব্যবহার হচ্ছেসামনের দিনগুলোয় এটা বড় বিপদের কারণ হতে পারে

স্যজীবীরা জানান রাসায়নিক উপাদানযুক্ত বদ্ধ পানিতে চাষকৃত মাছকে যদি প্রাকৃতিক খাবারের পরিবর্তে বাজারের প্রচলিত রাসায়নিক মিশ্রিত খাবার খাওয়ানো হয়, তখন ওই খাবারের রাসায়নিক উপাদান মাছের দেহে রয়ে যায়এতে মাছের পুষ্টিগুণে তারতম্য দেখা যাবেস্বাদ কমে যাবেএ কারণেই মিঠা পানির মাছ ও চাষের মাছের স্বাদ ভিন্ন হয়চলনবিলের মাছের ক্ষেত্রেও এ সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে

তাড়াশ এলাকার আব্দুর রহিম ও আখলেছুর রহমান কয়েক প্রজন্ম ধরে চলনবিলে মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেনতারা জানালেন, চলনবিল এলাকায় মিঠা পানির দেশীয় মাছের চাহিদা দেশেই শুধু নয়, বিদেশেও রয়েছেএ অঞ্চলের মাছ শুঁটকি করে বিদেশে পাঠানো হয়এ কারণে চলনবিল অঞ্চলে শুঁটকি ব্যবসাও জমে উঠেছে

ঢাকা থেকে পাইকাররা এসে এসব শুঁটকি কিনছেনপরবর্তী সময়ে তারাই এখানকার শুঁটকি রফতানি করবেন

মাহমুদ শুকুর বলেন, চলতি শতকের শুরুর দিকে চলনবিল অঞ্চলে প্রতি বছর ৫০-১০০ টন শুঁটকি উপাদন হতোবর্তমানে এর পরিমাণ বছরে প্রায় ৩০০ টন ছাড়িয়ে গেছেতবে দেশীয় জাতের মাছ উপাদন কমে যাওয়ায় চলনবিলকেন্দ্রিক শুঁটকি ব্যবসাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেইতোমধ্যেই প্রায় ৭২ প্রজাতির স্থানীয় মাছ বিলুপ্ত  হয়ে গেছেপ্রতি বছরই চলনবিল হতে প্রচুর পরিমাণ মাছ ধরা হয় এবং সেগুলো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়চলনবিলকে কেন্দ্র করে  বেশ কয়েকটি বড় বড়  মাছের আড়  গড়ে উঠেছে

যেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বিলের মাছ পাওয়া যায়এ গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আড়গুলো হলো সিংড়া ও চৌগ্রাম,আত্রাই মাছের বাজার, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুঠি, রামারচর মাছের আড়তাছাড়াও বিলের আশেপাশে অনেক ছোট বড় মাছের বাজার রয়েছে যেখানে চলনবিলের মাছ পাওয়া যায়প্রতি বছর চলনবিলের আশপাশে বিভিন্ন স্থানে বিল হতে ধৃত পুটি, চান্দা, কাকিলা, টাকি ও বোয়ালসহ বিভিন্ন  মাছের শুঁটকি করা হয়ে থাকেএসকল শুঁটকির প্রায় সবই বিক্রির জন্য  দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়আজ  চলনবিলে অবৈধ মাছ ধরার জাল  ব্যবহার করে ছোট-বড় মাছ ও মা মাছ  ধরার ফলে কমে আসছে মাছের প্রাচুর্যতা ও বৈচিত্রত্যচলনবিল ও গাজনার বিল মিঠা পানির দেশীয় মাছ আহরণের অন্যতম স্থানবর্ষা মৌসুমে নওগাঁর আত্রাই নদ এবং নাটোরের গুমানী ও বড়াল দিয়ে চলনবিলে পানি প্রবেশ করেযমুনা নদীর পানি বাড়লে তা চলনবিলের দিকে ধাবিত হয়নদী থেকে আসা এই পানির সঙ্গেই বিলে প্রবেশ করে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় জাতের মাছবিলের প্রাকৃতিক পরিবেশে বিকশিত এসব মাছ ধরার পর তাজা অবস্থায় কিংবা শুঁটকি করে বিক্রি করা হয়স্থানীয়দের জীবিকার বড় উসই চলনবিলে মাছ ধরাএখন চাষের মাছের বিকাশে তাদের জীবিকায় টান পড়েছেস্থানীয় শুঁটকি ব্যবসায়ীরাও কাঙ্ক্ষিত আয় করতে পারছেন না

বাঙালির পরিচিতিই ভাতে-মাছেবিশেষত প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হওয়া দেশী জাতের মাছগুলো মানুষের পছন্দের তালিকায় এগিয়ে রয়েছেএখন বিলুপ্তপ্রায় এসব জাত রক্ষা করার সময় এসেছেআর এজন্য প্রয়োজন মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা, দেশীয় প্রজাতির মিঠা পানির মাছের প্রজননের নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করা, মাছের প্রাকৃতিক খাবারপ্রাপ্তির পরিবেশ নিশ্চিত করাতবেই চলনবিলসহ দেশের সব প্রাকৃতিক জলাধারে মাছ উপাদন বাড়বেসমৃদ্ধ হয়ে উঠবে দেশের রফতানিমুখী মস্য খাত

 

×