.
দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাধার চলনবিল। সিরাজগঞ্জ পাবনা ও নাটোর জেলার সাত উপজেলা নিয়ে এ বিলের বিস্তৃতি। বর্ষায় এই বিল পানিতে ভরে ওঠে। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। বর্ষা মৌসুমে এই চলনবিলকে কেন্দ্র করে মৎস্যজীবীরা জীবন-জীবিকায় নির্বাহ করে। চলনবিল অধ্যুষিত এই সাত উপজেলার মানুষের মূল পেশা বিলকেন্দ্রিক কৃষিকাজ ও মাছ ধরা। পাওয়া যায় প্রচুর মাছ। বিশেষত বর্ষাকালে যখন বাড়তি পানিতে চলনবিল কানায় কানায় ভরে ওঠে, তখন সবচেয়ে বেশি মাছ পাওয়া যায়। এ কারণে উত্তরবঙ্গে মাছের অন্যতম প্রাকৃতিক ভা-ার হিসেবে বিবেচনা করা হয় চলনবিলকে।
তবে চলনবিলের দেশী জাতের মাছ উৎপাদন ক্রমেই কমছে। এর অন্যতম কারণ খাল, বিল, মজা পুকুর ও শাখা নদীগুলো দখল করে ভরাট করা। এতে মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। একই সঙ্গে ফসলের খেতে অবাধে কীটনাশক ও রাসায়নিক প্রয়োগ করায় বর্ষায় তা চলনবিলের পানিতে পড়ছে। ফলে মিঠা পানির দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে গেছে। অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে প্রজননে। হারিয়ে যাচ্ছে এসব মাছ। ইতোমধ্যেই প্রায় ৭২ প্রজাতির প্রাকৃতিক প্রজননের মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তবে মাছের এ প্রাকৃতিক ভা-ার এখন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। চলনবিলে ক্রমান্বয়ে কমে আসছে দেশী মাছের পরিমাণ। বাড়ছে চাষযোগ্য মাছ উৎপাদন। চলনবিলে মাছ উৎপাদন প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভ্রর করে। বর্ষায় পানি বাড়লে মাছের প্রজননের জন্য উত্তম পরিবেশ তৈরি হয়। এতে একদিকে যেমন মাছের সংখ্যা বাড়ে, তেমনি জেলেরাও বাড়তি মাছ পান। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চলনবিল থেকে মিঠা পানির দেশী মাছপ্রাপ্তি আশঙ্কাজনক হারে কমছে। ২০১৩ সালে এ বিল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ২০ হাজার টন দেশী মাছ পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৪-১৭ সালে এ বিল থেকে দেশী জাতের মাছপ্রাপ্তির সর্বোচ্চ পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার টন। আর গত বছর এর পরিমাণ ১০ হাজার টনে নেমে এসেছে।
মানুষ স্বাদের কারণে পুঁটি, খোলসে, মলা, ঢেলা, কই, বোয়াল, মৃগেলসহ বিভিন্ন ধরনের মিঠা পানির দেশী জাতের মাছ খেতে পছন্দ করে। বাজারে এসব মাছের চাহিদাও রয়েছে। এর পরও প্রাকৃতিক উপায়ে বেড়ে ওঠা দেশী জাতের মাছ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। চলনবিল অঞ্চলে এসব মাছের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমে আসছে।
চলনবিলে দেশী জাতের মাছ উৎপাদন কমার পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেন তিনি। মাহবুবুর রহমানের মতে, দেশী জাতের মাছ উৎপাদন কমার পেছনে মূল কারণ মানুষের অসচেতনতা। দেশীয় মাছের আবাস হিসেবে চিহ্নিত খাল, বিল, মজা পুকুর ও শাখা নদীগুলো দখল করে ভরাট করার কারণে এসব মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। একই সঙ্গে ফসলের খেতে অবাধে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করায় বৃষ্টিতে সেটা ধুয়ে চলনবিলের পানিতে পড়ছে। ফলে মিঠা পানির দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে আসছে। অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে তাদের প্রজননে। হারিয়ে যাচ্ছে এসব মাছ।
চলনবিল অঞ্চলের গাজনার বিল এলাকার মৎস্যজীবী অর্জুন হালদার জানান, সত্তরের দশকে চলনবিল ও গাজনার বিলে প্রচুর পরিমাণ মাছ পাওয়া যেত। সারা রাত জেলেরা বিলে মাছ ধরতেন। সকালে এসব মাছ ট্রেনে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হতো।
বর্তমানে দেশী জাতের অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দেশী জাতের মাছের বিকল্প হিসেবে সামনে এসেছে বিদেশী ও চাষের মাছ। এসব মাছের খাবার হিসেবে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক অনেক উপাদান ব্যবহার হচ্ছে। সামনের দিনগুলোয় এটা বড় বিপদের কারণ হতে পারে।
মৎস্যজীবীরা জানান রাসায়নিক উপাদানযুক্ত বদ্ধ পানিতে চাষকৃত মাছকে যদি প্রাকৃতিক খাবারের পরিবর্তে বাজারের প্রচলিত রাসায়নিক মিশ্রিত খাবার খাওয়ানো হয়, তখন ওই খাবারের রাসায়নিক উপাদান মাছের দেহে রয়ে যায়। এতে মাছের পুষ্টিগুণে তারতম্য দেখা যাবে। স্বাদ কমে যাবে। এ কারণেই মিঠা পানির মাছ ও চাষের মাছের স্বাদ ভিন্ন হয়। চলনবিলের মাছের ক্ষেত্রেও এ সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
তাড়াশ এলাকার আব্দুর রহিম ও আখলেছুর রহমান কয়েক প্রজন্ম ধরে চলনবিলে মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তারা জানালেন, চলনবিল এলাকায় মিঠা পানির দেশীয় মাছের চাহিদা দেশেই শুধু নয়, বিদেশেও রয়েছে। এ অঞ্চলের মাছ শুঁটকি করে বিদেশে পাঠানো হয়। এ কারণে চলনবিল অঞ্চলে শুঁটকি ব্যবসাও জমে উঠেছে।
ঢাকা থেকে পাইকাররা এসে এসব শুঁটকি কিনছেন। পরবর্তী সময়ে তারাই এখানকার শুঁটকি রফতানি করবেন।
মাহমুদ শুকুর বলেন, চলতি শতকের শুরুর দিকে চলনবিল অঞ্চলে প্রতি বছর ৫০-১০০ টন শুঁটকি উৎপাদন হতো। বর্তমানে এর পরিমাণ বছরে প্রায় ৩০০ টন ছাড়িয়ে গেছে। তবে দেশীয় জাতের মাছ উৎপাদন কমে যাওয়ায় চলনবিলকেন্দ্রিক শুঁটকি ব্যবসাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ইতোমধ্যেই প্রায় ৭২ প্রজাতির স্থানীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রতি বছরই চলনবিল হতে প্রচুর পরিমাণ মাছ ধরা হয় এবং সেগুলো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়। চলনবিলকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি বড় বড় মাছের আড়ৎ গড়ে উঠেছে।
যেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বিলের মাছ পাওয়া যায়। এ গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আড়ৎগুলো হলো সিংড়া ও চৌগ্রাম,আত্রাই মাছের বাজার, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুঠি, রামারচর মাছের আড়ৎ। তাছাড়াও বিলের আশেপাশে অনেক ছোট বড় মাছের বাজার রয়েছে যেখানে চলনবিলের মাছ পাওয়া যায়। প্রতি বছর চলনবিলের আশপাশে বিভিন্ন স্থানে বিল হতে ধৃত পুটি, চান্দা, কাকিলা, টাকি ও বোয়ালসহ বিভিন্ন মাছের শুঁটকি করা হয়ে থাকে। এসকল শুঁটকির প্রায় সবই বিক্রির জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়। আজ চলনবিলে অবৈধ মাছ ধরার জাল ব্যবহার করে ছোট-বড় মাছ ও মা মাছ ধরার ফলে কমে আসছে মাছের প্রাচুর্যতা ও বৈচিত্রত্য। চলনবিল ও গাজনার বিল মিঠা পানির দেশীয় মাছ আহরণের অন্যতম স্থান। বর্ষা মৌসুমে নওগাঁর আত্রাই নদ এবং নাটোরের গুমানী ও বড়াল দিয়ে চলনবিলে পানি প্রবেশ করে। যমুনা নদীর পানি বাড়লে তা চলনবিলের দিকে ধাবিত হয়। নদী থেকে আসা এই পানির সঙ্গেই বিলে প্রবেশ করে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় জাতের মাছ। বিলের প্রাকৃতিক পরিবেশে বিকশিত এসব মাছ ধরার পর তাজা অবস্থায় কিংবা শুঁটকি করে বিক্রি করা হয়। স্থানীয়দের জীবিকার বড় উৎসই চলনবিলে মাছ ধরা। এখন চাষের মাছের বিকাশে তাদের জীবিকায় টান পড়েছে। স্থানীয় শুঁটকি ব্যবসায়ীরাও কাঙ্ক্ষিত আয় করতে পারছেন না।
বাঙালির পরিচিতিই ভাতে-মাছে। বিশেষত প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হওয়া দেশী জাতের মাছগুলো মানুষের পছন্দের তালিকায় এগিয়ে রয়েছে। এখন বিলুপ্তপ্রায় এসব জাত রক্ষা করার সময় এসেছে। আর এজন্য প্রয়োজন মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা, দেশীয় প্রজাতির মিঠা পানির মাছের প্রজননের নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করা, মাছের প্রাকৃতিক খাবারপ্রাপ্তির পরিবেশ নিশ্চিত করা।তবেই চলনবিলসহ দেশের সব প্রাকৃতিক জলাধারে মাছ উৎপাদন বাড়বে। সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে দেশের রফতানিমুখী মৎস্য খাত।