ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

আরাফাতের ময়দানে দিনভর এবাদতে মশগুল থাকবেন মুসল্লিরা

পবিত্র হজ আজ

আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ০০:০৯, ১৫ জুন ২০২৪

পবিত্র হজ  আজ

.

আজ পবিত্র হজ। লাখ লাখ মুসল্লি আজ মিনা থেকে আরাফাতের ময়দানে যাবেন। মিনায় ফজরের নামাজ আদায় করেইলাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েকধ্বনিতে মুসল্লিরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে নিজ নিজ খিমায় আশ্রয় নেবেন। এখানেই দিনভর এবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকবেন তাঁরা। মূলত আল্লাহর অশেষ রহমতের ময়দান আরাফাতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করার নামই হজ। এর আগে-পরে অন্য আনুষঙ্গিক কাজ করার মাধ্যমে হজের পরিপূর্ণতা দেওয়া হয়। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ। আর্থিকভাবে সক্ষম সব মুসলমানের জন্য জীবনে অন্তত একবার পালন করা ফরজ। শুক্রবার মিনার মাঠে দিনভর ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল ছিলেন সব মুসল্লি। তবে এবারই প্রথম গাজার কোনো মুসলিম হজে যেতে পারেননি।

এবারও তীব্র গরমের মধ্যেই বিশ্বের ২০ লাখেরও বেশি মুসলমান হজ পালন করছেন। বাংলাদেশ থেকে হজে গেছেন ৮২ হাজার ৭৭২ জন।

শুক্রবার দিনভর মিনায় ইবাদতে মশগুল ছিলেন মুসল্লিরা।  মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ থেকে সাত কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত মিনা। মক্কা মুজদালিফার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান এটি। এই উপত্যকাটি উত্তর দক্ষিণে পাহাড় দিয়ে ঘেরা এবং মসজিদুল হারামের সীমানার মধ্যে অবস্থিত। শুধু হজের সময়েই সেখানে মানুষের ভিড় জমে। সৌদিতে শুক্রবার গড় তাপমাত্রা ছিল ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সম্পর্কে মিনার মাঠ থেকে সাংবাদিক খোরশেদ আলম বাবু জনকণ্ঠকে বলেন, শুক্রবার মিনায় ছিল ২০ লাখের বেশি মুসল্লির মিলনমেলা। সবাই মিনার মাঠে এবাদত বন্দেগীতে মশগুল। তারা সবাই সাদা তাঁবুতে পাশাপাশি অবস্থান করেন। অগ্নিদুর্ঘটনা এড়াতে বছরও মিনার মাঠে রান্না করে খাবার তৈরির কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব মুসল্লির সব খাবারই আসছে বাইরে থেকে।

অপরদিকে আরাফায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এবার কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে হজ পালনের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। আজ বাদ ফজর হজযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে সমবেত হবেন। আজ শনিবার স্থানীয় সময় বেলা ১২টায় মসজিদে নামিরাহতে হজের খুতবা দেবেন মসজিদ আল হারামের ইমাম খতিব . শেখ মাহের বিন হামাদ বিন মুহাম্মাদ বিন আল-মুআইকলি আল-বালাউই হাফিজাহুল্লাহ।

মিনার মাঠ থেকে শুক্রবার বিকেলে হাব সভাপতি শাহাদাত হোসাইন তসলিম জনকণ্ঠকে জানান, এবারও বাংলাদেশের হজযাত্রীদের জন্য নেওয়া হয়েছে প্রযোজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা। হাজীদের বহন করার জন্য রয়েছে বিশেষ ট্রেন সার্ভিস, রয়েছে বাসেরও ব্যবস্থা। মিনা থেকে আরাফাতের দূরত্ব বেশি না হওয়ায় অনেকে হেঁটেও রওনা হবেন। তবে বাংলাদেশী হজযাত্রীদের বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে দেওয়া হয়েছে। কিছু হজযাত্রী ভিড় এড়াতে মসজিদে নামিরাহর কাছে অবস্থান করার জন্য ফজরের নামাজের আগেই রাত তিনটার দিকে মিনার মাঠ থেকে আরাফাতের উদ্দেশে রওনা হবেন।

আরাফাতের অবস্থান সম্পর্কে হাদিস শরিফে বলা আছে, হজের ফরজ কাজ হচ্ছে তিনটি। ইহরাম বাঁধা, জিলহজ নির্দিষ্ট সময়ে উকুফে আরাফায় অবস্থান করা এবং কাবাঘর তাওয়াফ করা। ইসলামি শরীয়াহ মোতাবেক হজের প্রধান রুকন উকুফে আরাফায় অবস্থান করাটা ফরজ। তাই আজ মিনার মাঠে ফজরের নামাজের পর পরই হজযাত্রীরা আল্লাহর  নৈকট্য লাভ তামাম জিন্দেগীর গুনাহ মাফ করার একান্ত বাসনা নিয়ে রওনা দেবেন আরাফাত অভিমুখে। এখানে জোহরের ওয়াক্ত থেকে শুরু হবে উকুফের সময়। জোহরের ওয়াক্ত থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে ব্যক্তি আরাফায় উপস্থিত হবেন, তাঁর জন্য সূর্যাস্ত পর্যন্ত উকুফ করা ওয়াজিব। কেউ সূর্যাস্তের পূর্বে পৌঁছতে না পারলে আগত রাতের সুবেহ সাদিক পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জ্ঞাত অজ্ঞাতসারে কিছুক্ষণ অবস্থান করলেও উকুফের ফরজ আদায় হয়ে যাবে।

হাদিস মোতাবেক, আরাফায় পৌঁছে উকুফের আগে গোসল করা সুন্নত। অনেকে গোসল না করে শুধু অজু করেই সামান্য খাবার খেয়ে নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন।

আরাফাতের মাঠে করণীয় আরাফার কেন্দ্রবিন্দু মসজিদে নামিরাহর জামায়াতে অংশগ্রহণ করা। ইমামের পেছনে একসঙ্গে একই আজানে জোহর আছর আদায় করতে হয়। কিন্তু মসজিদে নামিরাহয় জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় নিজ নিজ খিমা বা তাঁবুতে জোহর আছর আলাদা পড়ার নিয়ম। তবে নিয়ে মতবিরোধও রয়েছে। নিজের তাঁবুতে যদি কেউ মসজিদে নামিরাহর জামায়াতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোহর আছর একত্রে পড়তে চান, সেটাও সহিহ্ হয়ে যায়। নিয়ে বিবাদে না জড়ানোই শ্রেয় বলে মনে করেন মসজিদে নামিরাহর খতিব।

হাদিসে রয়েছে, আরাফাতের ময়দানে সূর্যান্ত পর্যন্ত থাকার পর একজন হজযাত্রীর আসল হজ হয়ে যায়। সূর্যাস্তের পর সবাই হাজি হিসেবে গণ্য হবেন। আরাফাত ময়দান থেকে সূর্যাস্তের পর মাগরিবের নামাজ না পড়েই মুজদালিফার দিকে সব হাজি রওনা হবেন।

মুজদালিফার আমল আরাফাত থেকে এসে জিলহজ  রাতে মুজদালিফায় অবস্থান করা সুন্নতে মুআককাদা। এদিন মাগরিব এশার নামাজ এক আজান এক ইকামতে মুজদালিফায় একত্রে পড়তে হবে। তবে অতিশয় বৃদ্ধ, নিতান্ত দুর্বল কিংবা অধিক পীড়িত রোগীর জন্য মুজদালিফায় অবস্থান না করে আরাফা থেকে সোজা মিনায় চলে যাওয়ার অনুমতি আছে। রাতে ঘুমানো আরাম করাই প্রধান আমল। কেননা মুসলিম শরীফের এক হাদিসে আছে, রাসুল () রাতে এশা পড়ে শুয়ে পড়েছেন, যেন সুবেহ সাদিকের পর উকুফের সময় দোয়া জিকিরে মশগুল থাকা যায়। তবে বর্তমানে দেখা যায়, মুজদালিফায় হাজিরা সারারাতই বিছানায় সজাগ অবস্থায় শুয়ে থাকেন। ছাড়া এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হয় কঙ্কর বা পাথর। এসব কঙ্কর মারতে হবে মিনার মাঠের জামারায়। মুজদালিফায় ফজর নামাজ শেষে আগামীকাল রবিবার ১০ জিলহজ সব হাজি একত্রে রওনা দেবেন ফের মিনার মাঠে। এদিন শুধু বড় শয়তানের ওপর কঙ্কর মারতে হয়। হজের ইহরাম বাঁধার পর থেকেই পর্যন্ত সবচেয়ে উত্তম জিকির তালবিয়া পড়া এখানেই শেষ করতে হয়।

কঙ্কর বা পাথর মারার নিয়ম হচ্ছে ১০ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য ঢলে পড়া পর্যন্ত। অর্থাৎ জোহরের সময়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পাথর মারা উত্তম। তবে অসুস্থ ব্যক্তিরা সূর্যাস্ত পর্যন্ত পাথর মারতে পারেন। তাও সম্ভব না হলে অন্য কেউ কাউকে দিয়ে বদলি পাথর মারাও জায়েজ আছে। পাথর মারার পর তামাত্তু কিরান হাজিদের জন্য কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব। মিনার মাঠেই কোরবানির সুবন্দোবস্ত রয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশের হাজিরা সরকারি ব্যক্তিগতভাবে কোরবানি দিতে পারেন। কোরবানির পরই হাজিরা মাথা মু- করে হালাল হয়ে যান। এর পর আবার তাঁরা যাবেন মক্কা শরিফে। পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করা ফরজ। তার পরের কাজটি সাফা মারওয়া সাতবার সায়ী করা ওয়াজিব। রাতে আবার হাজিরা ফিরে এসে মিনার মাঠে পর পর আরও তিনদিন অবস্থান করে শয়তানকে পাথর মারার মধ্য দিয়ে শেষ করবেন ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ।

খুতবা দেবেন . শেখ মাহের বিন হামাদ এবার হজের খুতবা দেবেন মসজিদ আল হারামের ইমাম খতিব . শেখ মাহের বিন হামাদ বিন মুহাম্মাদ বিন আল-মুআইকলি আল-বালাউই হাফিজাহুল্লাহ। মসজিদে নামিরাহতে এক আজান দুই ইকামতে জোহর আছর সালাত ইমামতি করে ২০২৪ সালের পবিত্র হজের খুতবা পেশ করবেন।

. মাহের ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে পবিত্র মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি উম্ম আল কুরা কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করেন। . মাহের মদিনার টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক হন। মক্কা আল মোকাররমায় শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তিনি মক্কার প্রিন্স আব্দুল মজিদ স্কুলে ছাত্র গাইড নিযুক্ত হন। তিনি ২০০৪ সালে উম্ম আল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের আইনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ব্যাখ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।

তিনি উম্ম আল-কুরা ইউনিভার্সিটির কলেজ অফ জুডিশিয়াল স্টাডিজ অ্যান্ড রেগুলেশনের জুডিশিয়াল স্টাডিজ বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ভাইস ডিনের পদে অধিষ্ঠিত। তার থিসিসটির শিরোনাম ছিলআবদ আল-মালিক আল-মাইমুনির (সংগ্রহ অধ্যয়ন) বর্ণনা অনুসারে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল আইনশাস্ত্রের সমস্যা তিনি ২০১১ সালে  উম্ম আল-কুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার ডক্টরেট অর্জন করেন, শাফিয়ি আইনশাস্ত্রে ইমাম শিরাজী কর্তৃক গ্রন্থের তুহফাত আল-নাবিহ, শরহ আল-তানবিহ তার গবেষণার বিষয় ছিল। তিনিদ্য প্রফেটস মাস্টারপিস ইন এক্সপ্লেনেশন অফ দ্য ওয়ার্নিং টু আল-জাঙ্কলোনি আল-শাফিশিরোনামে একটি ডক্টরেট থিসিসও পেয়েছিলেন। তিনি ২৮ মুহাররম ২০১৩ সালে আইনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি মক্কা আল-মুকাররমায় আল-আওয়ালি জেলার আল-সাদি মসজিদের খুতবার নেতৃত্ব দেন। তিনি ১৪২৬ হিজরি এবং ১৪২৭ হিজরিতে পবিত্র রমজান মাসে নববীর মসজিদে নামাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ১৪২৮ হিজরিতে রমজান মাসে পবিত্র মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদে তারাবিহ এবং তাহাজ্জুদের নামাজের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই থেকে অদ্যবধি তিনি গ্র্যান্ড মসজিদের সরকারি ইমাম হিসেবে নিযুক্ত আছেন।

গাজার কেউ হজে যায়নি এবার সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২০ লাখেরও বেশি মুসলমান হজ পালনের সুযোগ পেয়েছেন। এমনকি ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীর থেকেও হাজারও ফিলিস্তিনি গেছেন হজ পালন করতে। কিন্তু এবার গাজা থেকে কোনো ফিলিস্তিনি হজে যেতে পারেননি।

উল্লেখ্য, গাজার মানুষ সাধারণত রাফা ক্রসিং দিয়ে প্রথমে মিসরে যান। এর পর সেখান থেকে তারা সৌদিতে পৌঁছান। কিন্তু মে মাস থেকে এই ক্রসিংটি বন্ধ করে রেখেছে ইসরাইলিরা। অবশ্য এবার ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর থেকে হজ পালনে মক্কায় গেছেন চার হাজার ২০০ জন। মূলত রাফা ক্রসিং ইসরাইলের দখলে থাকায় এবং ভূখন্ডটি অবরুদ্ধ করে রাখায় গাজার ২৫০০ মুসল্লি এবার হজ করতে যেতে পারেননি। অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা এবং গাজাকে মিসরের সঙ্গে সংযুক্তকারী রাফা ক্রসিংয়ে আক্রমণ দখলে নেওয়ার ফলে সেখান থেকে কেউ হজ যাত্রা করতে পারেননি।

সম্পর্কে বৃহস্পতিবার আনাদোলু এজেন্সিকে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইকরামি আল-মুদাল্লাল বলেছেন, হজে যেতে বাধা সৃষ্টি করাধর্মীয় স্বাধীনতার স্পষ্ট লঙ্ঘন। ইসরাইলি আগ্রাসন যুদ্ধের কারণে মিসর সৌদি আরবের মধ্যে দিয়ে পরিবহন চুক্তি স্বাক্ষর এবং মক্কা মদিনায় হাজিদের থাকার জায়গা বুকিংসহ হজের স্বাভাবিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। রাফা ক্রসিং বন্ধ করা এবং চলমান সংঘাত ২৫০০ মুসলিম সহগামী মিশনগুলোকে হজের জন্য ভ্রমণ করা থেকে বিরত রেখেছে।

মন্ত্রণালয় সৌদি আরব এবং মিসরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারাও এটিকে ফিলিস্তিনি হজযাত্রীদের অধিকারেরস্পষ্ট লঙ্ঘনহিসাবে বর্ণনা করেছে। তবে তিনি আশ্বস্ত করেছেন, এই বছর ক্ষতিগ্রস্ত হজযাত্রীরা আগামী বছর হজ করার সুযোগ পাবেন। তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

×