ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বরিশালে চাপকলে উঠছে না পানি ॥ বিপাকে মানুষ

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল

প্রকাশিত: ২০:৪১, ১০ মে ২০২৪

বরিশালে চাপকলে উঠছে না পানি ॥ বিপাকে মানুষ

বরিশালে পানির জন্য অপেক্ষা

নগরীর পর এবার বরিশালের আশপাশের গ্রামেও একে একে অকেজো হচ্ছে টিউবওয়েল। দীর্ঘসময় চাপার পরেও এসব কলে উঠছে না পানি। গত কয়েকদিনের অসহনীয় তাপমাত্রার সঙ্গে চাপকলে পানি না ওঠায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষ।
হিট অ্যালাটের বিপদ সংকেতের মধ্যেই মাইলের পর মাইল দূরে গিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে সংকটাপন্ন এলাকাগুলোতে ১৩০টি মেশিনে চলা পানির পাম্প বসানোর কাজ শুরু করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। তবে এতে সংকটের ছিটেফোঁটাও মিটবে না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
নগরী থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়ন। সেখানকার বাসিন্দা নূর ইসলাম বলেন, কয়েকদিন ধরে এখানে কোনো টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চাপার পরেও একই অবস্থা। একই কথা বলেন, নগরী সংলগ্ন কাশিপুর ইউনিয়নের তিলক কলাডেমা এলাকার বাসিন্দা রায়হান মল্লিক। তিনি বলেন, গরমের তীব্রতা বাড়ার আগে ২-১টা টিউবওয়েলে যাও পানি উঠত এখন আর তাও মিলছে না। আশপাশের যেসব বাড়িতে টিউবওয়েলের সঙ্গে পানি উঠানোর পাম্প (সাবমারসিবল) লাগানো আছে তারাই কেবল পানি পাচ্ছেন। আমরা যারা সাধারণ টিউবওয়েল ব্যবহার করি তাদের টিউবওয়েল অনেকক্ষণ চাপার পরেও পানি উঠছে না।
জাগুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির বলেন, পানি না ওঠার কারণ জানতে গিয়েছিলাম উপজেলা ইঞ্জিনিয়ারের কাছে। তিনি বলেছেন, পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে নাকি এ অবস্থা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উপরিভাগ থেকে ৮-১০ ফুট নিচে থাকলে চাপকল চেপে পানি উঠানো সম্ভব। কিন্তু বরিশাল নগরী সংলগ্ন পাঁচটি ইউনিয়নের পানির স্তর এতটাই নিচে নেমে গেছে যে, টিউবওয়েল চেপে সেই পানি উঠানো যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, এখনো মাটির ৯১০-৯২০ ফুট নিচেই মিলছে সুপেয় পানি। কিন্তু স্তর চাপের অবস্থান ৮-১০ ফুট থেকে নেমে চলে গেছে ২৩-২৪ ফুট নিচে। যে কারণে একইসঙ্গে বিকল হয়ে পড়েছে শত শত টিউবওয়েল। এ সমস্যা দেখা দিয়েছে নগর সংলগ্ন পাঁচটি ইউনিয়নে। আবার এসব ইউনিয়নের যে জায়গাগুলো নগরী থেকে খানিকটা দূরে সেখানে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে চরবাড়িয়া, চরকাউয়া, রায়পাশা-কড়াপুর, কাশিপুর এবং জাগুয়া ইউনিয়নে। সিটি করপোরেশন গঠিত হওয়ার সময় এসব ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা নগরীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্ধিত এলাকা নামে পরিচিত সেসব এলাকাতেই বেশি সমস্যা হচ্ছে। বরিশাল নগর এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের নিম্নগামিতা আরও ভয়াবহ। মূলত তার প্রভাবই পড়েছে নগরী সংলগ্ন এসব ইউনিয়নের ভূগর্ভস্থ স্তরে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইমরান বলেন, বরিশাল নগরীতে টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে কমপক্ষে আট থেকে দশ বছর আগে। অগণিত বহুতল ভবন নির্মাণ ও এসব ভবনের বাসিন্দাদের পানির চাহিদা মেটাতে অপরিকল্পিতভাবে পাম্প বসিয়ে পানি উঠানোর কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যুগ যুগ ধরে এভাবে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে আনায় ভূ-উপরিতল থেকে মাত্র ৮-১০ ফুট নিচে থাকা পানির স্তর নেমে গেছে ৪২-৪৩ ফিট নিচে। ফলে এখন যে কেবল টিউবওয়েলে পানি উঠছে না তা নয়; সুপেয় পানির স্তর পর্যন্ত তার ভারসাম্য হারাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আগে যেখানে বরিশাল নগরীতে ৭৫০-৮০০ ফুট নিচে গেলেই বিশুদ্ধ পানি মিলত, বর্তমানে সেখানে এখন সাড়ে নয়শ’ ফুট নিচে যেতে হচ্ছে। এখনই এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো বরিশাল নগরী পানির হাহাকার পরবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আহম্মেদ শাহরিয়ার বাবু বলেন, এখানে কোনো টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। পুরো ইউনিয়নে হাতেগোনা কিছু সাবমারসিবল রয়েছে। খাবার পানি সংগ্রহে সেগুলোতেই ছুটতে হয় মানুষকে। এ ছাড়া গোসলসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার হচ্ছে পুকুর কিংবা খালের পানি। চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে একটু খাবার পানির জন্য মানুষ যে কতটা কষ্ট করছে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করানো যাবে না। ইউপি চেয়ারম্যান আরও বলেন, কথা ছিল জলবায়ু প্রকল্পের আওতায় এখানে বেশ কিছু টিউবওয়েল বসানো হবে। কিন্তু টিউবওয়েলে পানি না ওঠায় এখন নাকি তাও বসানো হবে না।
বরিশাল সদর উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী আবু সালেহ বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। উল্লেখিত পাঁচ ইউনিয়নে আমাদের দেড় হাজারের মতো টিউবওয়েল রয়েছে। যার অধিকাংশই কাজ করছে না। রাজস্ব খাতভুক্ত একটি প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে এসব ইউনিয়নে ১৩০টি টিউবওয়েল বসানোর কাজ চলছে। এসব টিউবওয়েলে সাবমারসিবলের পাশাপাশি জলাধার বসানোর কাজ শুরু করা হয়েছে। এখানে প্রতিটি টিউবওয়েলের সঙ্গে থাকা জলাধারেও পানি সংরক্ষিত থাকবে। তিনি আরও বলেন, আগে যেসব সাবমারসিবল বসানো হয়েছে তার সঙ্গে এগুলো যোগ হলে পানির সমস্যা অনেকটা দূর হবে। গ্রীষ্মকালেই মূলত সমস্যাটা বেশি হয় দাবি করে সহকারী প্রকৌশলী আবু সালেহ বলেন, বিশেষ করে ২-৩ বছর ধরে একই সমস্যা দেখা দিলেও এবার ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। বর্ষাকালে পানির স্তর ৮-১০ ফুটের মধ্যে চলে আসে। তখন সব চাপকলই কাজ করে। এ বছর গরমের শুরু থেকেই চাপকলগুলোতে পানি উঠছে না। তাই সমস্যার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। খুব শীঘ্রই এ সমস্যা সমাধানে বড় ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

×