ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

খাদের কিনারে ১০ আর্থিক প্রতিষ্ঠান

রহিম শেখ

প্রকাশিত: ২২:৪৬, ২০ মে ২০২৪

খাদের কিনারে ১০ আর্থিক প্রতিষ্ঠান

১০ প্রতিষ্ঠান চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে

দেশের ব্যাংক বহির্ভূত ৩৩ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মধ্যে অন্তত ১০ প্রতিষ্ঠান চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের তহবিল সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। আস্থার সংকটে পড়ে আমানত বাড়ার হার যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে অন্য ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের আমানতের পরিমাণের চেয়ে সম্পদের পরিমাণ কমে গেছে। খেলাপি ঋণের বহর শুধুই বাড়ছে।

এসব মিলে কোম্পানিগুলোর সব সূচক নেতিবাচক পর্যায়ে চলে গেছে। তারপরও শেয়ারবাজারে এসব কোম্পানির দাপট যেন বাড়ছেই। টানা দরপতনের শেয়ারবাজারে দাম বাড়ছে প্রায় ৯৭ শতাংশ খেলাপি ঋণের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্সের। ৯৯ শতাংশ খেলাপি ঋণের আরেক বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিংয়েরও দাম বাড়ছে কারণ ছাড়াই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের  এক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, জাল-জালিয়াতির কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে এ খাতে ২০২০ সালে মূলধন কমে ১০ হাজার ৪০ কোটি টাকায় নেমে আসে। জালিয়াতির প্রভাব আরও প্রকট হলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মূলধন আরও কমে ৭ হাজার ১৩২ কোটি টাকায় নামে। ২০২২ সালের মার্চে তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকায়। ওই সময়ে ভালো কয়েকটি কোম্পান রাইট শেয়ার ও বোনাস শেয়ার দিয়ে মূলধন বৃদ্ধি করে।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ বাড়ায় মূলধন আবার কমে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৭১ কোটি টাকায় নামে। ২০২৩ সালের মার্চে আরও কমে ৪ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা, জুনে আরও কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকায় ও সেপ্টেম্বরে মূলধন রেকর্ড পরিমাণে কমে ১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। মূলধন কমায় তাদের ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা কমেছে।

ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর সম্পদ ও দেনার মধ্যকার ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে। আগে দেনার চেয়ে সম্পদ বেশি ছিল। এখন দেনার পরিমাণ বেশি। সম্পদ কমে গেছে। যে কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। আরও অনেক কোম্পানির আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা নেই। 
পিপলস লিজিংয়ে প্রায় ছয় হাজারের ওপরে আমানতকারী রয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ের আমানতকারীদের সাড়ে সাতশ’ কোটি টাকা আমানত রয়েছে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে সামিয়া বিনতে মাহবুব ও তার স্বামী পিপলস লিজিং এ প্রায় এক কোটি টাকার বেশি অর্থ ছয় মাসের জন্য আমানত রাখেন। তিনি বলেন, একটা জমি কিনব বলে ছয় মাসের জন্য দুজনের সব সঞ্চয় ডিপোজিট করি। সেই ছয় মাস এখন ছয় বছর হয়ে গেছে।

শুধুমাত্র চিকিৎসা সংক্রান্ত আবেদন করার কারণে একবার পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছি। তবে, কোনো ইন্টারেস্ট দেয়া হয়নি। কবে নাগাদ পুরো অর্থ পাওয়া যাবে সেটাও অনিশ্চিত। ২০২১ যখন আদালতের বোর্ড পুনর্গঠন করে দিয়েছিল, সেই বোর্ডে আমানতকারীদের মধ্য থেকে একজন প্রতিনিধি রাখা হয়। সংগীতশিল্পী নাশিদ কামাল ছিলেন এই বোর্ডে। তিনি বলেন, আমার নিজের ৫০ লাখ টাকা ডিপোজিট ছিল।

মাত্র পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছি। এখন তিনি পিপলস লিজিংয়ের বোর্ডে নেই। তবে, সে সময়ের অভিজ্ঞতায় তিনি জানান, এমন অনেকে আছেন যাদের সর্বস্ব তারা আমানত রেখেছিলেন কিন্তু বর্তমানে আমানতের অর্থ ফেরত না পেয়ে নিদারুণ কষ্টে জীবন যাপন করছেন। জানা যায়, বাংলাদেশের সংগীত শিল্পী মুস্তফা জামান আব্বাসীর পরিবারের প্রায় চার কোটি টাকা পিপলস লিজিংয়ে আমানত রাখা হয়। কিন্তু এখনো ফেরত পাননি এ আমানত।
এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি বা বিআইএফসি এখন পরিচালিত হচ্ছে আদালত গঠিত পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে। এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) গঠিত পর্ষদের মাধ্যমে।

এসব প্রতিষ্ঠানে জমানো টাকা ফেরত পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন গ্রাহকরা। গতবছরের সেপ্টেম্বর-ভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ের এক হাজার ৯৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর শেয়ার বাজারে আবারও লেনদেন শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে কোন কারণ ছাড়াই দাম বাড়ছে শেয়ারটির। টানা দরপতনের বাজারে প্রায় প্রতিদিনই দাম বাড়ছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি বা বিআইএফসির। 
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে ১৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা মোট ঋণের ৯০ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে।

যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি সেগুলো হলো- পিপলস লিজিং ৯৯.০২ শতাংশ, বিআইএফসি ৯৬.৮৫ শতাংশ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ৯৪.৭৬ শতাংশ, ফারইস্ট ফাইন্যান্স ৯৪.৪১ শতাংশ, জিএসপি ফাইন্যান্স ৯২.৩৭ শতাংশ, এফএএস ফাইন্যান্স ৮৯.৫৬ শতাংশ, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ৮৯.৪১ শতাংশ, আভিভা ফাইন্যান্স ৭১.৭২ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিং ৬৬.৭৪ শতাংশ, সিভিসি ফাইন্যান্স ৫৯.৩৯ শতাংশ, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স ৫৯.১৭ শতাংশ, আইআইডিএফসি ৫৮.৬৪ শতাংশ, হজ্জ ফাইন্যান্স ৫৭.৭৯ শতাংশ, ফনিক্স ফাইন্যান্স ৫৭.৭৭ শতাংশ, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স ৫৬.৮৬ শতাংশ, বে লিজিং ৫২.৮২ শতাংশ এবং উত্তরা ফাইন্যান্স ৫০.৮২ শতাংশ।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও এফএএস ফাইন্যান্সের স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান নূরুল আমিন বলেন, অন্যান্য খাতের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। 
এর প্রধান কারণ ব্যাংক যে ব্যবসা করে তার বাইরে বিশেষ কোনো কাজ করে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাংকে যারা ঋণ পায় না তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে আসে। এখান থেকে ঋণ নেয়। একটা সময় খেলাপি হয়ে পড়ে। কিন্তু এদের মার্চেন্ট ব্যাংক, সাবসিডিয়ারি ও পুঁজিবাজারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত ছিল।

×