ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৪ মে ২০২৪, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

নানা রঙের একটিই ফুল চন্দ্রমল্লিকা

সাদা হলুদ মেরুন গোলাপি- কোন রঙের চাই?

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ০০:১০, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩

সাদা হলুদ মেরুন গোলাপি- কোন রঙের চাই?

মেরুন রঙের চন্দ্রমল্লিকা

এখন ফুলের দোকানে গেলে চন্দ্রমল্লিকা চোখে পড়বেই। রাজধানী ঢাকার প্রায় সব দোকানে এ ফুল পাওয়া যাচ্ছে। কারণ এখন শীতের কাল। একদিকে শীতকাল শুরু হয়, অন্যদিকে ফুটতে শুরু করে চন্দ্রমল্লিকা। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। আশপাশের কোনো বাগানে ঢুঁ মারুন কিংবা নার্সারিতে, আপনাকে স্বাগত জানাবে চন্দ্রমল্লিকা। আর ফুলের দোকানের কথা তো বললামইÑ বিপুল পরিমাণ চন্দ্রমল্লিকা দোকানিরা সাজিয়ে রেখেছেন। ঘ্রাণ নেই। তাতে কী? অনেকগুলো রং। সাদা হলুদ মেরুন হালকা গোলাপি- কোনটি চাই? আরও কয়েকটি রং হয়। যে কোনো একটি বা একাধিক রং বেছে নিয়ে চমৎকার ফুলদানি সাজানো যায়। অন্য ফুল দিয়ে তোড়া সাজাবেন? সেখানেও দু’ চারটি চন্দ্রমল্লিকা গুঁজে দিতে পারেন। আকর্ষণ অনেক বেড়ে যাবে। দোকানিরা নিজ উদ্যোগেও কাজটি করে থাকেন। 
চন্দ্রমল্লিকার কুঁড়ি আসা শুরু হয় অক্টোবরে। নভেম্বর থেকে ফুল। এখন ডিসেম্বর। ফলে সৌন্দর্যের সবটুকু নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। কোনোটি ছোট টেনিস বলের মতো দেখতে, পাপড়ি ভেতরের দিকে মোড়ানো। কোনোটির পাপড়ি বাইরের দিকে। ঝুলন্ত কিছু ফুলের মাঝখানটা আবার চাকতির মতো দেখতে। 
ইউরোপের দেশগুলোতে খুব হয় চন্দ্রমল্লিকা। কিছুদিন আগে ফ্রান্সের প্যারিস, নেদাল্যান্ডসের আমস্টারডাম, সুইজারল্যান্ডের জুরিখ ঘুরে বেড়ানোর সময় ঘন ঘন এ ফুলের দেখার সুযোগ হয়েছে। প্যারিসে ফুটপাত সংলগ্ন একটি ফুলের দোকানে চোখে পড়েছে চন্দ্রমল্লিকা। অন্য দেশগুলোর সুপারশপে ঢোকার মুখে চন্দ্রমল্লিকা সাজিয়ে রাখতে দেখা গেছে। বলে রাখা ভালো, ইউরোপের মানুষ এখনো বই এবং ফুলপ্রেমী। 
চন্দ্রমল্লিকার বিভিন্ন রঙের কথা বলছিলাম, আরেকটু বিষদে বলি এবার। সাদা রঙের চন্দ্রমল্লিকা ফুলপ্রেমীদের মনে এক ধরনের পবিত্র অনুভূতির জন্ম দেয়। এ কারণে ইউরোপের দেশগুলোতে প্রয়াত প্রিয়জনের কফিনে, সমাধির ওপর ফুলটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়ায় শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয় সাদা চন্দ্রমল্লিকা দিয়ে। মৃত ব্যক্তির স্মরণানুষ্ঠানে বা প্রার্থনা সভায় ব্যবহৃত হয় সাদা ফুল। তাই বলে সাদা চন্দ্রমল্লিকা শুধুই শোক প্রকাশের জন্য নয়, বিয়ের আনন্দঘন অনুষ্ঠানেও ব্যবহার করা হয়। নব দম্পতিকে শুভ কামনা জানাতে উপহার দেওয়া হয় সাদা চন্দ্রমল্লিকা। জন্মদিনসহ অন্যান্য উৎসব অনুষ্ঠানে অনিবার্য হয়ে ওঠে এ ফুল। 
তারও আগে গেলে বলতে হবে জাপানের কথা। দেশটির জাতীয় ফুলই চন্দ্রমল্লিকা। সেখানে আলাদা করে একটি উৎসব হয়, উৎসবের নাম ‘ফেস্টিভ্যাল অব হ্যাপিনেস।’  কী দারুণ না ব্যাপারটা? যতদূর তথ্য, অষ্টম শতক থেকে জাপানে ফুলটি আছে। জাপান থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পনেরো শতকে দৃশ্যমান হয় চীনে। চীনের পাশাপাশি কোরিয়া ফুলটিকে আপন করে নিয়েছে। অবাক করা তথ্য হচ্ছে, বর্তমানে শুধু থাইল্যান্ডে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার জাতের চন্দ্রমল্লিকা হয়। আর ১৭ শতকে চন্দ্রমল্লিকা পৌঁছে যায় ইউরোপে। 
উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা অনুযায়ী, ইউরোপ ও ইংল্যান্ডের প্রজাতিটির নাম ক্রিসানথেমাম সেগেটাম। এই গাছ ৩০ থেকে ৬০ সেন্টি মিটার লম্বা হয়। ফুল চওড়ায় ৫ সেন্টি মিটার পর্যন্ত হয়। পাপড়িতে সাদা ও হলুদ রঙের মিশেল। কখনো আবার মাঝখানে বাদামি। পাপড়িতে হাল্কা হলুদ রং দেখা যায়। মেক্সিকোর প্রজাতিটির নাম ক্রিসানথেমাম কারিনেটাম। গাছ প্রায় ৬০ সেন্টি মিটার উঁচু। ফুলের পাপড়িতে সাদা হলুদ লাল গোলাপি কমলা ও বেগুনি রঙের মিশেল। পাপড়ির গোড়া ও মাঝখানে গাঢ় রং। চীন ও জাপানের প্রজাতি সংকরায়ন ও নির্বাচনের মাধ্যমে ইউরোপ ও আমেরিকায় শ্রীবৃদ্ধি ঘটানো হয়। পাপড়ির গঠন ও ফুলের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী চন্দ্রমল্লিকা কয়েকটি শ্রেণির হয়ে থাকে। হেয়ারি, কেয়ারি, জাপানিজ, ইনকারভড, পম্পরা ইত্যাদি এ ফুলের উন্নত জাত। 
জাতপাত বেশি হওয়ায় চন্দ্রমল্লিকা চিনতে অনেকে ভুল করে বসেন। সূর্যমুখীর সঙ্গে এর যেমন মিল, তেমনি খুব অমিল নেই জারবেরার সঙ্গে। চন্দ্রমল্লিকা চাইলে অনেক সময় দোকানিরা জারবেরা সাজিয়ে দেন। চন্দ্রমল্লিকার জাতপাতও অনেক। একেকটি একেক রঙের। গঠনের দিক থেকেও কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এসব কারণে চন্দ্রমল্লিকা ঘিরে কিছু রহস্য থেকেই যায়। সাধারণ ফুলপ্রেমীরা তো বটেই, কবি তারাপদ রায় পড়ে গিয়েছিলেন বিভ্রান্তিতে। কবিতায় লিখেছিলেন : কোনটা যে চন্দ্রমল্লিকার ফুল/আর কোনটা যে সূর্যমুখী- বার বার দেখেও/আমার ভুল হয়ে যায়,/আমি আলাদা করতে পারি না...।

×