ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২২ মার্চ ২০২৩, ৮ চৈত্র ১৪২৯

monarchmart
monarchmart

পঞ্চগড়ের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন টোপা

স্বাদে অনন্য, টিফিনে জনপ্রিয় জুড়ি নেই আপ্যায়নে

এ রহমান মুকুল

প্রকাশিত: ২২:৫১, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩

স্বাদে অনন্য, টিফিনে জনপ্রিয়  জুড়ি নেই আপ্যায়নে

বাঁ থেকেÑ পঞ্চগড়ের বিশেষ মিষ্টান্ন ‘টোপা’ তৈরিতে স্বামী আজিজুলকে সাহায্য করছেন আফরোজা বেগম। টিফিনের সময় আফরোজার দোকানে এসে রসালো টোপা খাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা

প্রায় চৌদ্দ বছর আগে অষ্টাদশী তরুণী আফরোজা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয় পঞ্চগড় সদর উপজেলার মীরগড় গ্রামের জাহের আলীর সঙ্গে। জাহের আলী স্থানীয় মীরগড় বাজারে চা নাস্তার দোকান করে কোনো রকমে ধরে রেখেছে সংসারের হাল। ক্রেতাদের চাহিদা মাথায় রেখে ডালের বড়া, পেঁয়াজু, বুন্দিয়া কখনো কখনো জিলাপি ভেজে বিক্রি করেন তিনি। আফরোজার শ্বশুর আজিজুল হকও একই বাজারে অপর একটি ছোট্ট দোকানঘরে চালের গুঁড়া, ময়দা, চিনি অথবা গুড় মিশিয়ে বিশেষ মিষ্টান্ন টোপা তৈরি করে বিক্রি করত। স্থানীয় বাজারে বিশেষভাবে তৈরি এ মিষ্টান্নের বেশ কদর। জেলার  ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে টোপার বেশ নামডাক রয়েছে। একই কারণে পঞ্চগড়ে বেড়াতে আসা লোকজনের কাছেও বেশ জনপ্রিয় মিস্টান্ন টোপা। স্থানীয়দের সঙ্গে জেলার বাইরে থেকে আসা লোকজনের পছন্দের সেই মিষ্টান্ন টোপার চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় লাভের পরিমাণ বেশ ভালোই হতো আজিজুলের। অল্প পুঁজি খাটিয়ে বেশ লাভ হওয়ায় আফরোজা শ্বশুরের বিশেষ সেই মিষ্টান্ন  তৈরির কৌশল শিখে নিজেই তৈরি করে মজাদার মিষ্টান্ন টোপা। সংসারে কাজের ফাঁকে তিনি বাড়িতেই তৈরি করেন এ মিষ্টান্ন। এতে তিনিও দেখেন লাভের মুখ। নিজের তৈরি করা টোপা আর স্বামীর দোকানে বিক্রি করে পরিবারে এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা বলে জানালেন আফরোজা বেগম (৩৫)।
আজিজুল হক বলেন, প্রায় শতবছর পূর্বে আন্ধারী বেগম নামের এক নারী মীরগড়ে এসে বিশেষ এ মিস্টান্ন তৈরি করে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করত। খেতে মজাদার হওয়ায় গ্রামের যে প্রান্তেই যেত সেখানেই তা বিক্রি হয়ে যেত। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সামান চাহিদা ধরে রেখেছে ঐতিহ্যবাহী এ মিস্টান্ন। স্থানীয়রা বলছেন, পঞ্চগড়ের মীরগড়ে অতিথি আপ্যায়ন আর বন্ধুদের চা চাক্রের আড্ডায় মিস্টান্ন হিসেবে টোপা বেশ জনপ্রিয় একটি খাবার। চালের গুড়ো, ময়দা, চিনি অথবা গুড় দিয়ে স্থানীয়ভাবে তৈরি রসালো মিস্টান্ন টোপা এখন স্থানীয় মানুষের রসনা বিলাসের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাচ্ছে লোকজন।
এ ছাড়া স্কুল-কলেজের টিফিন সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় এ মিষ্টান্নটি খাওয়া যেন রুটিনে পরিণত হয়েছে। কৃত্রিম কোনো রং বা কেমিক্যাল না মিশিয়ে চালের গুঁড়া অথবা ময়দা দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি রসালো টোপা চিনি বা গুড়ের সিরায় ভিজিয়ে তৈরি করা হয়। দামেও বেশ সস্তা হওয়ায় ক্রেতাদের চাহিদাও বেশ।
বাজারের কোল ঘেঁষে থাকা মীরগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একই ক্যাম্পাসে থাকা মীরগড় ময়নউদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়। দুপুরে টিফিনের ফাঁকে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই আসে জাহের আলীর চায়ের দোকানে। স্কুল শিক্ষার্থী অন্বেষা, নওশীন, মীম, রাইসা বলেন, টিফিনের সময় অন্য খাবারের তুলণায় টোপা খেতে তাদের ভালো লাগে। চিনি বা গুড়ের মিশ্রণে তৈরি টোপা অন্যান্য খাবারের তুলণায় নিরাপদ বলে তারা মনে করেন। তাদের সঙ্গে আসা স্কুলের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের কাছে টোপা বেশ জনপ্রিয় বলে তারা জানালেন।
দোকানদার আজিজুল হক বলেন, প্রতিদিনই তিনি বাজারে বিশেষ তৈরি মিষ্টান্ন টোপা বিক্রি করেন। সারাদিনই  চার থেকে পাঁচশ’ পিস টোপা বিক্রি করেন তিনি।
স্কুল শিক্ষক নূর আজম বলেন, অতিথি আপ্যায়ন আর নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মিস্টান্ন টোপা খেতে যতটা মজার একই ভাবে বন্ধু বা আত্মীয়দের মাঝে পরিবেশন করেও আনন্দ পান তিনি।
মীরগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, টোপায় কৃত্রিম কোনো রং ও ক্ষতিকর কোনো কেমিক্যালের মিশ্রন না থাকায় টোপা অন্যান্য খাবারের তুলনায় নিরাপদ। তা ছাড়া জেলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন হিসেবে বন্ধু বা স্বজনদের বাড়িতে উপহার হিসেবে নিয়ে যায় অনেকে।
ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা আলমগীর ও আল আমীন বলেন, টোপার কথা বন্ধুদের কাছে অনেকবারই শুনেছেন। এবার খেয়ে দেখলেন; সত্যিই অন্য রকম স্বাদ।
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পঞ্চগড়ের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন টোপা স্বাদে ও গুণে অনন্য। পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য নিয়ে গেছেন তারাও খুব মজা আর আনন্দ করে টোপা খেয়ে প্রশংসা করেছে।
টোপা তৈরির কারিগর আফরোজা বেগম বলেন, পরিবারের প্রয়োজনীয় কাজের ফাঁকে শ্বশুরের কাছে শেখা ঐতিহ্যবাহী টোপা তৈরি করে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে জনপ্রিয় টোপা কিনতে অনেকেই আগাম অর্ডার দেয়। তাদের চাহিদা অনুযায়ী বাড়তি তৈরি করেন। প্রায় প্রতিদিনই বাড়িতে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লোকজন টোপা কিনতে আসে। এতে তিনি যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন অন্যদিকে তিনি খুশিও হচ্ছেন লোকজন তার বাড়িতে আসায়।
শত বছর ধরে মীরগড়ের রসালো মিস্টান্ন টোপা স্থানীয়দের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লোকজনের  রসনা বিলাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে জানান আইনজীবী আহসান হাবিব।

 

monarchmart
monarchmart