ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা...

শিউলী আহমেদ

প্রকাশিত: ২১:১৯, ২৮ আগস্ট ২০২২; আপডেট: ২১:২৮, ২৮ আগস্ট ২০২২

নীল আকাশে  সাদা মেঘের ভেলা...

.

নীল আকাশের বুকে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে প্রকৃতিতে উড়ে বেড়াচ্ছে শরত। শরত মানেই আকাশের বুকে সাদা মেঘগুলো রাজত্ব করে বেড়ায় বিভিন্ন আকারে। শত ব্যস্ততার মাঝেও যান্ত্রিক শহরে যারা প্রকৃতিপ্রেমী না, তাদের দৃষ্টিও সেখানে আটকে যায়। তাই তো কবিগুরু বলেছিলেন- ‘নীল আকাশে কে ভাসালে/সাদা মেঘের ভেলারে ভাই ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস শরতকাল। শরতকালটা গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীতের ছোঁয়া নিয়ে আসে। ভাদ্র মাসে গ্রীষ্মের মতো কিছুটা তীব্র গরম থাকে। এই গরম নাকি তাল পাকায়। ক্ষণে ক্ষণে মেঘগুলো আবার ধূসর বর্ণ ধারণ করে বর্ষার ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও নামায়। আশ্বিনে কিছুটা শীতের পরশ পাওয়া যায়, সকালে ঘাসের বুকে মুক্তোর মতো শিশিরকণা পড়ে থাকে। যদিও প্রকৃতি এখন রূপ বদলেছে। তাই বর্ষায়ই দেখা গেছে শরতের নীল আকাশ। শরতকালে আকাশ থাকে অনেক উঁচুতে। নীলের বন্যা লেগে যায় যেন আকাশজুড়ে।

সাদা মেঘগুলো খুব দ্রুত গতিতে উড়ে যেতে থাকে। কি যে মনোমুগ্ধকর সেই ছুটে চলা! থাকে শিউলি, কামিনী, শাপলা, শালুক, জুঁই, কেয়া আর কাশফুলের সমারোহ। ফুলের বনেও সাদার ছোঁয়াই বেশি। শরতের শুভ্রতায় প্রকৃতি  স্নিগ্ধ-শান্ত রূপ ধারণ করে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো শরতকে বরণ করে গান, কবিতাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে। বিশেষ করে ছায়ানট খুব ভোরে চারুকলার বকুলতলায় মনোমুগ্ধকর আয়োজনে শরতকে স্বাগত জানায়। সাধারণত নীল-সাদা হচ্ছে শরতের প্রতীকী পোশাক।

বৈশাখ বা ফাল্গুনের মতো শরতকে বরণের ৎসবে বাঙালী এখনও সেভাবে মেতে উঠেনি। কিন্তু যারা প্রকৃতিপ্রেমী, তারা ঠিকই নীল সাদা পোশাকে নিজেকে আকাশ আর মেঘের সাজে সাজিয়ে নেয়। তবে অদূর ভবিষ্যতে যে শরত ৎসবও ঘটা করে পালন হবে না সে কথা বলা যায় না। বিভিন্ন বুটিক হাউজগুলো এখনি আয়োজন করে শরতের বৈচিত্র্যময় পোশাক। দেশীয় পোশাকের সঙ্গে পাশ্চাত্যের পোশাকের মিশেলে শরতকে সাজিয়ে তোলে সবার জন্য। হালকা রঙের মিশেলে ফুল-লতা-পাতার বৈচিত্র্যে তৈরি করে শাড়ি, জামা, পাঞ্জাবি, কুর্তি। মেয়েরা সময় শাড়ি পড়তে বেশি পছন্দ করে। ফ্যাশন হাউজগুলো নীল সাদার সঙ্গে সবুজ আর সোনালি রঙকে বেছে নিয়ে সবুজ প্রকৃতি আর সোনালি সূর্যকে ফুটিয়ে তোলে। তবে ধূসর, ফিরোজা, হলুদ, কমলাসহ যে কোন হালকা রঙের পোশাকও মানিয়ে যায়। সময় গরমের ছোঁয়া থাকায় আরামের কথা মাথায় রেখে ফ্যাশন হাউজগুলো সবার জন্যে সুতি, ভয়েল, অ্যান্ডি কটন, লিনেন, তাঁতে বোনা ফেব্রিকের উপর পোশাক তৈরি করে। এসব অনেক আরামদায়কও। এসব পোশাকে হ্যান্ড পেইন্ট, ব্লক, বাটিক, সুতার কাজের মাধ্যমে শরতকে তুলে ধরে। পাওয়া যায় কম্বোসেটও। শরতের পূর্ণিমা চাঁদ এতই আলোকিত হয় যে রাতেও নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘেদের ছুটে চলা দৃষ্টিগোচর হয়। আর চাঁদটাকে যেন মনে হয় আকাশের বুকে সুতায় বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে একটা গোল রুটি। সে এক অপরূপ দৃশ্য। সময় নদীর দুই ধারে ফুটে থাকা কাশফুল গ্রামীণ জীবনে প্রভাব ফেলে। তবে শহরে তা পাওয়া যায় না। শহরবাসীরা শহরের আনাচে-কানাচে খুঁজে বেড়ায় কাশফুল। যান্ত্রিক শহরের যান্ত্রিক মানুষেরা দলবেঁধে ছুটে কাশবনের পানে। যেন ৎসব লেগে যায়। বিভিন্ন প্রজেক্ট এলাকাগুলোতে অথবা যেখানে এখনও দালান-কোঠায় ঢেকে যায়নি- সেখানে ফুটে থাকে থরে থরে কাশফুল। ছুটির দিনে বা অন্যদিন বিকেল বেলায় সবাই দলবেঁধে ছুটে যায় প্রকৃতির এই নির্মল, সাদা-শুভ্রতার সান্নিধ্যে। সময় ভোরে দেখা মেলে শিউলি ফুলের। গ্রামের ছোট শিশুরা ভোরে উঠে শিউলি তলায় চলে যায় শিউলি ফুল কুড়াতে। ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথায় যে আনন্দ, তা শহুরে শিশুরা পায় না এখন। আমাদের ছোটবেলায় দৃশ্য খুব চোখে পড়ত। আধুনিকায়নের বেড়াজালে এখন আর শিউলি গাছ তেমন একটা দেখা যায় না। আর এখন শহুরে শিশুরা বুঝেও না শিউলি কুড়ানোর এই মুগ্ধতা। কাজী নজরুল ইসলাম শরতের গ্রামীণ সকালকে বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘শিউলি তলায় ভোর বেলায়,/কুসুম কুড়ায় পল্লী বালা,/শেফালি পুলকে ঝরে পড়ে মুখে/খোঁপাতে চিবুকে আবেশে-উতলা কাশফুলের সমারোহ আর শিউলির মিষ্টি গন্ধভরা হাসিতেই সবাই বুঝে শরত এসেছে। শরত মানেই সবার মনে জাগে কাশফুল আর শিউলির ছবি।

সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের থাকে শারদীয় দুর্গোৎসব। তাই শরতের শুরুতেই তাদের মাঝে সাজ সাজ আয়োজন শুরু হয়। শরত তাই ধর্মীয় প্রাকৃতিক উভয় দিক থেকেই জীবন-যাপনে একটি বিশাল প্রভাব বিস্তার করে। শরত মানেই নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। শরত মানেই শিউলি আর কাশফুলের মেলা।

 

×