
ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমান বি-২ স্পিরিট ইরানে হামলা চালিয়েছে। এই হামলার জন্য বিমানটি একটানা ৩৭ ঘণ্টা আকাশে ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে আকাশে টিকে থাকতে প্রয়োজন পড়ে বিপুল জ্বালানির, যা সম্ভব হয়েছে মাঝ আকাশেই জ্বালানি সংগ্রহের মাধ্যমে।
দীর্ঘ সময় ধরে ওড়ার জন্য এর প্রয়োজন হয় বিপুল পরিমাণ জ্বালানি, যা মাঝ আকাশেই সরবরাহ করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, উড়ন্ত অবস্থায় একটি যুদ্ধবিমান কীভাবে জ্বালানি নেয়?
স্টেলথ বোমারু: বি-২ স্পিরিট
‘স্টেলথ’ বা রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম যুদ্ধবিমান বি-২ স্পিরিট তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থরপ গ্রুম্যান কোম্পানি। পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম এই বিমান রাডার সিগন্যাল ধরা পড়ার ঝুঁকি এড়াতেই ডিজাইন করা হয়েছে ভিন্নভাবে। প্রথমবার আকাশে ওড়ে ১৯৮৯ সালে, আর ১৯৯৭ সাল থেকে এটি যুক্ত হয় মার্কিন বিমান বাহিনীর সক্রিয় বহরে।
বিশ্বজুড়ে এই বিমান ওড়াতে সক্ষম পাইলটের সংখ্যা মাত্র ৮০ জন। একে বাস্তবে দেখা তো দূরের কথা, এটি এত উচ্চতায় ওড়ে এবং এত নিখুঁতভাবে রাডার এড়িয়ে চলে যে এর উপস্থিতি বুঝে ওঠাই কঠিন।
আকাশেই জ্বালানি নেওয়ার প্রক্রিয়া
বি-২ বিমান প্রতি ৬ ঘণ্টা পরপর জ্বালানি নেয়। প্রতিবার এটি গ্রহণ করতে পারে প্রায় ৪৫ হাজার কেজি পর্যন্ত জ্বালানি। আকাশে জ্বালানি সরবরাহের জন্য ব্যবহার করা হয় বিশেষ বিমান, যেগুলোকে বলা হয় এয়ার ট্যাংকার।
ট্যাংকার বিমানটি বি-২-এর থেকে সামান্য ওপরে এবং নির্ধারিত দূরত্বে অবস্থান নেয়। দু’টি বিমান একই গতিতে উড়ে—এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী একই বেগে চলা বস্তু একে অপরের তুলনায় স্থির থাকে।
এরপর বি-২ বিমানের ছাদের একটি ছোট ছিদ্র উন্মুক্ত হয়, যেখানে ট্যাংকার বিমানের পাইপ ঢুকে পড়ে এবং শুরু হয় জ্বালানি স্থানান্তর। প্রক্রিয়া শেষে পাইপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেরিয়ে আসে, আর ছিদ্রটি আবার বিমানের গায়ে পুরোপুরি মিলিয়ে যায়, যাতে রাডার পৃষ্ঠে কোনো ভিন্নতা না থাকে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, এই ছিদ্রটি খোলা থাকলে রাডারে বিমানের সিগন্যাল তিনগুণ বেড়ে যায়—এটি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই জ্বালানি গ্রহণের প্রক্রিয়া অতি সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পিত ও নিরাপদ পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়।
জ্বালানি দেয় কে?
এয়ার ট্যাংকার প্রতিবার ১০–১৫ মিনিটে জ্বালানি সরবরাহ সম্পন্ন করে। প্রতি মিনিটে এটি সর্বোচ্চ ১,৬০০ কেজি পর্যন্ত জ্বালানি সরবরাহ করতে পারে, যদিও এটি নির্ভর করে বিমানের ধরন ও উচ্চতার ওপর। সাধারণত ১৫০০–১০,০০০ মিটার উচ্চতায় ও ঘণ্টায় প্রায় ৫০০ কিমি বেগে ওড়ার সময় এই প্রক্রিয়া চলে।
প্রক্রিয়াটি তদারকি করেন একজন এয়ার রিফুয়েলিং অফিসার। আবহাওয়া, গতি ও দূরত্ব মিলিয়ে জ্বালানি গ্রহণের সময় সঠিক সমন্বয় নিশ্চিত করেন তিনিই। দুটি বিমানের দূরত্ব মাত্র ২০ মিটার—এ অবস্থায় যে কোনো ভুল মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
দুটি পদ্ধতিতে চলে রিফুয়েলিং
১. বুম সিস্টেম:
ট্যাংকার বিমান সামনের দিকে থেকে একটি লম্বা পাইপ (বুম) বের করে। এই বুম বি-২ বিমানের ওপরে নেমে এসে যুক্ত হয় এবং বৈদ্যুতিক সার্কিট পূর্ণ হলে চাপ প্রয়োগ করে জ্বালানি স্থানান্তর করে।
২. প্রোব-অ্যান্ড-ড্রোগ পদ্ধতি:
এতে পাইপের শেষ প্রান্তে ঝুলে থাকে একটি ড্রোগ (ঝাঁটার মতো)। গ্রহণকারী বিমানের পাইলট নিজে একটি প্রোব ড্রোগে প্রবেশ করিয়ে জ্বালানির সংযোগ স্থাপন করেন।
প্রোব-ড্রোগ পদ্ধতিতে বিমানের মধ্যে ২২ মিটার দূরত্ব রাখা হয়, যাতে সংঘর্ষের ঝুঁকি না থাকে। তবে এই পদ্ধতিতে পাইলটদের আরো বেশি নিখুঁততা প্রয়োজন।
আকাশপথে জ্বালানি সরবরাহ প্রথম শুরু হয় ১৯২০-এর দশকে। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এখন এই প্রক্রিয়া প্রায় নিখুঁত। আগামীতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) ব্যবহারের মাধ্যমে এটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অভিযানে বি-২ স্পিরিটের ব্যবহার এবং তার পেছনে থাকা এই জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাই প্রমাণ করে, আধুনিক যুদ্ধ শুধু আগ্রাসনে নয়, জ্বালানির পেছনে থাকা বিজ্ঞানের চমকেও পরিচালিত হয়।
সূত্র: অ্যারোরিপোর্ট ও ইউরোনিউজ।
রাকিব