
ছবি: সংগৃহীত
দেশি খেজুর, যা কিছু অঞ্চলে ‘বুনো’ বা ‘জংলি খেজুর’ নামে পরিচিত, বাংলাদেশের একটি আদিম স্থানীয় ফল। এর বৈজ্ঞানিক নাম Phoenix sylvestris, ল্যাটিন ‘sylvestris’ শব্দের অর্থই ‘বনজ’। এটি অস্বাভাবিকভাবে ছড়ানো ডাঁটা বৃক্ষ, যার উচ্চতা ৪–১৫ মিটারে পৌঁছে। পাতা তীক্ষ্ণ কাঁটা সম্পন্ন, শিকড় বৃত্তাকার এবং গাছের গোড়াগুলো স্তূপাকৃতির শেকড় দ্বারা ঘেরা। পৃথিবীতে Phoenix গোত্রে প্রায় ১৪ প্রজাতি পাওয়া যায়, দেশি খেজুর তারই একটি।
বিস্তার ও অভিযোজন
বাংলাদেশে এটি প্রাকৃতিকভাবে বন্যভাবে জন্মে, বিশেষ করে পতিত জমি, নদীবাঁধ, পুকুর পাড়, রাস্তার ধারে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, নাটোর, রাজশাহী ও ফরিদপুরে এর বাগানভুক্ত বিস্তার বেশি দেখা যায়।
উৎপাদন ও বৈশিষ্ট্য
খেজুর গাছের ফুল আসে শীতের শেষে (চৈত্র–বৈশাখে), চার মাসে ফল হয়ে যায় ঋতু পরিবর্তনের সময়ে (জ্যৈষ্ঠ–আষাঢ়ে)। ফল কাটার পর পাকা হয় ঘরে রেখে দেওয়া মাত্র ২–৩ দিনে, এবং একটি গাছ থেকে প্রায় ১০–২৫ কেজি ফল ও ৫–৭ লিটার রস পাওয়া যায়।
প্রধান ব্যবহার
১. রস (খেজুর রস): শীতের সকালে স্বাদে অতুলনীয় এই খেজুর রস। এই রস দিয়ে গুড়ও তৈরি করা হয়। থালা বা ঘুঁটি পাত্রে এক বা তিন দিনের রসের গুণমান ভিন্ন (জিরান, দো, ঝরা রস)। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০১৬–১৭ সালে খেজুর রসের উৎপাদন ছিল ১ লক্ষ ৬৯ হাজার ৫৬ টন, যার মধ্যে দেশি প্রজাতির অংশ ছিল প্রায় ৩৮ হাজার ৯৩৯ টন।
২. গুড় ও পাটালি: রস ঘন করে তৈরি হয় গুড়; একে ঠিলে বা মাটির পাত্রে ঠাণ্ডা করলে তৈরি হয় পাটালি বা মুছি পাটালি।
৩. ফল: পাকার ফলের গাঢ় লালচে বাদামি রঙ ও মিষ্টি স্বাদ শিশু-কিশোরদের বিশেষ পছন্দ। তবে বীজ বড়, খোসা পাতলা হওয়ায় সংরক্ষণ ক্ষমতা কম।
৪. ঝাড়ু-ঝুড়ি: গাছের শুকনো পাতা ও ডাঁট দিয়ে তৈরি হয় ঝুড়ি, মাদুর এবং গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি হয় ছোট সাঁকোও।
পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতা
দেশি খেজুরে ভিটামিন এ, সি, কে, ক্যালসিয়াম, আয়রন, বিটা-ক্যারোটিন ইত্যাদি আছে। এটি হৃদরোগীদের জন্য উপকারি, রক্তসৃষ্টিতে সহায়ক ও হজম-বৃদ্ধিকারক।
চাষ সম্প্রসারণ
যুগান্তকারী বদল ঘটাতে জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশে দেশি খেজুর চাষের উপর বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বর্তমানে নার্সারিতে চারা উৎপাদন ও বাণিজ্যিক রোপণ শুরু হয়েছে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে।
চারা তৈরি ও সঞ্চালন
বীজ থেকে চারা: ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে পলিব্যাগে অথবা বীজতাপে বপন ২–৩ মাসে চারা গজায়।
রোপণ ও পরিচর্যা: চারা রোপণের আগে ৫০–৭৫ সেমি গর্তে গোবর, ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার মিশিয়ে দেওয়া হয়; পাছা পরিষ্কার ও আগাছা নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত ইউরিয়া স্প্রে দরকার।
রোগবালাই
সাদা ও লাল স্কেল পোকার আক্রমণ, গণ্ডার পোকা, ছত্রাকজনিত রোগে ক্ষতি হয়। কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহারে প্রতিরোধ সম্ভব।
দেশি খেজুর শুধুমাত্র এক প্রাচীন উদ্ভিদ নয়; এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অংশ, শীতকালীন উৎসবের এক ঐতিহ্য, পুষ্টি ও পর্যায়ক্রমিক জীবিকার উৎস। যদি আমরা এর প্রচলন ও চাষ সম্প্রসারণে আগ্রহী হই, তবে দেশজ উন্নয়ন ও স্থানীয় কৃষকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় এটি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
রাকিব