ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

জোবায়ের আলী জুয়েল

বাঙালীর চেতনায় শহীদ আসাদ

প্রকাশিত: ০০:৩৩, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২

বাঙালীর চেতনায় শহীদ আসাদ

২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদের ৫৩তম মৃত্যু দিবস স্মরণে ভুলে যেতে বসেছি কি আমরা আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের মহানায়কদের? বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার এ পথ পরিক্রমায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান একটি মাইলফলক। রাজধানী শেরেবাংলা নগর পেরিয়ে মোহাম্মদপুরের প্রবেশ দ্বারে রয়েছে একটি বিশাল তোরণ, যা ‘আসাদ গেট’ নামেই পরিচিত। ‘আসাদ গেট’ নামটি শোনেনি বর্তমান প্রজন্মের কাছে এমন মানুষ পাওয়া দুর্লভ। কিন্তু তাদের অনেকেই জানেন না শহীদ আসাদ কে? কেনই বা এ গেটটির নামকরণ? ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক শহীদ আসাদের আজ ৫৩তম শহীদ দিবস। আসাদের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ জুন নরসিংদী জেলার শিবপুর গ্রামে। আসাদের কর্মজীবনের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। আসাদুজ্জামান আসাদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) এর ঢাকা হল শাখার সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান সংগঠক। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশ থেকে এগারো দফার বাস্তবায়ন এবং ছাত্র জনতার ওপর পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ২০ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানিয়েছিল। এ ধর্মঘট মোকাবেলার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। তথাপি বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয় এবং দুপুর ১২টার দিকে বটতলায় এক সংক্ষিপ্ত সভা শেষে প্রায় দশ হাজার ছাত্রের একটি বিশাল মিছিল ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাজপথে পা’বাড়ায়। মিছিলটি চানখার পুলের নিকটে তখনকার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে এর ওপর পুলিশ হামলা চালায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক সংঘর্ষ চলার পর আসাদসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা মিছিলটিকে ঢাকা হলের পাশ দিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব কাছ থেকে রিভালবারের গুলি ছুড়ে আসাদকে হত্যা করে। তাঁর মৃত্যু ঊনসত্তরের ছাত্র গণআন্দোলনের গোটা অবয়বকেই পাল্টে দেয় এবং তা’ তৎকালীন আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। আসাদের মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গোটা পূর্ব পাকিস্তানে তিন দিনব্যাপী শোক ঘোষণা করে। এছাড়া কমিটি ঢাকা শহরে হরতাল এবং পরবর্তী চার দিন প্রতিবাদ মিছিলসহ নানা কর্মসূচী পালন করে। ২৪ তারিখে আবার হরতালে গুলি চললে ঢাকার পরিস্থিতি গর্বনর মোনেম খানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সরকারের এই দমননীতি জনতাকে দাবিয়ে রাখতে পারে নাই এবং শেষাবধি ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের পতন ঘটে। তৎকালীন পাকিস্তানের শোষন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম তার পথ ধরে ঘটে গণঅভ্যুত্থান। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর বঞ্চনা ও শোষণ কমিয়ে উন্নয়ন দেখানোর উদ্দেশ্যে ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন কে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপনে আইয়ুব এভিনিউ ও আইয়ুব গেট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। গন অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শাসক লৌহ মানব আইয়ুবের পতন ঘটলে ‘আইয়ুব এভিনিউ’ রূপান্তরিত হয় ‘আসাদ এভিনিউ’ এ ও ‘আইয়ুব গেট’ ‘আসাদ গেট’ হিসেবে পরিণত হয়। আইয়ুব শাহির বুলেটে প্রাণ দিয়েছিলেন আসাদ। এই মৃত্যু বাংলার জনগণের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে গণআন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে। শীতের শেষে নতুন বছরের আমেজ লাগানো এ দেশের মাটি মেঘমুক্ত নীল আকাশ থেকে অকস্মাৎ বাজ পড়ার মতোই অভাবনীয় ছিল আসাদের মৃত্যু। বাংলা শ্রেষ্ঠ প্রয়াত কবি শামসুর রাহমার ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় লিখেছেন ‘মৃত আসাদ বাঙালী জীবনে প্রেরণার উৎস।’ আসাদ কেবল একজন ছাত্র সংগঠকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ঐকান্তিক কৃষক সংগঠকও। অত্যন্ত সংগ্রামী মানসিকতার অধিকারী আসাদ ‘জনগণতন্ত্র’কে মনে করতেন মুক্তির মন্ত্র। আদর্শের প্রতি অটল বিশ্বাস, ধৈর্য, বিপদকে সহজভাবে গ্রহণ করার সাহস ছিল তাঁর মধ্যে। শুধু ছাত্র ও সংগঠনে অথবা গণশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যেই আসাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতা সীমিত ছিল না। সার্বভৌম ও শ্রেণী শোষণমুক্ত একটি দেশ গড়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। ২০ জানুয়ারি আসাদের জীবন দানের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল ঐতিহাসিক ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান। আসাদের রক্তে ঢাকার রাজপথ ভিজেছিল। সারাদেশের জনগণ ক্ষিপ্ত হয়েছিল। তারই ধারাবহিকতায় বাঙালী জাতি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছে স্বাধীনতা। লাখ লাখ শহীদের মাঝে সে কারণেই আসাদ অনন্য। তাই প্রয়োজন আমাদের স্বাধীনতার মূল্য বোধ, শপথ নিতে হবে শহীদ আসাদসহ সব শহীদের স্বপ্ন ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার। আসাদের স্মৃতি ধরে রাখতে আসাদ গেটের সংস্কার ও শ্রীবৃদ্ধি তথা শহীদ আসাদের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ, জীবন সংগ্রামের তথ্য, প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়ে উঠুক সর্বত্রই। আপামর জন সাধারণের এ দাবি সার্বজনীন। মৃত্যুর মাঝে যারা জীবনের সন্ধান পায় তারা মৃত্যুকে বরণ করেও অমর হয়ে থাকে। তাদের বিয়োগ ব্যথার কাহিনী ভবিষ্যত জাতির পক্ষে দ্বীপ শিখা হয়ে সামনে চলার পথ দেখায়। এমন এক বীর সৈনিক ছিলেন শহীদ আসাদ। ছিলেন নির্ভীক ও স্বাধীনতা প্রিয়। নিপীড়িত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত বাঙালী জাতির দীপ্ত আলোর মুক্ত আযাদী সংগ্রামের পথ প্রদর্শক ও স্বপ্ন দ্রষ্টা।
×