ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

করোনাকালে ধর্ষণ ও রাজনীতি

প্রকাশিত: ২০:২৫, ১২ অক্টোবর ২০২০

করোনাকালে ধর্ষণ ও রাজনীতি

উল্লেখযোগ্য অপরাধের মধ্যে ধর্ষণ অন্যতম। বর্তমানে এই ধর্ষণ আমাদের দেশসহ অনেক দেশেই আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন- আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের অনেক দেশেই ধর্ষণের হার বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় তিন-চার গুণ বেশি। তার মধ্যে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের মতো অপরাধ ঘটে দক্ষিণ আফ্রিকায়। করোনাকালে এই হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা ধর্ষণের আদ্যপান্ত আলোচনা করব- ‘Rape is defined as the unlawful sexual intercourse by a man with a women without her consent, against her will or her consent obtained by force, fear or fraud or with a women with or without her consent belwo the age of sixteen years even if she is his wife’-আন্তর্জাতিকভাবে এটাই হলো ধর্ষণের স্বীকৃত সংজ্ঞা। ধর্ষণ, সাধারণ ভাষায় কোন নারীর বিনা অনুমতিতে বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌনসঙ্গম করাকে ধর্ষণ বলা হয়। আমাদের দেশের আইনের ভাষায় : কোন ব্যক্তি নিচের পাঁচ প্রকার বর্ণনাধীন যে কোন অবস্থায় কোন নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে : ১। কোন নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে, ২। কোন নারীর সম্মতি ব্যতিরেকে, ৩। সম্মতিক্রমে তবে মৃত্যু বা ভয় দেখিয়ে, ৪। সম্মতিক্রমে তবে লোকটি জানে যে নারীটি তার স্ত্রী নয়, কিন্তু নারীটি বিশ্বাস করে যে লোকটি স্বামী, ৫। সম্মতিসহ বা ব্যতিরেকে, সেই ক্ষেত্রে নারীর বয়স ১৪ বছরের নিচে বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক। ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী ৯(১) ও ৯(৩) ধারায় আমাদের দেশে বিচার কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে। ৯(১) ধারা অনুযায়ী এককভাবে ধর্ষণের বিচার ৭ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডসহ অর্থদন্ড হয়ে থাকে এবং ৯(৩) ধারা অনুযায়ী, দল বেঁধে ধর্ষণ-সেক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতে পারে। আদিকাল থেকেই পুরুষ ও নারী বৈষম্য, নারীর সমঅধিকার, উত্তরাধিকার সূত্রে নারীর বৈষয়িক সম্পর্ক, নারী শিক্ষা, নারীর প্রতি সহিংসতা এই নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছেই এবং নারীরাও আন্দোলন করে আসছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও সব ধর্মেই নারীকে খাটো করে দেখা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সমাজে বিভিন্ন কারণেই এই বৈষম্যের স্বীকার হয় নারী সমাজ। মহামারী, যুদ্ধ, মানুষের নৈতিক অবক্ষয়, মানসিক বিকৃতি, সামাজিক অপরাধ, অস্থিরতা, সচেতনতার অভাব, হতাশা, নারীর প্রতি ধর্মীয় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, অবৈধ অর্থ, ক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রভাব, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, মাদক এবং বাজারের যৌন উত্তেজক ওষুধের অপব্যবহার ইত্যাদি ধর্ষণের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আইনের প্রয়োগ ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতাও এই অপরাধ প্রবণতা না কমার একটি কারণ। এই সমস্ত অপরাধ শুধু যে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়ে থাকে তা নয়। আজকের ডিজিটাল উন্নত প্রযুক্তির প্রেক্ষাপটে অনেক অপরাধ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও হয়ে থাকে। ধর্ষণের বিচারের ক্ষেত্রে ধর্ষিতার মেডিক্যাল পরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কারণ, পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত সঠিকভাবে প্রমাণিত না হলে বিচারে সঠিক শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। সাধারণত গ্রামগঞ্জে ধর্ষিত হওয়ার পর স্থানীয় প্রভাবশালী, গ্রামের মাতব্বরদের দেন-দরবার শুরু হয়ে যায় এবং এর ফলে সময়ক্ষেপণ হয়। প্রভাবশালী বা চতুর লোকেরা ধর্ষিতাকে প্রথমেই গোসল করে পাক-পবিত্র হতে বলে, যাতে আলামত নষ্ট হয়ে যায়। চতুর লোকেরা অনেকেই এই সুযোগ নেয় এবং ধর্ষিতা প্রকৃত বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। ধর্ষিতাকে সঠিক সময়ে মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য আসতে হয়। ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে না আসলে আলামত নষ্ট হয়ে যায়। একটি মেডিক্যাল বোর্ডের অধীনে কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী একজন বিশেষজ্ঞ মহিলা ডাক্তার এবং নার্স দ্বারা এই পরীক্ষা করা হয়। সুতরাং ধর্ষণের পর দেরিতে মেডিক্যাল পরীক্ষা হলে আলামত নষ্ট হয়ে যায় এবং অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না। এই জন্য প্রকৃত বিচার পেতে হলে সমাজের সবাইকে এক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। আলামত কিংবা ধর্ষিতার পরীক্ষার ব্যাপারে চিকিৎসকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সততার সঙ্গে নিরপেক্ষ ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজটি করতে হয়। অপরাধীরা সব সময় নিজেরা একটি শক্তিশালী অবৈধ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত থাকে। অর্থ ও প্রভাব দিয়ে এই পরীক্ষার ক্ষেত্রেও তাদের কালো হাতের থাবা বিস্তার করে। ধর্ষণের ব্যাপারে সারাদেশের মানুষই প্রকৃত বিচার ও শাস্তির জন্য সোচ্চার। এর প্রতিকারের জন্য শুধু সরকারের একার পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তার জন্য দরকার সমাজের সব শ্রেণী পেশার মানুষের অংশগ্রহণ। সাধারণ মানুষের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। সমাজে মানুষের প্রতি মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে, সামাজিক অবক্ষয় থেকে সরে আসতে হবে এবং সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। এই ক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষা সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এবং পরিবারেই হলো শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। সততা, মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালবাসা, বিশ্বাস, পরোপকার, মা-বাবাসহ একে অপরের প্রতি কর্তব্য, মানবিকতা, আদব-কায়দা, পারিবারিক ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ সবই একটি আদর্শ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তাই পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে মানবিক মূল্যবোধের দৃষ্টিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এই ক্ষেত্রে সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি পরিবারের প্রতিটি সদস্যেরও দায়িত্ব রয়েছে। ধর্ষণের প্রতিবাদে সমাজে বিভিন্ন ব্যানারে আন্দোলন হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি এই আন্দোলন নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ মহলের আন্দোলন ও আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকে হতাশা প্রকাশ করছেন। এই ক্ষেত্রে আন্দোলন হতে হবে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এবং প্রগতিশীলসহ সব সামাজিক সাংস্কৃতিক সব শ্রেণী পেশার মানুষের নির্দিষ্ট লক্ষ্য হতে হবে দ্রুততার সঙ্গে ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে সমাজকে সচেতন করতে হবে। আর সেটা করতে হলে সরকারের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখছি সেই লক্ষ্য থেকে সরে এসে তারা সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে যাচ্ছে। একটি মহল সুকৌশলে জনগণের প্রকৃত দাবি থেকে সরিয়ে দিয়ে আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। আমাদের এই ভূখন্ডে প্রথম রাজনৈতিক মদদে ধর্ষণ হয়েছিল ১৯৭১ সালে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কারা এই ধর্ষণ করেছিল, কেইবা তাদের সহযোগিতা করেছিল, তা আমাদের সকলেরই জানা। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি একই কায়দায় রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক মদদে ধর্ষণ হয়েছিল ১৯৯১ ও ২০০১ সালে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অনেকের মতে দেশে প্রায় ১০,০০০ নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়েছিল। সেই মহলই এখন আবার সুকৌশলে সামাজিক আন্দোলন না করে রাজনৈতিক আন্দোলন এবং ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের আন্দোলন সংগ্রাম ও অর্জনের অনেক ইতিহাস আছে। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধিকার আন্দোলনেও তাদের অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও অবদান আছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডাকসুর প্রাক্তন ছাত্র নেতৃবৃন্দের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন, এমনকি দেশের রাষ্ট্রনায়কও হয়েছেন। ভাবতে কষ্ট হয় সেই ঐতিহ্যবাহী ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। তাই ছাত্র সমাজকে এখন নতুনভাবে ভাবতে হবে এবং আগামী দিনে এই সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হবে এবং ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হবে। আন্দোলন হতে হবে সামাজিক আন্দোলন, লক্ষ্য হতে হবে সুনির্দিষ্ট, অবক্ষয় রোধে সামাজিক মূল্যবোধের উন্নতি, নারীর মর্যাদা, নিরাপত্তা, শিক্ষা-ধর্মীয় মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, ও সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাড়ে তিন বছরে দেশকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন এবং তাঁর নেত্বত্বেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশে প্রবেশ করেছিল। ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলকারী জিয়ার নেতৃত্বে দেশ আবার অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছিল। হত্যা-খুন, ধর্ষণ, ফাঁসি, নির্যাতন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করে দেশ আবার পাকিস্তান ভাবধারায় পরিচালিত হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে ১৭ মে দেশে আসার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করে এবং দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনায় আসে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ চার বার দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আসে। দীর্ঘ এই সময়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য, বিদ্যুত, অবকাঠামো ও যোগাযোগে উন্নয়ন, গ্রামীণ অর্থনীতিসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নয়ন করেন। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজকে বিশ্বের রোল মডেল। বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতায়নকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং ২০৪১ সালে বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন ৫০% এ উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। নারী শিক্ষা এবং নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য গত এক যুগে প্রধানমন্ত্রী অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন দেশে। আমাদের মতো একটি মুসলিম দেশে নারীদের উচ্চশিক্ষা এবং ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী যে অবদান রেখেছেন বিশ্বের অনেক আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে তা প্রশংসিত হয়েছেন। শিশু ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকার কঠোর অবস্থানে আছে এবং ধর্ষণের অভিযুক্তদের মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার জন্য আইনের পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলছে। দেশে এসিড নিক্ষেপও একসময় বহুল আলোচিত অপরাধ ছিল। জননেত্রী শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপের কারণে এর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হয় এবং তার শক্তিশালী পদক্ষেপের কারণে আজ এসিড নিক্ষেপ সংঘটিত হচ্ছে না। একইভাবে ধর্ষণে অভিযুক্ত অপরাধীদের সরকার কোন আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে না। বরং অপরাধীদের দ্রুত বিচার আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করছে এবং ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড দেয়ার জন্য আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াও চলছে। করোনা মহামারীতে সারাবিশ্ব আজ বিধ্বস্ত প্রায়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই আজকে আমাদের দেশ করোনা মোকাবেলায় সফলতার দ্বারপ্রান্তে এবং করোনা মোকাবেলা সফল তার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে প্রশংসিত। প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবেলায় শুধু দেশ নয়, বৈশ্বিক নেতৃত্ব, দিয়ে যাচ্ছেন। এই সময়ে আমাদের সকলকে জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী এবং সহযোগিতা করতে হবে। তবেই আগামী দিনে ধর্ষণসহ অনান্য সকল অপরাধমুক্ত, করোনামুক্ত একটি সুন্দর বাংলাদেশ পাব। লেখক : মহাসচিব স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)
×