
ছবি:সংগৃহীত
সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরেই এশিয়া, আফ্রিকা এবং অন্যান্য অঞ্চলের বিদেশি কর্মীদের জন্য অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য। দেশটির দ্রুতগতিতে উন্নয়নশীল অর্থনীতি, করমুক্ত বেতন, ও বিশাল অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে, তেল-গ্যাস, নির্মাণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আতিথেয়তা, প্রকৌশলসহ বহু খাতে কর্মসংস্থান পাওয়া যায়।
যদি আপনি ২০২৫ সালে সৌদি আরবে কাজ করতে আগ্রহী হন, তবে প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে একটি ওয়ার্ক ভিসা সংগ্রহ করা। চলুন সহজ ভাষায় জেনে নিই সৌদি আরবের ওয়ার্ক ভিসা সম্পর্কে বিস্তারিত।
সৌদি আরব ওয়ার্ক ভিসা কী?
ওয়ার্ক ভিসা হচ্ছে সৌদি আরব সরকার কর্তৃক প্রদত্ত একটি আনুষ্ঠানিক অনুমতিপত্র, যা বিদেশি নাগরিকদের দেশটিতে প্রবেশ করে নির্দিষ্ট নিয়োগকারীর অধীনে বৈধভাবে কাজ করার অনুমতি দেয়। এটি ভ্রমণ বা পর্যটন ভিসা থেকে একেবারেই আলাদা। সাধারণত এই ভিসা এক থেকে দুই বছরের জন্য মঞ্জুর হয় এবং চুক্তির ভিত্তিতে নবায়নযোগ্য।
যোগ্যতা যেগুলো থাকতে হবে:
১. সৌদি নিয়োগকারীর কাছ থেকে চাকরির অফার
আপনাকে অবশ্যই সৌদি আরবের একটি লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোম্পানির কাছ থেকে চাকরির অফার পেতে হবে।
২. পাসপোর্টের মেয়াদ
আপনার পাসপোর্টে কমপক্ষে ভ্রমণের সম্ভাব্য তারিখের পর আরও ৬ মাসের মেয়াদ থাকতে হবে।
৩. প্রাসঙ্গিক শিক্ষা ও দক্ষতা
চাকরির ধরণ অনুযায়ী আপনাকে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দেখাতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই ডিগ্রি বা পেশাগত সার্টিফিকেট আবশ্যক।
৪. পরিষ্কার অপরাধ রেকর্ড
কোনো ধরনের ফৌজদারি মামলা থাকা যাবে না। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট জমা দিতে হতে পারে।
৫. স্বাস্থ্য সনদ
একজন প্রার্থীকে নির্ধারিত মেডিকেল চেকআপের মাধ্যমে ‘ফিট’ প্রমাণ করতে হবে।
৬. আগে কোনো ভিসা লঙ্ঘন বা নিষেধাজ্ঞা না থাকা
পূর্বে সৌদি আরবে অবৈধ অবস্থান বা ভিসা লঙ্ঘনের ইতিহাস থাকলে আবেদন বাতিল হতে পারে।
দরকারি কাগজপত্র:
- মূল পাসপোর্ট (দুইটি ফাঁকা পৃষ্ঠা সহ)
- নিয়োগকারীর অফার লেটার
- সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইস্যু করা ভিসা অথরাইজেশন নম্বর
- পূর্ণাঙ্গ আবেদন ফর্ম
- সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডসহ পাসপোর্ট আকারের ছবি
- মেডিকেল পরীক্ষার রিপোর্ট
- শিক্ষাগত ও পেশাগত সনদপত্র (অ্যাটেস্টেড)
- পুলিশ ক্লিয়ারেন্স
- সইকৃত চাকরির চুক্তিপত্র
- ভিসা ফি পরিশোধের প্রমাণ
- সৌদি চেম্বার অব কমার্স কর্তৃক সত্যায়িত অফার লেটার
- নিয়োগকারী বা রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির অথরাইজেশন লেটার (যদি প্রযোজ্য হয়)
- সব কাগজ আরবি ভাষায় অনূদিত এবং নিজ দেশ ও সৌদি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সত্যায়িত হতে হবে।
ধাপে ধাপে ওয়ার্ক ভিসার আবেদন প্রক্রিয়া:
ধাপ ১: চাকরির অফার ও ভিসা অথরাইজেশন
প্রথমে আপনাকে সৌদি কোম্পানির কাছ থেকে একটি চাকরির অফার নিতে হবে। এরপর নিয়োগকারী সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভিসা অথরাইজেশনের জন্য আবেদন করবে।
ধাপ ২: ভিসা অথরাইজেশন নম্বর সংগ্রহ
অনুমোদনের পর নিয়োগকারী আপনাকে ভিসা অথরাইজেশন নম্বর ও পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পাঠাবে। এগুলো ছাড়া ভিসার আবেদন সম্ভব নয়।
ধাপ ৩: স্বাস্থ্য পরীক্ষা
একটি অনুমোদিত মেডিকেল সেন্টারে পরীক্ষা দিতে হবে, যার মধ্যে রক্ত পরীক্ষা, এক্স-রে ও সংক্রামক রোগ পরীক্ষাও থাকবে।
ধাপ ৪: সনদপত্র যাচাই
আপনার শিক্ষাগত ও পেশাগত কাগজগুলো নিজ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সৌদি দূতাবাস এবং প্রয়োজন হলে সৌদি কালচারাল মিশন কর্তৃক যাচাই করাতে হবে।
ধাপ ৫: পুলিশ ক্লিয়ারেন্স
নিজ দেশের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ থেকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট সংগ্রহ ও সত্যায়ন করাতে হবে।
ধাপ ৬: আবেদন জমা
সব কাগজ প্রস্তুত হলে সৌদি দূতাবাসে কিংবা একটি অনুমোদিত ভিসা এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন জমা দিন।
ধাপ ৭: ফি প্রদান
আবেদনের সময় ভিসা ফি জমা দিতে হবে। ফি-এর পরিমাণ দেশ ও পেশাভেদে আলাদা হতে পারে।
ধাপ ৮: প্রক্রিয়াকরণ ও ভিসা প্রদান
ভিসা আবেদনের পর ৭ থেকে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং অনুমোদিত হলে আপনার পাসপোর্টে ভিসা সিল মারবে।
ধাপ ৯: সৌদি আরবে যাত্রা
ভিসা ইস্যুর তারিখ থেকে সাধারণত ৩ মাসের মধ্যে দেশটিতে প্রবেশ করতে হবে।
ধাপ ১০: ইকামা (বাসস্থান পারমিট)
সৌদি পৌঁছানোর পর ৯০ দিনের মধ্যে নিয়োগকারী আপনার হয়ে ‘ইকামা’র জন্য আবেদন করবেন। ইকামা ছাড়া দেশটিতে কাজ করা অবৈধ।
ভিসার মেয়াদ ও নবায়ন
সাধারণত এই ভিসা এক বা দুই বছরের জন্য হয়। চুক্তি নবায়ন হলে নিয়োগকারী পুনরায় ভিসা নবায়ন করতে পারে এবং আপনাকে দেশ ছাড়তে হয় না।
পরিবারকে সৌদিতে নেওয়ার সুযোগ
ইকামা পাওয়ার পর আপনি আপনার স্ত্রী ও সন্তানদের ডিপেন্ডেন্ট ভিসায় সৌদিতে নেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন। এজন্য নিয়োগকারীর ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ (NOC) ও নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো পূরণ করতে হবে।
কাজের পরিবেশ
সৌদি আরবে বেতন করমুক্ত এবং সাধারণত প্রতিষ্ঠান থেকে বাসস্থান, যাতায়াত, চিকিৎসা ও বার্ষিক ছুটির সুবিধা দেওয়া হয়। এখানে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস, ওভারটাইম ভাতা, বাৎসরিক ছুটি (২১ দিন), রোগের ছুটি, সরকারি ছুটি এবং চাকরি শেষে সুবিধা রয়েছে।
যেসব খাতে বিদেশি কর্মী নেওয়া হয়:
- তেল ও গ্যাস
- নির্মাণ
- স্বাস্থ্যসেবা (চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান)
- শিক্ষা
- হসপিটালিটি ও পর্যটন
- তথ্যপ্রযুক্তি
- প্রকৌশল
- খুচরা ব্যবসা
- বিমান পরিবহন
চ্যালেঞ্জ যেগুলো আসতে পারে:
- ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া
- লিঙ্গভিত্তিক কিছু বিধিনিষেধ
- ভাষাগত সীমাবদ্ধতা (আরবি মূল ভাষা)
- কঠোর ভিসা নিয়মাবলি
- ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সীমিত হতে পারে
- তবে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকলে ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখালে এই চ্যালেঞ্জগুলোও অতিক্রম করা সম্ভব।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs):
১. সৌদি আরবে কাজ করার সময় চাকরি বদলানো যাবে?
হ্যাঁ, তবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়োগকারীর সম্মতি নিতে হবে এবং আইনি পদ্ধতিতে ট্রান্সফার করতে হবে।
২. কাজের ভিসা কি স্থায়ী?
না, এটি অস্থায়ী ব্যবসায়িক ভিসা, তবে চুক্তিভিত্তিক নবায়নযোগ্য।
৩. আরবি ভাষা জানা বাধ্যতামূলক?
সব ক্ষেত্রে না হলেও, আরবি জানা থাকলে কাজ ও জীবন অনেক সহজ হয়।
৪. ভিসা পেতে কত দিন লাগে?
সাধারণত ৭ থেকে ২১ কার্যদিবস সময় লাগে, ডকুমেন্টস ঠিক থাকলে।
৫. পরিবারকে নেওয়া যাবে?
হ্যাঁ, ইকামা পাওয়ার পর নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করে ডিপেন্ডেন্ট ভিসায় পরিবার আনা যায়।
৬. ভিসিট ভিসা থেকে ওয়ার্ক ভিসা হওয়া যাবে?
না, এটি সম্ভব নয়। ওয়ার্ক ভিসা নিজ দেশ থেকেই সঠিক প্রক্রিয়ায় আবেদন করতে হয়।
৭. ভিসা মেয়াদ শেষ হলে দেশে না ফিরলে কী হয়?
ভিসা মেয়াদ শেষে থাকলে জরিমানা, আটক, বহিষ্কার ও ভবিষ্যতে সৌদি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।
২০২৫ সালের সৌদি আরবের ওয়ার্ক ভিসা প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল মনে হলেও ধাপে ধাপে অনুসরণ করলে এটি খুবই বাস্তবসম্মত এবং সহজ। একটি বৈধ চাকরির অফার থাকলে এবং কাগজপত্র সঠিকভাবে প্রস্তুত করলে আপনি নিশ্চিন্তেই সৌদি আরবে কাজ শুরু করতে পারবেন।
মারিয়া