
ঘুড়ি একসময় গ্রামীণ জনপদে শিশুর হাতে রঙিন স্বপ্ন হয়ে আকাশে উড়ত। বাতাসে ভেসে বেড়াত দূরন্ত শৈশবের হাসি, বাঁধাহীন আনন্দ। কিন্তু প্রযুক্তির হাওয়ায় বদলে যাওয়া সময় এখন আর সেই ঘুড়ির দিকেই তেমন চোখ ফেরায় না। একদিন যাদের শৈশব ছিল আকাশজোড়া ঘুড়ির সঙ্গী, আজ তারা বিস্ময়ের চোখে দেখেন—নতুন প্রজন্ম জানেই না ঘুড়ি কী!
সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পিরোজপুর, ভোলা, নোয়াখালীসহ বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে একসময় গ্রীষ্মকাল এলেই শুরু হতো ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা। ছোটবেলা মানেই ছিল ছেলেমেয়েদের হাতে নাটাই, আকাশে চিল ঘুড়ি, সাপ ঘুড়ি কিংবা তেলেঙ্গা ঘুড়ির লড়াই। ধান কাটা শেষে মাঠ হয়ে উঠত ঘুড়ির রাজ্য। দুপুর গড়ালেই দক্ষিণা বাতাসে ভর করে শুরু হতো উড়ন্ত প্রতিযোগিতা। এখন সে দৃশ্য যেন শুধুই স্মৃতি।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কৈখালী, বংশীপুর, রমজাননগর, কাশিমাড়ি কিংবা গাবুরার মতো প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতেও এমন দৃশ্য ছিল খুবই সাধারণ। প্রবীণদের কণ্ঠে এখনও শোনা যায় ঘুড়ির সেই দিনগুলোর কথা। রমজাননগরের সোরা গ্রামের শুকুর আলী সরদার স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমরা সাপ ঘুড়ি, তেলেঙ্গা ঘুড়ি, পেটকাটা ঘুড়ি বানিয়ে আকাশে উড়াতাম। ধানের মাঠে দিনভর চলত প্রতিযোগিতা, কখনো ঘুড়ি কাটা নিয়ে দারুণ উত্তেজনা হতো। এখন তো এসব আর দেখা যায় না।”
শ্যামনগর উপজেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আলহাজ্ব আবু কাওছার বলেন, “গরমের দিনে আমরা মাঠে ঘুড়ি উড়াতে ছুটতাম। ঘুড়ির সঙ্গে বাঁধা ধনুক-আকৃতির সুতা বাতাসে এক মিষ্টি সুর তুলত। সন্ধ্যার আকাশেও যেন ঘুড়ি লুকিয়ে খেলত।” স্মৃতির পাতায় ঘুড়ির আভা এখনও উজ্জ্বল থাকলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
আজকের শিশুদের শৈশব বন্দি স্মার্টফোন, ট্যাব আর ভার্চুয়াল গেমে। মাঠে খেলাধুলা কিংবা ঘুড়ি ওড়ানোর মতো সময়ই নেই। শহরের মতোই গ্রামেও এখন আর আগের সেই আকাশভরা রঙিন দৃশ্য চোখে পড়ে না। এমনকি অনেকে ঘুড়ির নামটাই জানে না।
ঘুড়ির আরেক প্রেমিক আবুল কালাম বলেন, “আমরা শৈশবে ঘুড়ির পেছনে ছুটতাম—বৃষ্টির ফোঁটা এড়িয়ে, বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এখনকার শিশুদের আগ্রহ নেই, পরিবেশ নেই। অথচ ঘুড়ি শুধু খেলা নয়, এটা ছিল আবেগ, ছিল শিকড় ছোঁয়ার এক আনন্দময় মাধ্যম।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল বিনোদন নয়—ঘুড়ি ওড়ানো শিশুদের কল্পনাশক্তি, মনোসংযোগ এবং সৃজনশীলতা বাড়াত। ঘুড়ি তৈরি থেকে শুরু করে উড়ানোর কৌশল শেখা ছিল এক ধরনের জীবন-শিক্ষা।
তবে এখনও সব আশা শেষ হয়ে যায়নি। দেশের কিছু অঞ্চলে, বিশেষ করে পৌষ সংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখে কিছু এলাকায় ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন হয়। চাইলে এই আয়োজনগুলো আরও বিস্তৃত করা যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজন হতে পারে বার্ষিক ঘুড়ি উৎসব, যেখান থেকে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে বাংলার হারিয়ে যাওয়া রঙিন ঐতিহ্য।
এখন সময় এসেছে ‘ঘুড়ি’ শব্দটিকে শুধুই বইয়ের পাতায় বন্দি না রেখে ফিরিয়ে আনা বাস্তবের আকাশে।
আবারও রঙে রঙিন হোক সাতক্ষীরার বিকেলের আকাশ, আবারও প্রতিধ্বনিত হোক নাটাইয়ের টান আর দূরন্ত শৈশবের হাসি।
সানজানা