
ছবি: সংগৃহীত
প্রায় দুই সপ্তাহের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর ইরান ও ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধে সম্মত হয়েছে। যদিও আনুষ্ঠানিক কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়নি, তবে উভয় পক্ষই সাময়িকভাবে হামলা বন্ধ রাখতে রাজি হয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়্যেদ আব্বাস আরাঘচি জানিয়েছেন, ইসরায়েল যদি নতুন করে আগ্রাসন চালায়, তবে তেহরানও আবার প্রতিরোধে যাবে।
এই ১২ দিনের সংঘাতে পরিস্থিতি একেবারে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইসরায়েলকে সহায়তা দিতে গিয়ে ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন একদিকে তেহরানের ১ কোটি বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানায়, ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যার হুমকি দেয় এবং ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর ডাক দেয়, আবার অন্যদিকে বলেন, তাঁর ইরানি সরকারের বিরুদ্ধে কিছু নেই এবং তিনি চান "আল্লাহ ইরানকে আশীর্বাদ করুন।"
১৩ জুন ভোরে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায়, তেহরানের আবাসিক এলাকা, পারমাণবিক কেন্দ্র (নাতাঞ্জ, ইসফাহান), ও সামরিক ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করে। একই দিনে ইরানের শীর্ষ জেনারেল ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যাও করা হয়। ইরান পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় সেদিন রাতেই অধিকৃত অঞ্চলে ২২ দফা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। যুদ্ধের শেষ হামলা চালানো হয় ২৪ জুন, যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার কয়েক মিনিট আগে।
তাদের দাবি ছিল, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর পথে এগোচ্ছে। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এর উল্টো তথ্য ছিল—ইরান তেমন কোনো পরিকল্পনায় নেই। এমনকি যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (IAEA) জানায়, তারা কখনও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে সামরিক উদ্দেশ্যের প্রমাণ পায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এই হামলার আসল লক্ষ্য ছিল ‘রেজিম চেঞ্জ’, অর্থাৎ ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে সরিয়ে দেওয়া।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল তাদের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ইরান তার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম আগেই নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয় এবং অধিকাংশ ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনা অক্ষত রয়েছে। বরং আক্রমণের কারণে ইরানের জনগণ আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির পেছনে দাঁড়ায়। ফলে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের একমাত্র অর্জন ছিল ইরানে ৬০০-এর বেশি প্রাণহানি ও কিছু স্থাপনার ক্ষতি।
১২ দিন ধরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনে ইসরায়েলের তেল আবিব, হাইফা, বেয়ার শেভা শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সামরিক ঘাঁটি ও গোয়েন্দা কেন্দ্রগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। বিপুল সংখ্যক ইসরায়েলি নাগরিক দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করে, অনেকে চোরাইপথে সাইপ্রাস বা মিশরের সীমানা পেরিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমায়। হিব্রু গণমাধ্যম অনুযায়ী, এই ১২ দিনে ইসরায়েলের আর্থিক ক্ষতি গাজা, লেবানন ও সিরিয়ায় ২০ মাসের যুদ্ধের ক্ষতির সমান।
যুক্তরাষ্ট্রও এই যুদ্ধে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা পড়ে ৪১%-এ নেমে এসেছে। বিশেষ করে যাঁরা ইউক্রেন ও গাজার যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি শুনে তাকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরা হতাশ। তাছাড়া, কাতারে অবস্থিত আল-উদেইদ ঘাঁটিতে ইরানের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘অস্পৃশ্য’ সামরিক ঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়—যা ২০২০ সালে ইরাকে আল-আসাদ ঘাঁটির পর আবারও বড় ধাক্কা।
যুদ্ধের মধ্যে ইরান তার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ জেনারেল, বিজ্ঞানী ও বেসামরিক নাগরিক হারিয়েছে। তবে তাদের সামগ্রিক অবকাঠামো এবং প্রতিরোধ শক্তি অক্ষুণ্ন থেকেছে। বরং এই যুদ্ধ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে, দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মোকাবেলায় ইরান কতটা প্রস্তুত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই যুদ্ধে ইরান তার রাজনৈতিক ঐক্য পুনর্গঠন করেছে এবং ভবিষ্যতে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আরও শক্ত অবস্থান নিতে পারে।
যুদ্ধ এখন থেমে গেলেও পরিস্থিতি নাজুক। অতীতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার যুদ্ধবিরতির শর্ত ভেঙেছে। ইরান জানিয়েছে, তারা সতর্ক রয়েছে এবং প্রয়োজনে আবার যুদ্ধ শুরু করতে প্রস্তুত। এমনকি তাদের হাতে আরও পাল্টা আঘাতের প্রস্তুতি রয়েছে, যা এখনো ব্যবহার করা হয়নি।
শিহাব