ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

পারস্যের রক্তে ভয় নেই: ইরানের জবাব ইতিহাস লিখল নতুনভাবে

রুমান হাসান তামিম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ২০:২৩, ২৫ জুন ২০২৫

পারস্যের রক্তে ভয় নেই: ইরানের জবাব ইতিহাস লিখল নতুনভাবে

ছবি: সংগৃহীত

ইরান—যার মাটিতে যুগে যুগে উঠে এসেছে সভ্যতা, সংস্কৃতি আর স্বাধীনতার দীপ্ত গল্প। প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী এই দেশটি শুধু ভূগোল বা রাজনীতির কারণে নয়, বরং আত্মমর্যাদা, আত্মত্যাগ ও জাতীয় চেতনার কারণে আজও বিশ্ব দরবারে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

সম্প্রীতি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ হামলার জবাবে ইরান যে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে। এটি কেবল একটি সামরিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং পারসীয় ঐতিহ্যে গড়া “মর্যাদার জন্য জীবন উৎসর্গ” দর্শনের বাস্তব প্রতিফলন।

"মরলে মরবো, কিন্তু সম্মানে এক চুলও ছাড়বো না”—এই নীতিতে যেন ইরানের রাষ্ট্রনীতি ও জাতীয় মনস্তত্ত্ব গড়ে উঠেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনো দেশ এত প্রকাশ্যে মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। ইরান শুধু দাঁড়ায়নি—ঘুষি মেরেছে।

পারস্যের ঐতিহাসিক আত্মপরিচয় ও প্রতিরোধ:

ইরানের ইতিহাস কেবল রাজা-বাদশাহদের নয়; এটি একটি জাতির চেতনার ধারাবাহিকতা। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০ সালে সাইরাস দ্য গ্রেটের অধীনে গড়ে ওঠা পারস্য সাম্রাজ্য তখনকার বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্য ছিল, যেখানে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, ন্যায়বিচার ও সাংস্কৃতিক বিকাশের নজির স্থাপন করা হয়।

ইরানিদের মধ্যে এই গৌরববোধ শুধু পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ নয়—এটি তাদের জাতীয় পরিচয়ে রক্তের মতো প্রবাহিত। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব ছিল এই ঐতিহ্যের নবজাগরণ, যেখানে সাধারণ মানুষ শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির পশ্চিমপন্থি শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র।

এই বিপ্লব কেবল ক্ষমতা বদলের গল্প ছিল না। এটি ছিল বিদেশি প্রভাব থেকে মুক্তির দাবি। সেই শেকড়ের আত্মবিশ্বাস থেকেই আজকের ইরান তার জাতীয় নিরাপত্তা, পারমাণবিক কর্মসূচি এবং রাজনৈতিক অবস্থানে কোনো আপোষ করে না।

২০২৫ সালের সংঘাত: যুদ্ধ না, এক ঐতিহাসিক বার্তা!

২০২৫ সালের ২১ জুন রাতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে ইরানের নাতানজ, ইসফাহান ও ফোর্ডোতে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায়, যেগুলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির মূল কেন্দ্র। ধারণা করা হয়, এতে অন্তত ৪৩০ জন ইরানি বিজ্ঞানী, সেনা সদস্য ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হন এবং প্রায় ৩,৫০০ জন আহত হন। কিন্তু ইরানের জবাব আসে আরও কঠিন ও প্রতিক্রিয়াশীল। তারা হরমুজ প্রণালি হয়ে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ও ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ১৫০+ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।

এই ‘মাল্টি-ফ্রন্ট অ্যাটাক’ ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র জোটকে হতবাক করেছে। বিশ্বের বেশিরভাগ বিশ্লেষকই এই প্রতিক্রিয়াকে ‘প্রতীকী বিজয়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ইরানের পক্ষে।

যুদ্ধবিরতি ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি:

চরম উত্তেজনা ও মানবিক বিপর্যয়ের কারণে ২৪ জুন জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ইরান ও ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এই বিরতি সাময়িক হলেও এটি বিশ্বকে দেখিয়েছে, কূটনৈতিক চাপ ও আন্তর্জাতিক ঐক্যের গুরুত্ব কতটা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে রাশিয়া ও চীন, ইরানের প্রতিরোধকে সমর্থন জানায় এবং মার্কিন-ইসরায়েলি পদক্ষেপের সমালোচনা করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করার আহ্বান জানায়। 

ইরানের বিজয়: হার নয়, আত্মসম্মানের জয়

যুদ্ধবিরতির মধ্যেও স্পষ্ট, ইরান শুধু সামরিকভাবে নয়, মনস্তাত্ত্বিক ও কূটনৈতিক ময়দানেও বড় বার্তা দিয়েছে। তারা দেখিয়েছে, মাত্রাতিরিক্ত আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায়। ইরান ‘হারেনি’। তাদের জন্য বিজয় মানে ছিল স্বাধীনতা ও সম্মানের পুনর্দখল। পারস্যের রক্তে লেখা এই ইতিহাস এখনো নতুন প্রজন্মের জন্য প্রেরণা।
একটি জাতি যারা সম্মানের শপথ নিয়ে দাঁড়িয়েছে — তারা মাথা নত করে না।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ:

যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির পরও ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখে এবং ইরানের ওপর চাপ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। রাশিয়া ও চীন ইরানের আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা বলছে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিবেশী দেশগুলো নিরাপত্তা জোরদার করেছে এবং সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়েছে। বাংলাদেশ সহ আমদানি নির্ভর দেশগুলো তেলের দাম কমায় কিছু স্বস্তি পেয়েছে, যদিও ভবিষ্যতে উত্তেজনা আবার বাড়তে পারে বলে সতর্কতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া The Guardian, Al Jazeera, Russia Today সহ অনেক সংবাদমাধ্যম ইরানের জবাবি হামলাকে “আত্মরক্ষার অধিকার” হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে।

মানবিক প্রভাব: কাঁদছে মানুষ, থেমে গেছে জীবন

মধ্যপ্রাচ্য এক বিস্ফোরক ভূখণ্ড—যেখানে প্রতিটি সামরিক উত্তেজনার মূল্য দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। এই যুদ্ধের ফলে ইরানে হাসপাতালগুলো উপচে পড়ছে আহতদের ভিড়ে। পানীয় জলের সংকট, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা এবং খাদ্য সংকটে মানুষ দিশেহারা।

ইসরায়েলেও ক্ষয়ক্ষতি কম নয়। দক্ষিণাঞ্চলের বহু বাসিন্দা আশ্রয়কেন্দ্রে রাত কাটাচ্ছেন। শিশুদের মধ্যে মানসিক ট্রমা বাড়ছে। যুদ্ধের শব্দ, আশ্রয়হীনতা ও নিরাপত্তাহীনতা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও জর্জরিত করে তুলছে।

একটি জাতির মনস্তত্ত্ব: আত্মত্যাগ বনাম আধিপত্য

ইরানের এই সাহসিকতা নিছক জবাবি প্রতিক্রিয়া নয়—এটি তাদের রাষ্ট্রীয় মনোবল, রাজনৈতিক নীতি ও সাংস্কৃতিক শিকড় থেকে উঠে আসা প্রতিরোধ। পারস্যের রক্তে ভয়ের কোনো স্থান নেই—এই সত্য ইতিহাসকে নতুনভাবে লিখতে বাধ্য করেছে। তারা বিশ্বাস করে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে হলেও মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়। এই মনোভাব আজকের বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। আধিপত্যবাদী নীতির পরিবর্তে যদি সম্মানের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাহলে হয়তো এই সংঘাতের প্রয়োজন হতো না।

যুদ্ধবিরতির এই সময়টাই যেন হয় বাস্তব শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত, যুদ্ধ নয়, কূটনীতি ও সমঝোতার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।

Mily

×