
ছবি: সংগৃহীত।
১৯৭৬ সালের এক শীতল নভেম্বর রাত। ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের মেওয়াট অঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম উত্তাওয়ারে তখন আতঙ্ক আর অস্থিরতা। গ্রামের পুরুষরা কেউ পালিয়ে যাচ্ছেন জঙ্গলে, কেউ আশপাশের গ্রামে, কেউ আবার লুকিয়ে পড়ছেন কুয়োর ভেতর। কিন্তু মোহাম্মদ দীনু ছিলেন স্থির—তাঁর মনে চলছিল অন্য এক যুদ্ধ। রাজধানী দিল্লি থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামের চারদিক তখন ঘিরে রেখেছে পুলিশ। তাদের নির্দেশ, সব প্রজননক্ষম পুরুষকে মাঠে হাজির করতে হবে—একটি ভয়ংকর কর্মসূচির জন্য।
সময়টা ছিল ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ও অন্ধকার সময়—প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষিত জাতীয় জরুরি অবস্থা। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন থেকে শুরু হওয়া এই জরুরি অবস্থায় ১৭ মাস ধরে দেশের নাগরিক অধিকার প্রায় সম্পূর্ণভাবে স্থগিত ছিল। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার, গণমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং বিচারহীন দমন-পীড়নের পাশাপাশি চালু হয় ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ‘জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ কর্মসূচি’—যা বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় পরিচালিত হয়।
জরুরি অবস্থার সময়, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালের মার্চ পর্যন্ত, জোরপূর্বক প্রায় ৮০ লাখ পুরুষকে ভ্যাসেক্টমি বা বন্ধ্যাকরণ করানো হয়। কেবল ১৯৭৬ সালেই সংখ্যাটি ছিল ৬০ লাখ। অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও অব্যবস্থাপনার কারণে প্রায় ২ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন।
গ্রামের একজন প্রবীণ বাসিন্দা মোহাম্মদ দীনু, যিনি এখন ৯০ বছর বয়সী, সেই সময়ের ভুক্তভোগীদের একজন। পুলিশ তাঁকে ও আরও ১৪ জন বন্ধুকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায় বন্ধ্যাকরণ শিবিরে। দীনু আজও মনে করেন, “আমাদের ত্যাগেই গ্রাম বেঁচে গেছে। এখন চারদিকে শুধু শিশুর হাসি আর কোলাহল।”
জরুরি অবস্থার সময় সরকার প্রশাসনের ওপর কোটা পূরণের চাপ দেয়। কোটা না পূরণ করলে কর্মচারীদের বেতন বন্ধ করে দেওয়া হতো, এমনকি সেচ ও পানির সংযোগ কেটে দেওয়া হতো। যারা এই কর্মসূচির বিরুদ্ধে কথা বলতেন, তাঁদের ওপর চালানো হতো হামলা, গ্রেফতার ও নির্যাতন।
বিশেষত মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো ছিল এই অভিযানগুলোর লক্ষ্যবস্তু। উত্তর ভারতের উত্তাওয়ার গ্রামের বাসিন্দারা আজও স্মরণ করেন সেই রাতকে ‘ভয়ের রাত’ নামে। গ্রামপ্রধান আব্দুর রহমান কর্তৃপক্ষের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, “আমি আমার এলাকা থেকে একটা কুকুরও দেব না, আর তোমরা মানুষের দাবি করছ!”
বন্ধ্যাকরণের ঘটনায় অনেকের জীবন সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে। অনেক পরিবারে বিয়ের বাগদান বাতিল হয়ে যায়। এমনকি যাঁরা বন্ধ্যাকৃত হননি, তাঁদের ওপরও পড়ে সামাজিক অপমানের ছায়া। স্থানীয় সমাজকর্মী কাসিম বলেন, “অনেকে আজও মানসিকভাবে সেই আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেননি।”
ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিত হলেও, জরুরি অবস্থার সময় এবং বর্তমানেও অনেক বিশেষজ্ঞ এই দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সমাজবিজ্ঞানী শিব বিশ্বনাথন বলেন, “জরুরি অবস্থা ছিল ভারতের কর্তৃত্ববাদের সূচনা। আজকের অনেক ‘জরুরি অবস্থা’র বীজ রোপিত হয়েছিল তখনই।”
বিশ্বনাথনের মতে, ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পর্যন্ত, সবাই কোনো না কোনোভাবে গণতন্ত্রের আবরণে কর্তৃত্ববাদ চাপিয়ে দিয়েছেন। মোদীর সময় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিরোধী রাজনীতির অবস্থা এবং বাকস্বাধীনতার ওপর আঘাত—সবকিছু মিলিয়ে জরুরি অবস্থার ছায়া যেন আবার ফিরে এসেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিম আলী বলেন, “জরুরি অবস্থার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—কোনো শক্তিশালী নেতৃত্ব চাইলে কীভাবে একটি দেশের সংবিধানকে ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি প্রমাণ করে, সাধারণ মানুষ যদি জেগে ওঠে, তবে সেই কর্তৃত্ববাদও ধসে যেতে পারে।”
১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর কংগ্রেস পার্টি বিপর্যয়করভাবে পরাজিত হন। বিরোধীরা তাঁদের প্রচারে জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণকে বড় ইস্যু হিসেবে তুলে ধরে জনগণের সমর্থন আদায় করে নেয়।
দীনু বলেন, ‘আমার চোখে আজও সেই রাত ভাসে—যখন স্ত্রী সালিমা ছিলেন গর্ভবতী আর আমি পুলিশের ভ্যানে বসে আছি।’ অপারেশনের ঠিক এক মাস পর তাঁর সন্তানের জন্ম হয়। আজ তাঁর নাতি-প্রপৌত্রদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, “আমি আমার ঠাকুরদার সঙ্গে খেলেছি, এখন প্রপৌত্রদের সঙ্গে খেলছি। সাত পুরুষ! এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়?”
সায়মা ইসলাম