ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

বাংলা ভাষার বানান পরিবর্তন কতটা প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 বাংলা ভাষার বানান পরিবর্তন কতটা প্রয়োজন

সম্প্রতি বাংলা ভাষার বানান পরিবর্তনে একটি বিশেষ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। প্রচলিত, প্রতিষ্ঠিত এবং শুদ্ধ বানানটিকেও পরিবর্তন করে ভিন্ন রূপ দেয়া হচ্ছে। যেমন, শ্রেণীকে শ্রেণি, কাহিনীকে কাহিনি, সুধীকে সুধি, গোষ্ঠীকে গোষ্ঠি, পদবীকে পদবি, শহীদকে শহিদ, আরবীকে আরবি লেখা হচ্ছে। এ পরিবর্তন করা হচ্ছে সমতার নামে। বাংলা ভাষায় হ্রস্ব ই-কার ()ি) এবং দীর্ঘ ঈ-কার (ী) নামে দুটি ধ্বনি-প্রতীক আছে। এই ধ্বনি-প্রতীক দুটি এসেছে বৈদিক-সংস্কৃতের হ্রস্ব-ই ও দীর্ঘ- ঈ ধ্বনি থেকে। বাংলাসহ ভারতের প্রায় সব নব্য ভারতীয় আর্যভাষা এই ধ্বনি দুটিকে গ্রহণ করেছে। এর দ্বারা অসংখ্য শব্দ তৈরি হয়েছে এবং তাদের মধ্যে অর্থগত পার্থক্যও রয়েছে। তাছাড়া বাংলাসহ প্রায় সব আধুনিক ভাষায় ঈ-কারকে স্ত্রী প্রত্যয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রত্যয়টি দিয়ে পুংলিঙ্গ শব্দকে স্ত্রীলিঙ্গ করা হয়। যেমন, জনক-জননী, নদ-নদী. মানব-মানবী, নর্তক-নর্তকী, পতি-পত্নী, গুণবান-গুণবতী, রূপবান-রূপবতী, বুদ্ধিমান-বুদ্ধিমতী, বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী ইত্যাদি। বাংলা ভাষার সন্ধির ক্ষেত্রেও ঈ-কার প্রয়োজন। যেমন, রবি+ইন্দ্র= রবীন্দ্র, কবি+ইন্দ্র=কবীন্দ্র, পরি+ঈক্ষা= পরীক্ষা ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় ঈ-কার দিয়ে অসংখ্য শব্দ লিখিত আছে। যেমন, জ্ঞানী, গুণী, ধনী, মানী, বিনয়ী, গৃহী, ক্রোধী, ত্যাগী, সুখী, দুঃখী, পাপী, তাপী, ভোগী, রোগী, লোভী, শরীরী, বিদেশিনী, কামিনী, বিনোদিনী, দুঃখিনী, মায়াবিনী, করণীয়, বরণীয়, জাতীয়, ধর্মীয়, পূজনীয়, আত্মীয়, পালনীয়, শাস্ত্রীয়, পঠনীয়, লোভনীয়, জীবন, স্বাধীনতা, স্বীকৃত, রীতি-নীতি, সীমা, গভীর, পৃথিবী ইত্যাদি। সুতরাং ঈ-কারকে তো আমরা বাদ দিতে পারছি না। ঈ-কারকে যখন বাদ দেয়া যাচ্ছে না তখন সমতার তো প্রশ্ন আসছে না। বলা হচ্ছে, বিদেশী, দেশী এবং তদ্ভব শব্দে ই-কার দিতে হবে। সেই নিয়ম পালন করতে গিয়ে এখন আমরা আরবীকে আরবি, শহীদকে শহিদ, লাইব্রেরীকে লাইব্রেরি, সরকারীকে সরকারি লিখছি। ঈ-কার ব্যঞ্জন বর্ণের পরে বসে। কিন্তু ই-কার পূর্বে বসে। শব্দের উচ্চারণে ব্যঞ্জন বর্ণের সঙ্গে যুক্ত স্বরবর্ণটির উচ্চারণ পরেই হয়ে থাকে। যেমন, ‘নীতি’ শব্দটির বর্ণ যথাক্রমে ন্ + ঈ + ত্ + ই। এখানে ই-কার পরে উচ্চারিত হয়েছে, কিন্তু বসেছে পূর্বে। বাংলা ভাষায় অ-কার, আ-কার এবং ঈ-কার ব্যঞ্জন বর্ণের পরে বসে; ই-কার, এ-কার এবং ঐ-কার পূর্বে বসে। উ-কার, ঊ-কার এবং ঋ-কার ব্যঞ্জনের নিচে বসে। ও-কার এবং ঔ-কার পূর্বে এবং পরে উভয় স্থানে বসে। এসব বর্ণের ‘কার’ চিহ্নগুলোকে (া ি ী প্রভৃতি) যথাসম্ভব ব্যঞ্জনবর্ণের শেষে লিখতে পারলে উচ্চারণ সাম্যতা থাকে। কোন কোন বানান সংস্কারক কারগুলোকে কীভাবে বর্ণের শেষে লেখা যায় সে প্রস্তাবও করেছেন। বাংলা ভাষায় ও-কার এবং ঔ-কার বর্ণের উভয় পাশে লেখা হয়। সংস্কৃতে এবং হিন্দীতে কার দুটি বর্ণের পরে লেখা হয়। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও আমরা সেটা গ্রহণ করতে পারি। সুতরাং সমতার দোহাই দিয়ে ঈ-কারকে যথেচ্ছভাবে ই-কার করা উচিত হবে না। আমরা একবার লিখব সহকারী, আরেকবার লিখব সরকারি। এতে ছোট ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে বানান বিভ্রাট মনে হবে। তাছাড়া এতদিন তো আমরা ঈ-কার দিয়েই লিখে এসেছি। হঠাৎ তা পরিবর্তন করার কী এমন প্রয়োজন দেখা দিল তা বোধগম্য নয়। ঈ-কারের পরিবর্তে ই-কার দিয়ে লিখলে অনেক ক্ষেত্রে শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে। যেমন, শহীদ শব্দের অর্থ দেশের জন্য বা ভাল কাজের জন্য আত্মদানকারী ব্যক্তি। আর শহিদ শব্দের অর্থ সাক্ষী। আরবী ভাষায় এরূপ অনেক শব্দ আছে যেখানে ঈ-কার স্থানে ই-কার দিলে অর্থের পরিবর্তন ঘটে। বাংলা একাডেমির বানান রীতি অনুযায়ী ঈদ-কে ইদ লিখতে হবে এবং শহীদকে শহিদ লিখতে হবে। সে নিয়ম চালু করা হয়েছিল। কিন্তু জনমতের চাপে সেটা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি কেউ কেউ ‘সুধী’ শব্দটিকেও ই-কার দিয়ে লেখার কথা বলছেন এবং লিখছেনও। শব্দটি তৎসম বা সংস্কৃত। সু+ধী= সুধী। সুধী শব্দের অর্থ পন্ডিত বা জ্ঞানী ব্যক্তি। সংস্কৃতে ই-কারান্ত সুধি শব্দ ক্লীবলিঙ্গ। এখন কেউ যদি আমন্ত্রণপত্রে ‘সুধি’-রূপে সম্বোধন করেন তাহলে তিনি তো ক্লীব হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। তাছাড়া এতদিন তো আমরা ঐ শব্দটিকে সুধী-রূপেই লিখে এসেছি এবং তা শুদ্ধ। তাহলে হঠাৎ করে সুধি লেখার এমন কী প্রয়োজন পড়ল, বুঝি না। প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত শব্দকে পরিবর্তন করে লিখলে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। ছেলেমেয়েরা বানান সংস্কারকদের বানান শিখে যখন বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, মীর মোর্শাফ, কায়কোবাদ প্রভৃতির বই পড়বে তখন তারা অন্য প্রকার বানান দেখে বিভ্রান্ত হবে। প্রতিষ্ঠিত এবং সুপ্রচলিত শব্দটি যদি ব্যাকরণগতভাবে ভুলও হয় তাহলেও তাকে বাদ দেয়া হয় না। সংস্কৃত বৈয়াকরণদের সুনিয়ন্ত্রিত ভাষায়ও তা দেখা যায়। যেমন, সিংহ, পতঞ্জলি, কুলটা, মনীষা, সীমন্ত প্রভৃতি শব্দ ব্যাকরণগতভাবে ভুল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংস্কৃত বৈয়াকরণেরা তা ত্যাগ করেননি- শিষ্টজনেরা তা ব্যবহার করেছেন বলে। বাঙালী শব্দে কেন আমরা ঈ-কার দেব সে সম্পর্কে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর ‘বাংলা বানানে অন্যায় হস্তক্ষেপ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন।১১ ‘নতুন দিগন্ত, প্রথম বর্ষ, ২য় সংখ্যায় (মার্চ, ২০০৩), পৃ. ৩৫-৪০। প্রবন্ধটি অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ ও যুক্তিনির্ভর। কিন্তু সংস্কারবাদীরা তাঁর যুক্তি এবং আবেদন গ্রহণ করেননি। শ্রদ্ধেয় চৌধুরী বলেন, “বাঙালী বানান আমি কিছুতেই ‘’ি দিয়ে লিখতে রাজি নই। দুই কারণে। প্রথমত ‘বাঙালী’ সব সময়েই ‘ী’যুক্ত ছিল। ওভাবে এতকাল লিখে এসেছি, আমার বাবা লিখেছেন, তাঁর বাবাও লিখেছেন। ওই বানান ইতিহাস নয় কেবল, আমাদের ঐতিহ্যও। আজ হঠাৎ ‘ী’-কার বর্জন করে ওই ঐতিহ্যকে খর্ব করব, তাও বিনা কারণে, এ ঘটনা আমার কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।”২২ তদেব, পৃ. ৩৪। বাঙালী কথাটি এসেছে বঙ্গ শব্দ থেকে। বঙ্গালহ্, বাঙ্গাল, বঙ্গাল, বাঙ্গালী, বাঙালী এবং বাঙালি কথাগুলো বাংলা বঙ্গ শব্দেরই রকমফের। আমরা বাংলাদেশীরা ‘বাঙ্গালী’ই উচ্চারণ করি। পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয়রা গ উচ্চারণ করেন না। তাদের উচ্চারণ অনুসারে বাঙ্গালী হয়ে গেল বাঙালী। এখন আমরা অনেকে লিখছি বাঙালি। শব্দটি ইংরেজীতে লিখলে গ-কারই আসে। তাই অহেতুক শব্দের বানান ব্যক্তিবিশেষের মর্জি অনুসারে পরিবর্তন করা উচিত নয়। প্রতিষ্ঠিত শব্দে ঈ-কারের পরিবর্তে ই-কার লেখার প্রবণতা চালু হওয়ার কারণে এখন দেখা যায় অনেক ছেলেমেয়ে পরীক্ষার খাতায় রবীন্দ্রনাথকে রবিন্দ্র নাথ লেখা শুরু করেছে। আমরা বানান সংস্কারের বিরোধিতা করি না। কিন্তু যে বানানটি সাহিত্যে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তার পরিবর্তন করার কোন প্রয়োজন দেখি না। যে যুক্ত অক্ষরটি দ্রুততার সঙ্গে লেখা যায় এবং সৌন্দর্যম-িত তাও ভাঙ্গার দরকার আছে বলে মনে হয় না। শিশুদের জন্য অক্ষরের স্বচ্ছতার প্রয়োজন আছে সত্য, কিন্তু শিশুটি তো আর চিরকাল শিশু থাকবে না। সে বড় হবে, তার বোধশক্তি বাড়বে, সে বৈচিত্র্যের সন্ধানী হবে। প্রচলিত যুক্তাক্ষর তখন তার কাছে কোন সমস্যাই হবে না। যেমন হয়নি আপনার, আমার এবং অন্য সকলের। কেউ কেউ বলেন, বাংলা ভাষায় ঈ-কারের উচ্চারণ নেই। কিন্তু কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। কবিরা ঈ-কারকে ত্যাগ করবেন কীভাবে? তাঁরা লেখেন “সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ/ বিকেলের নক্ষত্রের কাছে” অথবা “স্পেন থেকে চীন প্রদেশে বিলীন/ অথচ তাদের চিনি”। যাঁরা কবিতা পড়েন তাঁরা ‘দ্বীপ’, ‘চীন’, ‘বিলীন’ প্রভৃতি শব্দে জোর না দিয়ে পারবেন না। সেক্ষেত্রে ওসব শব্দে ঈ-কার দেয়া কি প্রয়োজন নয়? তাছাড়া দিন/দীন, চির/চীর, কৃতি/কৃতী, বিনা/বীণা, গিরিশ/গিরীশ, বিজন/বীজন প্রভৃতি শব্দের পার্থক্য টানা হবে কীভাবে? ণ, ষ এবং স-এর ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। ওগুলোকে বাদ দিলে বাংলা ভাষা থেকে শত শত শব্দ ঝরে পড়বে। বলা হয় তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে বানান ঠিক থাকবে। কিন্তু বানান পরিবর্তনের মায়াজালে পড়ে অনেকে তৎসম শব্দেও ই-কার দিয়ে লিখছেন। শ্রেণী ও পদবী দুটিই তৎসম শব্দ। সংস্কৃতে শব্দটি বিকল্পে ই-কার দিয়েও লেখা হয়। যেহেতু শ্রেণী এবং পদবী সুপ্রচলিত, তাই শব্দ দুটিকে শ্রেণি এবং পদবি বানানে না লিখলেও চলে। কিন্তু অনেকে এখন শ্রেণী এবং পদবী বানানকে ভুল বলে থাকেন সংস্কারকদের প্ররোচনায়। অশোক মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা বানান অভিধানে’ লিখেছেন, “সংস্কৃত অর্থাৎ তৎসম শব্দের বিকল্প বানান রাখা হল। অন্তরিক্ষ, অন্তরীক্ষ। যুবতী, যুবতি। শ্রেণি, শ্রেণী। পরিবেশন, পরিবেষণ। শান, শাণ। সাহিত্য সংসদের রীতিতে প্রথমে-দেয়া বানানটি লেখাই সমীচীন। লিখতে চাই অন্তরিক্ষ, যুবতী, শ্রেণি, পরিবেশন। যুবতী, পরীক্ষিৎ, পরিক্ষিৎ, কোষ, কোশ- এইসব বিকল্পের প্রথম দু-টিতে ঈ-কার, পরে ষ-এর বিকল্পকে প্রাধান্য দেয়ার কারণ প্রচলনকে মান্য করা এবং সমতা রক্ষা। আবার ছন্দবতী, গর্ভবতী, দৃগ¦তী, লজ্জাবতী, যৌবনবতী- সবগুলোতেই ‘তী’। তবে এটাও ঠিক লজ্জাবতীর ‘বতী’ এবং যুবতীর ‘বতী’ এক জিনিস নয়। কিন্তু যুবতী বানানকে অগ্রাধিকার দিলে একটা নিয়মে দাঁড়ানো যায়। সেটি হল, ‘বতী’-অন্ত সব স্ত্রীলিঙ্গ শব্দেই ‘তী’। কেউ যুবতি লিখতেই পারেন, তবে আশা করা যায় একই রচনায় তিনি সর্বত্রই একই রকমভাবে লিখবেন। পরীক্ষিৎ-এ ঈ-কারকে প্রথম বানান হিসেবে দেখানোর কারণও একই।। ‘পরীক্ষক’, ‘পরীক্ষণ’, ‘পরীক্ষাগার’- সব বানানে রী’। ‘পরিক্ষিৎ’ না লিখে ‘পরীক্ষিৎ’ লিখলে বানান ভুল হবে না, বরং শেখাটা সহজ হবে।”৩৩ অশোক মুখোপাধ্যায়, বাংলা বানান অভিধান, কলকাতা, সাহিত্য সংসদ, ১৯৯৮, তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকাংশ। শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায়ের মতানুসারে ‘পরিক্ষিৎ’ না লিখে যদি ‘পরীক্ষিৎ’ই লিখি, ‘যুবতি’ না লিখে যদি ‘যুবতী’ লিখি এবং পরীক্ষক, পরীক্ষণ, পরীক্ষাগার লিখি তাহলে অন্তরীক্ষের পরিবর্তে তিনি অন্তরিক্ষ লেখার কথা কেন বললেন তা বোধগম্য নয়। কারণ, অন্তরীক্ষ বানানটি প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত। শ্রেণী বানানটিও তাই। সুতরাং অহেতুক প্রতিষ্ঠিত বানানকে পরিবর্তন করে ভাষায় নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রয়োজন দেখি না। বানানের ক্ষেত্রে ইদানীং আরও একটি যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা হল শব্দের অন্ত্য অ-কারকে ও-কার ( ে া) দিয়ে লেখা। যেমন, কোনো, ছোটো, বড়ো, ভালো, মন্দো, হতো, যতো, কতো, খেয়েছো, পেয়েছো, গিয়েছো, করেছো, খেয়েছো, ধরেছো, লিখেছো, এগারো, বারো, তেরো, ষোলো ইত্যাদি। এভাবে লিখলে শব্দে একটি বাড়তি ও-কার যোগ করতে হবে। উচ্চারণ অনুসারে যদি বানান লিখতে হয় তাহলে শত শত শব্দে এ নিয়ম প্রযোজ্য করতে হবে। কিন্তু সেটি অসম্ভব। যেমন, এক-এ্যাক, তের-ত্যারো, পঁচিশ-পোঁচিশ, বত্রিশ-বোত্রিশ, ছত্রিশ-ছোত্রিশ, অতি-ওতি, করি-কোরি, এত-এ্যাতো, কেন-ক্যানো, সত্য-সোত্ত বা শোত্ত, প’রত-পোরতো, ধরত- ধোরতো, করত-কোরতো ইত্যাদি। ‘কোন’ শব্দটিতে কোনো লেখা কি খুবই জরুরী? এতে অনাবশ্যকভাবে শব্দটিতে একটি ও-কার যুক্ত হচ্ছে। তাতে লেখা এবং টাইপের সময় বাড়ছে। ইংরেজি ভাষায় A(a) উচ্চারিত হয় চারভাবে- অ, আ, এ এবং অ্যা। যেমন, ball, father, baby, bat। এক্ষেত্রে যদি আমরা একই ধ বর্ণকে চারভাবে উচ্চারণ করতে পারি তাহলে কোন-কে আমরা কেন কোনো-রূপে উচ্চারণ করতে পারবো না? এত দিন তো আমরা সেভাবেই করে আসছি এবং লিখে আসছি। তবে এখন কেন শব্দটিতে একটি অতিরিক্ত বর্ণ যোগ করে শব্দটিকে ভারী করা হচ্ছে? কোন শব্দটি জিজ্ঞাসা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সে ক্ষেত্রে বাক্যের ধরন দেখে সহজেই আমরা কোন্ উচ্চারণ করে থাকি। খুব প্রয়োজন হলে শব্দটির শেষ বর্ণে একটি হসন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে। কোন্ শব্দটির ব্যবহার খুবই সীমিত। এ সম্পর্কে রাজশেখর বসু তাঁর চলন্তিকার পরিশিষ্টে যে কথা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, “সুপ্রচলিত শব্দের উচ্চারণ, উৎপত্তি ও অর্থের ভেদ বুঝাইবার জন্য অতিরিক্ত ও-কার বা ঊর্ধ্ব কমা যথাসম্ভব বর্জনীয়, যদি অর্থ গ্রহণে বাধা হয় তবে কয়েকটি শব্দে অন্ত্য অ-কারে ও-কার এবং আদ্য বা মধ্য অক্ষরে ঊর্ধ্ব কমা বিকল্পে দেয়া যাইতে পারে।”৪৪ রাজশেখর বসু, চলন্তিকা, কলিকাতা, এম.সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রা.লি ১৪০৫, পৃ. পরিশিষ্ট ২। সংস্কারকদের নিয়ম অনুসারে বানান লিখতে হলে আমাদের আগেকার কবি-সাহিত্যিকদের লেখারও পরিবর্তন ঘটাতে হবে। যদি উচ্চারণ অনুসারে বানান লিখতে হয় তাহলে অসংখ্য শব্দে নতুন বর্ণ যোগ করতে হবে। তাতে শব্দের গঠন-প্রকৃতি পরিবর্তন হবে, লেখা এবং টাইপের সময়ও বাড়বে। ড. পবিত্র সরকারের ‘বাংলা বানান সংস্কার : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ গ্রন্থটি পড়লে সকলেই অনুধাবন করবেন যে তিনি বানান সংস্কারের পক্ষে। তাই তিনি বলেছেন, সংস্কৃত সন্ধিজাত সদ্যোজাত, অকুতোভয়, মনঃকষ্ট প্রভৃতি শব্দকে সদ্যজাত, অকুতভয়, মনকষ্টরূপে লেখা যেতে পারে।৫৫ ড. পবিত্র সরকার, বাংলা বানান সংস্কার : সমস্যা ও সম্ভাবনা, কলকাতা, চিরায়ত প্রকাশন, ১৯৯৮, পৃ. ৬০। অন্তস্থ য স্থলে বর্গীয় জ, স এবং ষ স্থলে শ লেখারও তিনি সুপারিশ করেছেন। কিন্তু শব্দগুলো তো একটা নিয়মের মাধ্যমে সৃষ্ট। তাছাড়া আমরা উচ্চারণ অনুসারে বানান লেখার কথা বলে থাকি। ড. সরকারের অভিপ্রায় অনুসারে যদি সদ্যজাত, মনকষ্ট, অকুতভয় লিখি তাহলে উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গতি থাকে না। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, বানান সংস্কারকদের মধ্যে মতের মিলের চাইতে অমিলই বেশি। কোন্ মতটি গ্রহণযোগ্য এবং কোন্টি গ্রহণযোগ্য নয় তা নিয়েও মতভেদ আছে। ১৯৩৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানান সমিতি বানানের যে নিয়ম করে দিয়েছে তা খুবই বাস্তবসম্মত। সেখানে অনেকটা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। কিন্তু সে বানানবিধি আমরা অনেকেই মানতে নারাজ। সংস্থা এবং ব্যক্তিবিশেষের অভিপ্রায় অনুসারে বাংলা ভাষার বানান সংস্কার হচ্ছে। এতে করে আমাদের মাতৃভাষা বিশৃঙ্খলার কবলে পড়ছে। ইংরেজি ভাষায় শব্দের বানানে এবং বর্ণের উচ্চারণে বিস্তর পার্থক্য। সেখানে একই বর্ণের ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ হয়। যেমন, a= অ, আ, এ, এ্যা। c= ক্ চ্ স্। g= জ্ গ্ । ch=চ্ ক্। u= উ, আ, ইউ ইত্যাদি। তাই put (পুট) কিন্তু but (বাট); cat (ক্যাট) কিন্তু call (কল); bat (ব্যাট) কিন্তু ball (বল); tap (ট্যাপ) কিন্তু tall, division কিন্তু action। ইংরেজি ভাষায় বহু শব্দ আছে যার কোন কোন বর্ণের উচ্চারণ একেবারেই হয় না। কিন্তু শব্দে সে সব বর্ণ আছে। যেমন, psycology, cholera, honesty, knee, rhyme wrist, phthisis. আবার উচ্চারণ এক, কিন্তু বানান আলাদা। যেমন, butcher, culture, write, right, rough, bridge, bridge, breeye, cite seat, coma, comma। শব্দের উচ্চারণ অনুসারে লিখলে talk, tough, thought, can, lieutenant, colonel c«f…wZ kã‡K tak, taf, that, kan, leftenant, cornel রূপে লেখা উচিত। ইংরেজি ভাষায় এরূপ অসংখ্য শব্দ আছে যার অনেক বর্ণের কোন উচ্চারণই হয় না অথবা ভিন্ন উচ্চারণ হয়। আবার একই বর্ণের বিভিন্ন উচ্চারণ হয়। যেমন, School, thought, bought ইত্যাদি। কিন্তু ইংরেজরা উচ্চারণ-প্রযত্ন ধরে বানান সংস্কারে এগিয়ে আসছেন না। ইংরেজি বানান অতি অবৈজ্ঞানিক। অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চারণের সঙ্গে বানানের সামঞ্জস্য নেই। তাই তাকে সংস্কার করার চেষ্টা হয়েছে। এমন কি আইনও প্রণীত হয়েছিল। বার্নার্ড শ তাঁর টাকা-পয়সাও রেখে গেছেন এই সংস্কার কাজে। তবুও ইংরেজি বানান যেমন ছিল তেমনই আছে- গত দু’শ বছরে তার কোন পরিবর্তন হয়নি। কারণ, তা করতে গেলে ভাষায় একটা নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে। পুরাতন ও নতুন বানানের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। সে কারণেই ইংরেজরা হয়তো এদিকে পা বাড়াননি। তাছাড়া তাঁরা ভাষার ঐতিহ্যকেও ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট গবেষক ড. গোলাম মুরশিদ বলেন, “শেক্সপিয়ারের সমাধিলিপিতে লেখা ছিল frend, পাথরটাকে তাঁরা (ইংরেজ পন্ডিতরা) বদলাতে পারলেন না; কিন্তু তাঁরা তা সংশোধন করে বললেন, ওটা হবে friend। কারণ, পণ্ডিতরা ঝোঁক দিয়েছিলেন ব্যুৎপত্তির ওপর। শব্দের ব্যুৎপত্তি দেখিয়ে তাঁরা বললেন, শব্দটা যখন লাতিন থেকে নেয়া, সুতরাং বানানটাকে সেই মূল শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়া যাক। আবার কোন শব্দের মূল গ্রিক হলে সেই শব্দে গ্রিকের ছাপটা যেন সামান্য হলেও থাকে। যেমন: এক সময় ইংরেজিতে debt (ঋণ) কথাটা লেখা হতো সোজা বানানে- det। কিন্তু রক্ষণশীল গ্রিক-লাতিনবাদীরা বললেন, মূল শব্দটা যখন debitum তখন ওটার চরিত্র রক্ষার জন্য লেখা হোক debt, tru-কে লেখা হোক true। কারণ ওর মূলে আছে triewe...(দুখিনী বাংলা বানান, গোলাম মুরশিদ, প্রথম আলো, ৫-১০-১২)। ৬৬ মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা, একাধিক বানানরীতির কবলে ধর্মীয় শব্দ, (কালের কণ্ঠ, ১৯-০২-২০১৬)। এ সম্পর্কে আরও তথ্যবহুল আলোচনা আছে ড. আহমদ শরীফের ‘বাঙলা ভাষা-সংস্কার আন্দোলন’ গ্রন্থটিতে। চলবে.... লেখক : প্রফেসর, সংস্কৃত বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
×