ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বাঘায় নতুন জাতের আমের খোঁজ

রাজশাহীর বাজারে এসেছে সুমিষ্ট গোপালভোগ

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ২২ মে ২০২২

রাজশাহীর বাজারে এসেছে সুমিষ্ট গোপালভোগ

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ আমের ভরা মৌসুম শুরু হয়েছে রাজশাহী অঞ্চলে। রাজশাহী ছাড়াও পাশের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁজুড়ে ছড়িয়েছে আমের বিস্তৃতি। গুটি জাতের আমের পর এরই মধ্যে রাজশাহীর বাজারে আসতে শুরু করেছে অন্যতম সুমিষ্ট আম গোপালভোগ। শুক্রবার থেকেই বাজারে এ জাতের আম উঠতে শুরু করেছে। এক সময় আমচাষ নিয়ে চাষীপর্যায়ে অনীহা থাকলেও এখন আমের বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়েছে। তাই নতুন জাতের আমও উৎপাদন হচ্ছে রাজশাহী অঞ্চলের তিন জেলায়। এ বছর রাজশাহীর বাঘায় নতুন জাতের আমের উপস্থিতি মিলেছে। স্থানীয় পর্যায়ে ইতোমধ্যে এ আমের নামকরণ করা হয়েছে ‘বাঘাশাহী’। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আম উৎপাদনে দেশখ্যাত রাজশাহী অঞ্চলে গতানুগতিক জাতগুলোর পাশাপাশি উন্নত জাতের আমচাষে ঝুঁকছেন চাষীরা। প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদন ব্যবস্থায় স্বল্প সময়ে ভাল ফলন এবং বেশি দাম পাওয়া যায়, এমন জাতের নতুন আমের বাগান গড়ে উঠছে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয়। অনেকে আমের বড় বাগান কেটে উন্নত জাতের ছোট ছোট বাগান গড়ে তুলছেন। রাজশাহী কৃষি বিভাগ বলছে, এ অঞ্চলে উন্নত জাতের মধ্যে হাইব্রিড জাতের বারি আম-৪, ‘গোরমতি’ ও ‘ইলামতি’ জাত ইতোমধ্যে ভাল সাড়া ফেলেছে। ফল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের আশ্বিনা ও আমেরিকার লাইন এম-৩৮৯৬ জাতের সংকরায়ণের মাধ্যমে উদ্ভাবিত ‘বারি আম-৪’ এরই মধ্যে চাষীদের মাঝে সাড়া ফেলেছে। নওগাঁ জেলায় গত বছর এ জাতের ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়। যেটা এ বছর ৩ হাজার ৬২৫ হেক্টর বেড়ে ২৯ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। নতুন বাগানের অধিকাংশতেই এখন ‘বারি আম-৪’ চাষ করা হচ্ছে। এ ছাড়া রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জেও এই জাতটির দিকে ঝুঁকছেন চাষীরা। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বারি আম-৪ উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড নাবিজাত। যেটি সংকরায়ণের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে উদ্ভাবিত হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০০৩ সালে উত্তরাঞ্চলে চারা রোপণের জন্য মুক্ত করা হয়। আমটির আকর্ষণীয় আকার-আকৃতি, স্বাদ, রং ও উৎপাদনের জন্য ভাল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই জাতের আমের ৮০ শতাংশই খাদ্যোপযোগী। রোগবালাই কম, গাঢ় হলুদ ও আঁশহীন এ আমের প্রতিটির ওজন হয় ৬০০ থেকে সাড়ে ৬০০ গ্রাম। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই আম গাছ থেকে সংগ্রহ করা যায়। এ ছাড়া আম পাড়ার পর ৭ থেকে ৮ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। মৌসুমের শেষে হাইব্রিড আম ‘ইলামতি’। চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের বিজ্ঞানীরা গোমস্তাপুর উপজেলার রামচন্দ্রপুরের একটি বাগানে এই আমের সন্ধান পান। মাঝারি আকৃতির এই আমের গড় ওজন ৪২৭ গ্রাম। কাঁচা আম সবুজ আর পাকা অবস্থায় হাল্কা হলুদ। পাকা আমে সুঘ্রাণ রয়েছে। এ ছাড়া বারি আম-১২ ‘গৌরমতি’ নামে অধিক পরিচিত পেয়েছে। এই আম ইলামতিরও পরে বাজারে আসে। সে সময় অন্য জাতের আম বাজারে থাকে না বললেই চলে। এতে চাষীরা ভাল দাম পান। এই আমের স্বাদ অনেকটাই ল্যাংড়া আমের মতো। এই আমটিরও উৎপাদন ভাল। প্রতিটি আমের ওজন হয়ে থাকে প্রায় ৫০০ গ্রাম। গত বছর এই আম ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন ব্যবসায়ীরা। ৬ থেকে ৭ বছর বয়সী একটি গাছে এই আমের ফলন হয় হেক্টর প্রতি ৪.৩ টন। সর্বশেষ এ বছর রাজশাহীর বাঘায় স্থানীয়ভাবে আরও একটি নতুন জাতের আমের সন্ধান মিলেছে। উপজেলার বলিহার গ্রামে একটি পারিবারিক বাগানে নতুন জাতের এ আমের সন্ধান পাওয়া গেছে। বাগানটিতে এ জাতের চারটি গাছ চিহ্নিত করেছে উপজেলা কৃষি অফিস। বাগানটির মালিক বাঘা পৌরসভার মেয়র আব্দুর রাজ্জাক। তার দুটি গাছে এবার আম এসেছে। আঁশ নেই, আঁটি ছোট, পাল্পের পরিমাণ বেশি এবং অনন্য ঘ্রাণ রয়েছে এই আমে। পাকে মে মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে। স্বাদে খিরসাপাত বা হিমসাগরের মতো। পাকার পর প্রায় ১০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এ জাতের গাছে প্রতিবছর সমান পরিমাণ আম ধরে। আমটির উৎপত্তিস্থলের সঙ্গে মিল রেখে উপজেলা কৃষি কার্যালয় নামকরণ করতে প্রস্তাব করেছে ‘বাঘাশাহী’। এরই মধ্যে নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন তারা। ‘বাঘাশাহী’ আমের গাছের পাতা কিছুটা সরু। ফনিয়া আমের মতো। বড় আকারের গাছ। আম দেখতে সুন্দর, খেতেও সুস্বাদু। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন জানান, হাইব্রিড বারি আম-৪ ও গৌরমতি- এই দুটি জাত তাদের কাছে আছে। এই দুটি জাত বাংলাদেশ ফল গবেষণা কেন্দ্রের আবিষ্কার। এই দুটি জাতই এখন জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই জাত দুটির রোগ-বালাইয়ের আক্রমণের হার অন্য আমগুলোর চেয়ে কম। চাষীরা দামও ভাল পাচ্ছেন। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক জানান, চাঁপাইয়ের গৌরমতি আমটি মৌসুমের শেষে বাজারে আসে। যে কারণে দামটা অন্য আমের চেয়ে বেশি পাচ্ছেন চাষীরা। আর যে কোন আম যখন সবার শেষে আসবে, তখন পোকামাকড়ের আক্রমণের হারটা মৌসুমের তুলনায় বেড়ে যায়। তবে এখন আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পোকাসহ রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা মাঠপর্যায়ের চাষীরা খুব ভাল বোঝেন। এটা নিয়ে কোন শঙ্কা নেই। লাভজনক হওয়ায় নতুন জাতগুলোর প্রতি আম চাষীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন। রাজশাহীর বাজারে এলো ‘গোপাল’ ॥ নির্ধারিত সময়েই বাজারে এলো রাজশাহী অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় গোপালভোগ জাতের আম। শুক্রবার সকাল থেকেই চাষীরা গাছ থেকে এই আম পাড়তে শুরু করেছেন। জেলার সবচেয়ে বড় আমের হাট বানেশ্বরের আড়তগুলোতেও উঠেছে গোপালভোগ আম। গত ১৩ মে এ অঞ্চলে গুটি জাতের আম নামানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় রাজশাহীর আমের বেচাকেনা। এর এক সপ্তাহ পর বাজারে এলো উন্নত জাতের আম গোপালভোগ। শনিবার নিজের বাগান থেকে গোপালভোগ আম নামিয়েছেন রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর এলাকার চাষী রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, গাছে এবার আম খুবই কম। তার সাতটি গোপালভোগ জাতের গাছের মধ্যে তিনটিতে কয়েক দিন আগে আম পাকা দেখা গেছে। তাই এই তিনটির আম পেড়েছেন। অন্য চারটি গাছের আম নামাবেন আর এক সপ্তাহ পর। পুঠিয়ার বানেশ্বর আমের হাটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিমণ গোপালভোগ আম চাষীদের কাছ থেকে আড়তগুলোতে কেনা হয়েছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা দরে। দু-একদিনের মধ্যে দাম আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। রাজশাহীতে এ মৌসুমে ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে এসেছে আম। গতবার ছিল ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আম চাষ। গতবারের তুলনায় এবার বেড়েছে ৫৭২ হেক্টর জমি। এ জমি থেকে এবার দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৭৬ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে যা হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ১১.৬০ মেট্রিক টন আম। তবে কেজিপ্রতি এবার আমের গড় ধরা হয়েছে ৪২ টাকা। সে হিসাবে এবার ৯০১ কোটি টাকার আমের বেচাকেনা হবে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, গত মৌসুমে আমের উৎপাদন বেশি হলেও করোনার কারণে আম চাষীরা দাম পাননি। এ বছর তুলনামূলক বেশি জমিতে আমের চাষ হলেও আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৭৬ মেট্রিক টন আম, যা টাকার হিসাবে প্রায় ৯০১ কোটি টাকা। গতবারের তুলনায় এবার ১০০ কোটি টাকা বেশি।
×