ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

হাজারো ভিড়ে মনে পড়ে জর্জ হ্যারিসনকে

‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ গানে হৃদয়ে জাগে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ গানে হৃদয়ে জাগে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

গৌতম পাণ্ডে ॥ উনিশ একাত্তরের উত্তাল সময়। জন্মভূমিকে স্বাধীন করার প্রত্যয়ে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। জীবন বাঁচাতে এরই মধ্যে লাখ লাখ মানুষকে আশ্রয় নিতে হয়েছে ভারতে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে খাবারের সঙ্কট। কলেরাসহ নানা রোগে জর্জরিত হাজার হাজার মানুষ। ভয়াবহ সেই পরিস্থিতিই ব্যথিত করে সেতার বাদক পণ্ডিত রবি শঙ্করকে। তার চিন্তার ফসল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই উদ্যোগে পাশে পেয়ে গেলেন বিটলস গায়কদের অন্যতম জর্জ হ্যারিসনকে। এদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর গণহত্যা গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল তার অন্তরকে। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের ১ আগস্টের এ কনসার্টে জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া শেষ গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ শতবার শোনার পরও এখনও আমাদের হৃদয়ে জেগে ওঠে মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই সব স্মৃতি। বারবার অশ্রুসজল হয়ে যাই আমরা। এ জন্যই জর্জ হ্যারিসন এত বেশি প্রিয় আমাদের কাছে। আনন্দ-বেদনায় গাথা সেই মহা ইতিহাস নানাভাব ও ভাষায় প্রকাশ হচ্ছে। আর মাত্র কদিন পর মহান বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ। লাল-সবুজে সেজেছে রাজধানী। এখানে ওখানে উড়ছে জাতীয় পতাকা। আগামী ১৬ ডিসেম্বর রণাঙ্গনে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জানানো হবে বিনম্র শ্রদ্ধা। জীবিতদের জানানো হবে অভিনন্দন, কৃতজ্ঞতা। বীর স্বাধীনতাকামী সৈনিকদের কাতারে তুমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা জর্জ হ্যারিসন। তোমার চেষ্টায় নব উদ্দীপনায় জেগে উঠোিছল বাঙালী। শরণার্থীদের মুখে জুটেছিল আহার। বিজয় দিবসের সেই শুভক্ষণে হাজারো মানুষের ভিড়ে তোমাকেই মনে পড়ে বন্ধু। জর্জ হ্যারিসন কীভাবে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন, এ বিষয়ে তিনি বলেছেন তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আই মি মাইন’-এ। তিনি ১৯৭১ সালের জুনে তার রাগা এ্যালবামের জন্য লস এ্যাঞ্জেলেসে কাজ করছিলেন। সে সময় রবিশঙ্কর বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য একটা কনসার্ট করতে চান বলে জর্জকে জানান। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত নানা দেশের পত্রিকা ও সাময়িকীর সংবাদগুলো পাঠান জর্জের কাছে। জর্জ লিখেছেন, বিষয়টি কী, আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলাম। আমার মনে হলো, কাজটার বিষয়ে আমার বোধ হয় তাকে সাহায্য করা উচিত। এভাবেই জড়িয়ে গেলাম। সামান্য মহড়া আমরা করেছিলাম। সত্যি বলতে কি, সবার উপস্থিতিতে একটা মহড়া আমরা করতে পারিনি। নানা অসুবিধার মধ্যে অগোছালোভাবে কাজটা করলাম আমরা।...তারপর কনসার্ট করলাম আমরা। দুটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। প্রথম অনুষ্ঠানের সব টিকেট বিক্রি হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় কনসার্টটি করেছিলাম। কপালই বলতে হবে, সব কিছু ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন ও শরণার্থীদের সাহায্যার্থে এত বড় অনুষ্ঠান বিশ্বে এই প্রথম। এতে জর্জ হ্যারিসন তৃপ্ত হয়েছিলেন। রবিশঙ্কর আনন্দিত হয়েছিলেন। ‘আই মি মাইন’ বইয়ে জর্জ হ্যারিসন লিখেছেন, মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের ঘটনাবলীর বিষয়ে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমরা যখন কনসার্টের প্রস্তুতি নিচ্ছি, মার্কিনীরা তখন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু সংবাদপত্রে শুধু কয়েক লাইন, ও, হ্যাঁ, এখনও এটা চলছে। আমরা ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম। এখনও বাঙালী রেস্তরাঁয় এমন সব ওয়েটারের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যারা বলেন, ওহ্, মিস্টার হ্যারিসন, আমরা যখন জঙ্গলে লড়াই করছিলাম, তখন বাইরে কেউ আমাদের কথা ভাবছে, এটা জানাটাও আমাদের জন্য ছিল অনেক কিছু। ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন। জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান। রিঙ্গো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান করেছিলেন। লিওন রাসেল একটি একক এবং ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। গানটি লিখেছেন জর্জ হ্যারিসন এবং সুরও তার। গানের মূল কথাই ছিল বিশ্বের মানুষের কাছে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান। গানের কথায় এমন আবেদন ছিল যে ‘সকলের কাছে মিনতি জানাই আজ আমি তাই/ কয়েকটি প্রাণ এসো না বাঁচাই’ বা ‘এত যে বেদনা রাখি দূরে/ দেবে না তোমার ক্ষুধিতকে রুটি সামান্য দুটি/ মানুষগুলোকে সহায়তা দাও।’ জর্জ হ্যারিসন পুরো গানটা গেয়েছেন উচ্চস্বরে করুণ বিলাপের সুরে গভীর মানবিক আবেদন নিয়ে। সে জন্য গানের সেই সুর আজও আমাদের উজ্জীবিত করে। ২০০৫ সালে নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এ্যালবামের ডিভিডি। দুটি ডিভিডির একটি সুদৃশ্য সেট এখনও পাওয়া যায়। একটি সিডিতে রয়েছে পুরো গানের অনুষ্ঠান। আরেকটিতে রয়েছে শিল্পী-কলাকুশলীদের সাক্ষাতকার। আরও আছে মহড়ার কিছু চিত্র ও গান। এর সঙ্গে আছে একটি সচিত্র পুস্তিকা। এই ডিভিডি বিক্রির অর্থ যাচ্ছে জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফে। এই নতুন ডিভিডির ভূমিকায় পণ্ডিত রবিশঙ্কর বলেছেন, ৭৫ বছরের সঙ্গীত জীবনে যত কনসার্ট করেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ওই কনসার্টটিই। ২০০৫ সালে পুনঃপ্রচারিত দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ডিভিডি উপলক্ষে সঙ্গে প্রকাশিত পুস্তিকায় ইউএসএ ফান্ড ফর ইউনিসেফের সভাপতি চার্লস জে. লিওনসের লেখা থেকে জানা যায়, কনসার্টের টিকেট বিক্রি থেকে সংগ্রহ হয়েছিল প্রায় আড়াই লাখ ডলার। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত তিনটি রেকর্ডসহ এ্যালবাম এবং ১৯৭২ সালের মার্চের কনসার্ট নিয়ে তৈরি ফিল্ম থেকে আয় নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। পরবর্তী দশকগুলোতে এসব অর্থ দান করা হয় ইউনিসেফ পরিচালিত শিশুদের কল্যাণমূলক তহবিলে। এসব কারণেই রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন এবং ওই কনসার্টের শিল্পীদের প্রতি আমাদের আগ্রহ ও আকর্ষণ ম্লান হয় না কিছুতেই, কোন সময়েই নয়। বরং তা প্রেরণার অফুরান উৎস হয়ে আছে। আমরা যতবার দেখি আর শুনি, সেই প্রথম দেখার মতো আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি বারবার। জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন। তিনি জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশে এই প্রতিষ্ঠানের কাজ দেখতেই তিনি ২০১১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এসেছিলেন ঢাকায়। এটাই ছিল তার প্রথম বাংলাদেশ সফর। তিনি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দরিদ্র শিশু ও কিশোরদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু কাজ দেখেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিশুদের জন্য কিছু কর্মসূচী চলে জর্জ হ্যারিসন ফান্ডের সহায়তায়। বছরের পর বছর ধরে তার প্রয়াত স্বামীর শুরু করা মানবিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন, যে কাজের সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশের শিশুরাও। এভাবেই পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন এবং ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আজও সক্রিয় বাংলাদেশে।
×