ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লালমনিরহাটে দুই শত বছর ধরে একসাথে মসজিদে প্রত্যেহ নামাজ, মন্দিরে চলছে পুজা অর্চনা

প্রকাশিত: ১৭:৩৮, ১৬ অক্টোবর ২০২১

লালমনিরহাটে দুই শত বছর ধরে একসাথে মসজিদে প্রত্যেহ নামাজ, মন্দিরে চলছে পুজা অর্চনা

নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট, ১৬ অক্টোবর ॥ অসাম্প্রদায়ক শহর লালমনিরহাট পুরান বাজার কালীমন্দির - জামে মসজিদ একই চত্বরে ২০০ বছর ধরেপুজা ও নামাজ চলছে। দুই ধর্মের মানুষের কোন খেদ নেই তাতে। এই অসম্প্রদায়িক চেতনাকে এবার সাম্প্রদায়িক রং লাগিয়ে উগ্রমৌলবাদী জামাত শিবির অপপ্রচারে মাঠে নেমেছে। মসজিদ চত্বরে পুজা কেন? প্রশ্ন তুলেছে। তবে সুধিজনরা বলছে মন্দিরটি দুই শত বছরের পুরোন। মসজিদ অনেক পরে হয়েছে। হিন্দু ধর্মাম্বলীদের উদারতায়। একই আঙিনায় মসজিদ - মন্দির। মুসলিম সম্প্রদায়ের ইবাদত প্রত্যহ নামাজ আর হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রত্যেহ উপাসনালয়ে পুজা - অর্চনা। ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে বাধা হতে পারেনি। আজান হলে সাময়িক সময়ে পুজা অর্চনা স্থগিত রাখে। সেই সময় টুকুতে ঢোল, খোল, সঙ্খ, শাঁক, উলুধনি বন্ধ রাখা হয়। মসজিদে নামাজ নামাজে আসা মুসুল্লিদের জামাতের সাথে নামাজ পড়তে কোন ব্যঘাত সৃষ্টি না হয়। এভাবে দুই শত বছর ধরে চলে আসছে। সন্ধ্যায় মন্দিরে ধূপকাঠি ও মসজিদে আগরবাতির সুঘ্রাণ মানুষকে মুগ্ধ করে। ধর্মীয় সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত এই শহরকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিশ^ দরবারে পরিচয় পেয়েছে ধর্মীয় সম্প্রীতির শহর হিসেবে। যুগ যুগ ধরে পৃথক দুটি ধর্মীয় উপাসনালয় নিয়ে কোন ধরণের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি হয়নি। কোন কোন সময় দেশের নানা স্থানে হিন্দু – মুসলিমকে নিয়ে দাঙ্গা হাঙ্গামা সৃষ্টির পায়তারা হয়। তার আগুনের উত্তাপ এখানে স্পশ করতে পারেনি। এটাই এই শহরের বৈশিষ্ট। ধর্মীয় সম্প্রীতির এমন উজ্জ্বল নিদর্শন দেখতে জেলা শহরের কালীবাড়ী পুরান বাজার জামে মসজিদ ও কালীবাড়ী কেন্দ্রীয় মন্দিরে এসে ছিলেন মার্কিণ রাষ্ট্রদূত ডেন মর্জিণা। নেপালেরনেপালের ডিপুটি হাই কমিশনার শ্রী কুমার রাই এবার পুজায় এখানে এসেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে ১৮৩৬ সালে কালী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় অবিভক্ত বাংলার (ভারত বর্ষের) বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র ছিল লালমনিরহাট শহরে কালীবাড়ী পুরান বাজার। এখানে হিন্দু মারওয়ারি ব্যবসায়ি গণের নিয়ন্ত্রণে ছিল ব্যবসা বাণিজ্য। ছিল হাবিব সুগন্ধি সাবান তৈরির কারখানা। ছিল অটো রাইচ মিল। ছিল সোযাবিন তেল পরিশোধনের কারখানা। ছিল হাবিব ব্যাংকের শাখা। লালমনিরহাট শহরের রেলওয়ে ষ্টেশনটি জংশন। এখানে ট্রেন যোগে নেপাল, কুচবিহার, দারজিলিং, করাচিসহ ভারত বর্ষের যেকোন জায়গায় যাওয়া যেত। ছিল নদী বন্দর মোগলহাট , তিস্তা । সেই সময় দক্ষিণ এশিয়ার স্বর্ণদ্বার বলা হতো লালমনিরহাট শহর কে। হিন্দু মারওয়ারি গণ কালী প্রতীমার ভক্ত ছিলেন। বাঙ্গালি হিন্দুরা ছিল দূর্গা প্রতীমার ভক্ত। তারা এখানে কালিমন্দির স্থাপন করে প্রত্যহ পুজা অর্চনা করে আসছিল। পুরেহিত পরিবারের থাকা খাওয়ার সু ব্যবস্থা করে ছিল মন্দিরের পাশে। যাহা এখনো পুরোহিত পরিবার ব্যবহার করছে। সেই মারওয়ারি ব্যবসায়িদের সাথে পাইকারি পণ্য কিনতে দেশের দুরদুরান্ত হতে মুসলিম পাইকার আসতেন। তাদের মধ্যে অনেকে নামাজি ছিলেন। সেই নামাজিদের জন্য মন্দিরের পাশে হিন্দু ব্যবসায়িরা ওযাক্তি মসজিদ নির্মাণ করে দেয়। এটা ছিল তাদের উদারতার পরিচয়। সেই হতে শুরু। চলে আসছে মসজিদ - মন্দিরে উপাসনা। প্রতিবছর দূর্গাপুজার আগে মসজিদ কমিটি ও মন্দির কমিটি এবং পূজা উদযাপন কমিটি বৈঠক করে নেয়। সুষ্ঠু সন্দর ভাবে পুজা পরিচালনা করতে। দুই শত বছরে কোন দিন ধর্মীয় কোন বিষয় নিয়ে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি। কেউ কখনো শুনেনি। পুুরান বাজার জামে মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, ঐতিহ্যবাহী পুরান বাজার মসজিদ ও মন্দির এক সাথে। মসজিদের আগে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলাম ধর্মের কোথাও নেই মসজিদ মন্দির একসাথে করা যাবে না। ধর্ম যার যার তার তার। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। প্রত্যেক জাতির ধর্ম পালনে সহায়তা করতে মুসলিম কে অনুপ্রাণিত করেছেন। কারও ধর্মে বাধা দেয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। ইসলাম ধর্ম কতটা উদার তার জ¦লন্ত দৃষ্টান্ত এই মসজিদ - মন্দির। এটা দুইটি ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন কতটা অটুট তার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। কেন্দ্রীয় কালীবাড়ী মন্দিরের সভাপতি ও প্রধান পুরোহিত শংকর চক্রবর্তী জানান, ১৮৩৬ সালে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এই এলাকার নামকরণ মানুষের মুখে মুখে পরিবর্তন হয়ে যায়। ব্যবসা – বাণিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র হয়ে যায় কালীবাড়ী পুরান বাজার। বংশ পরমপরায় মন্দিরের খেদমত করে আসছি। কোনদিন সামান্য বিশৃঙ্খলাও হয়নি। কখনো নিজেকে সামান্য নিরাপত্তাহীন মনে হয়নি। এই শহর ধর্মীয় সম্প্রীতির শহর। জন্মের পর থেকে এভাবে চলতে দেখছি। গত ১১ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঢাকাস্থ নেপাল দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন (উপপ্রধান মিশন) মি. কুমার রাই ও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য মসজিদ - মন্দিরটি পরিদর্শন করেছে। তবে দূঃখজনক হলেও সত্য। এ বছর কুমিল্লায় উগ্রমৌলবাদী চক্র মন্দিরে পবিত্র কোরআন রেখে অপপ্রচার চালিয়ে দাঙ্গা সৃষ্টি পায়তারা করে। এটা ছিল সুপরিকল্পিত ও চক্রান্ত। যাহা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙ্গালি চেতনার পরিপন্থি। এই ঘটনার পরপর কে বা কারা ফেসবুকে গুজুব ছড়ায়। কালীবাড়ি মসজিদের পাশে মুসলিম দেশে মন্দির কেন? মুসলিমরা তোমরা কোথায়। এটাকে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা গভীর ষড়যন্ত্র মনে করে। এই ফেসবুক আইটির পরিচয় সনাক্ত করে। চক্রান্তের মুল হোতাদের খুঁজে শাস্তির আওতায় আনা জরুরি মনে করছে সমাজ সচেতন গণ। ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশে কোন অপপ্রচারকারি স্থান হবেনা।
×