ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ই-কমার্সে প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে চায় সরকার

প্রকাশিত: ২৩:১০, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

ই-কমার্সে প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে চায় সরকার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ২০০৯ সালে দেশে ই-কমার্সের যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ সময় ধরে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে এগিয়ে চলছিল দেশের ই-কমার্স খাত। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অপকর্মে ঝুঁকিতে পড়েছেন কয়েক লাখ নতুন উদ্যোক্তা। চটকদার ছাড়ে পণ্য বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত শুরু হয়েছে বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বিকাশমান ই-কমার্স খাতকে সহযোগিতা করা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মানুষ যাতে প্রতারিত না হয়, সে লক্ষ্যে ই-কমার্স খাতের নিয়ন্ত্রণে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একইসঙ্গে ডিজিটাল কমার্স আইনও করবে সরকার। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, শুধু সিটি কর্পোরেশন থেকে স্বল্প টাকায় নেয়া ট্রেড লাইসেন্সের ওপর ভিত্তি করে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা চলতে পারে না। অবশ্যই এসব ব্যবসা তদারকির জন্য সরকারের আলাদা সংস্থা দরকার। ওই সংস্থা শর্তসাপেক্ষে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে এসব ব্যবসার পরিচালনায় লাইসেন্স দেবে। ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে আনুমানিক আড়াই হাজার ই-কমার্স সাইট রয়েছে। এর বাইরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা করছেন অন্তত পৌনে দুই লাখ উদ্যোক্তা। অল্পদিনেই ই-কমার্স খাতের ব্যবসাটি দেশের অর্থনীতিতে বড় সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্বের গøানি থেকে মুক্তি দিয়েছে বহু মানুষকে। তথ্য অনুযায়ী, গত তিনবছর ধরে ই-কমার্স খাতের প্রবৃদ্ধি প্রায় ১০০ ভাগ। অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে খাতটি। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে গতবছরের মার্চে সাধারণ ছুটি শুরু হলে ই-বাণিজ্য তুঙ্গে ওঠে। বর্তমানে এ খাতের আকার প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের মধ্যে এটি ২৫ হাজার কোটির মাইলফলক ছুঁয়ে যাবে বলে ধারণা করা হয়। এ সম্ভাবনার মধ্যেই গত কয়েক মাসে টালমাটাল হয়ে গেছে খাতটি। বিশেষ করে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ ও ধামাকার প্রতারণার মধ্য দিয়ে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। গ্রাহক ও মার্চেন্টের অর্থ লোপাটের ঘটনায় ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিআইডি সূত্র জানায়, মাত্র আড়াই বছরে দেশের ই-কমার্স খাতকে ওলটপালট করে দেয়ার অন্যতম হোতা এই প্রতিষ্ঠান। ইভ্যালির প্রতারণার ফাঁদ ছিল ‘সাইক্লোন’, ‘থান্ডারস্টর্ম’ নামক অবিশ্বাস্য মূল্যছাড়। এ কারণে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইভ্যালি একটি লোকসানি কোম্পানি ছিল এমনটাই মনে করেন র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, ইভ্যালি কোন ব্যবসায়িক লাভ এ যাবত করতে পারেনি। গ্রাহকদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই ইভ্যালি চলত। রাসেল তার কোম্পানির ব্যয়, বেতন ও নিজস্ব খরচ নির্বাহ করতেন। ক্রমেই তার দায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সূত্র জানায়, দেশের ই-কমার্স খাতে আস্থার জায়গা ধরে রাখতে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় কিছুদিন আগে নীতিমালা ও নির্দেশিকা জারি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নির্দেশিকায় প্রধানত পণ্য সরবরাহ ও রিফান্ড দেয়ার সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে পাঁচদিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। ভিন্ন শহরে অবস্থান করলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য স্টকে না থাকলে সেটার কোন পেমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না। আগাম পরিশোধ করা টাকা পণ্য সরবরাহের পরই বিক্রেতার এ্যাকাউন্টে জমা হবে। ক্রেতার অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্যটি ডেলিভারি ম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে তা টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানাবে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি ম্যান পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবেন। সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য বা সেবা ডেলিভারি ম্যানের কাছে হস্তান্তর করার মতো অবস্থায় না থাকলে ই-কমার্স কোম্পানি পণ্যমূল্যের ১০ শতাংশের বেশি অর্থ অগ্রিম নিতে পারবে না। তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, এসব নির্দেশনা এখনও শুধুই কাগজে-কলমে! দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান এ বিষয়ে বলেন, অবশ্যই রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু সিটি কর্পোরেশনের একটি ট্রেড লাইসেন্সে এত বড় ব্যবসা পরিচালনা করতে দেয়া উচিত না। দেখভালের জন্য আলাদা একটি কমিশন গঠনও করতে হবে। তিনি বলেন, পদ্ধতিটা এমন হওয়া উচিত, পণ্যটি পাওয়ার পরই মূল্য পরিশোধিত হবে। কোনক্রমেই এর ব্যত্যয় করা যাবে না। এর পাশাপাশি লাইসেন্সের জন্য একটি অথরিটি করা উচিত। যারা লাইসেন্স দিবেন, তারাই শর্তগুলো ঠিক করবেন। তবে লাইসেন্স ছাড়া কেউই এ ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে না। কর্তৃপক্ষ এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নজরদারিতে রাখবেন। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে প্রয়োজনে ব্যবসা বন্ধ করে দেবেন। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে জানান, সরকারী সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্বে অবহেলা করার কারণেই দেশে অসাধু ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম মাথাচাড়া দিয়েছে। এত বড় একটি শিল্পের ওপর নজর রাখার জন্য শুধুমাত্র একটি সেল গঠনই যথেষ্ট নয় বলে তিনি মনে করেন। আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের মতো একটি সংস্থা তৈরির সুপারিশ করেন, যেখানে বাণিজ্য, অর্থ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বেসরকারী খাতের প্রতিনিধিরা থাকবেন। তাদের দায়িত্ব হবে এই খাতের সুষ্ঠু পরিচালনা নিশ্চিত করা। গত বুধবার ‘ডিজিটাল কমার্স ব্যবসায় সাম্প্রতিক সমস্যা’ বিষয়ে আয়োজিত এক পর্যালোচনা সভা শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ই-কমার্সে যা ঘটেছে তার দায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এড়াতে চায় না। দায় নিচ্ছে বলেই এসব সভা করা বা অন্য উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ এর ওপর বেঁচে আছে। সুতরাং দায় নিয়েই আগামীতে যাতে এ ধরনের প্রতারণামূলক ঘটনা না ঘটে সেজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এগোচ্ছে। তিনি বলেন, বিকাশমান ই-কমার্স খাতকে সহযোগিতা করা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মানুষ যাতে প্রতারিত না হয়, সে লক্ষ্যে ই-কমার্স খাতের নিয়ন্ত্রণে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একইসঙ্গে ডিজিটাল কমার্স আইনও করবে সরকার।
×