ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

লোকসানের শঙ্কায় মুক্তি পায় না নতুন ছবি বন্ধ হয়েছে অধিকাংশ সিনেমা হল করোনায় আরও বিপর্যস্ত এই খাত হাজারের বেশি প্রেক্ষাগৃহের স্থানে এখন মাত্র ৬৬টি

বিলুপ্তির পথে প্রেক্ষাগৃহ ॥ সিনেমা ব্যবসায় দুর্দিন

প্রকাশিত: ২৩:২২, ২৫ জুন ২০২১

বিলুপ্তির পথে প্রেক্ষাগৃহ ॥ সিনেমা ব্যবসায় দুর্দিন

মনোয়ার হোসেন ॥ অর্ধশত বছরের পুরনো প্রেক্ষাগৃহ মধুমিতা। গত বছরের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের এই সিনেমা হলটিতে আর আলো জ্বলেনি। করোনার কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চের পর থেকেই বন্ধ রয়েছে প্রেক্ষাগৃহটি। স্বাস্থ্যবিধি মানার বিধিনিষেধের সেই সময় সারাদেশেই বন্ধ ছিল প্রেক্ষাগৃহ থেকে শুরু করে সকল বিনোদন কেন্দ্র। পরবর্তীতে অক্টোবর মাস থেকে সরকারী নির্দেশনা মেনে খুলে দেয়া হয় প্রেক্ষাগৃহ। তবে সেই মার্চ মাস থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত ষোলো মাস পেরিয়ে গেলেও চালু হয়নি মধুমিতা সিনেমা হল। মহামারীর অভিঘাতে ৫৩ বছরের পুরনো হলটির পথচলায় ছন্দপতন ঘটেছে। ২৫ জুন থেকে পুনরায় প্রেক্ষাগৃহটি চালুর সিদ্ধান্ত হলেও সংক্রমণের উর্ধমুখী পরিস্থিতিতে পরবর্তীতে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে হল কর্তৃপক্ষ। এমন বাস্তবতা শুধু মধুমিতায় নয়, এখন চরম দুর্দশা চলছে প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসায়। করোনা এই দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সিনেমা ব্যবসায় সমস্যার নেপথ্যে রয়েছে বহুমুখী কারণ। একদিকে প্রেক্ষাগৃহ খুললে দর্শক সমাগম নিয়ে রয়েছে দুশ্চিন্তা। অন্যদিকে হল চালু থাকলেও দর্শক কম হলে প্রযোজকরা লোকসানের ভয়ে বড় বাজেটের নতুন ছবি মুক্তি দিতে আগ্রহী নন। আগে থেকেই লোকসানের বোঝা নিয়ে ধুঁকতে থাকা প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ে পরিণত হয়েছে করোনাকাল। ক্ষতি হয়েছে শত কোটি টাকার। ইতোমধ্যে নিভে গেছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার কুড়িটির বেশি সিনেমা হলের আলো। বেকার হয়েছেন হলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েক শ’ কর্মচারী। এক সময় সারাদেশে হাজারের বেশি প্রেক্ষাগৃহ থাকলেও চলচ্চিত্রশিল্পের ক্রমশ নি¤œগামিতার কারণে করোনার আগেই ১০০টির নিচে নেমে আসে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা। পরবর্তীতে করোনার করালগ্রাসে সেই সংখ্যা আরও নেমে এসেছে। বন্ধ হয়ে গেছে কুড়িটির বেশি সিনেমা হল। মৌসুমি সিনেমা হল বাদে বর্তমানে সারাদেশে স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা নেমে এসেছে ৬৬টিতে। বেকার হয়ে গেছে হাজার হাজার কর্মী। সেই সুবাদে ধুঁকতে থাকা প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসায় শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে করোনাকাল। এমন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে সিনেমা ব্যবসা বিলুপ্তির আশঙ্কা করছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় মধুমিতা সিনেমা হলের মালিক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বলেন, সিনেমা শিল্পটা ক্রমশ রুগ্ন হচ্ছে। একদিকে দর্শক টানার মতো ছবি নেই। অন্যদিকে মহামারী। সিনেমাশিল্পের জন্য এটা অশনি সঙ্কেত। ক্ষয়রোগে ভুগতে থাকা চলচ্চিত্রশিল্পে শেষ পেরেকটি ঠুক দিয়েছে করোনা। চলচ্চিত্রের ব্যবসা মন্দার কারণে সিনেমা হলের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। কমতে কমতে এখন সারাদেশে মাত্র ৬৬টি স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে। ভবিষ্যতেই এই সংখ্যা আরও কমে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে খাতটি। সেই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে একই সঙ্গে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দী ছবি উন্মুক্ত করে দিতে হবে। বিদেশী ছবি আমদানিসংক্রান্ত সকল প্রতিবন্ধকতা তুলে দিতে হবে। দেশী ছবির সঙ্গে বলিউড এবং হলিউডের ছবি চালিয়েই বাঁচতে হবে প্রেক্ষাগৃহকে। নইলে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হওয়ায় সার্বিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত চলচ্চিত্রশিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। আর সিনেমা হল টিকে না থাকলে দেশী ছবির প্রদর্শনীও হুমকির মুখে পড়বে। সেই প্রেক্ষাপটে দেশী ছবির সঙ্গে বিদেশী ছবি চালিয়ে আমরা হল বাঁচিয়ে রাখতে চাই। করোনা পরিস্থিতিতে হল বন্ধ রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানুষ এখনও করোনাজনিত ভয় ও আতঙ্কে আছে। তাই হল খুললেই দর্শক আসবে, এমন নয়। বিশেষ করে এই অবস্থায় পরিবার নিয়ে কেউ ছবি দেখতে আসবে না। তার ওপর আরেক সমস্যা, হল খুললেই দর্শক টানার মতো ছবি পাওয়ার গ্যারান্টি নেই। প্রস্তুত হয়ে থাকলেও লগ্নি উঠে আসার ভয়ে বড় বাজেটের কোন ছবি মুক্তি দিচ্ছেন না প্রযোজকরা। এছাড়া আগে যৌথ প্রযোজনার মাধ্যমে কিছু ভাল ছবি পাওয়া যেত। এখন সেই পথটিও রুদ্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় বর্তমানে আয় না থাকলেও ব্যয় ঠিকই আছে। প্রদর্শনীর আয়ের বদলে নিজের পকেট থেকে কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে। তাই হল খুলে লোকসানের বোঝা না বাড়িয়ে কিছুটা হলেও নিরাপদে থাকার চেষ্টা করেছি। তাই চৌদ্দ মাস পর ২৫ জুন থেকে পুনরায় প্রেক্ষাগৃহ চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েও সরে এসেছি। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় নবাব এলবি নামের একটি বড় বাজেটের ছবি প্রদর্শনীর মাধ্যমে পুনরায় শুরুর সিদ্ধান্ত নিলেও আপাতত হল খুলছে না। এছাড়া এই এক ছবি দিয়ে তো আর সারা বছরের হলের খরচ উঠে আসত না। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে মধুমিতা। প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এখন মরিয়া হল মালিকরা। এই খাতে অনুদানের পাশাপাশি সহজশর্তে ঋণ দাবি করছেন তারা। প্রেক্ষাগৃহ বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে হাজার কোটি টাকার তহবিলের ঘোষণা দেয়া হলে তাতে আশার আলো দেখছেন না হল মালিকরা। কারণ, তহবিলের সেই টাকা থেকে সহজশর্তে এবং দীর্ঘমেয়াদী ঋণের বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি। এমন অবস্থায় সিনেমা হল মালিকরা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে বিষয়টির সমাধানে আগ্রহী। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি কাজী শোয়েব রশীদ বলেন, অনেকদিন ধরেই আইসিউতে থাকা সিনেমা হল করোনাকালে চলে গেছে লাইফ সাপোর্টে। ইতোমধ্যে এ ব্যবসায় প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। করোনা ভীতি কাটিয়ে হলে দর্শক আসতে আরও সময় লাগবে। সবার কাছে আগে জীবন পরে বিনোদন। তাই আমাদের এখন উভয় সঙ্কট। হল না খুললেও বিপদ, আবার খুললে রয়েছে দর্শকশূন্যতার আশঙ্কা। দর্শক টানার মতো নতুন কোন ছবি মুক্তি পাচ্ছে না। প্রকৃত অর্থে সিনেমা হল খুলেও কোন লাভ হচ্ছে না। কারণ দর্শক দেখার মতো ছবির সঙ্কট রয়েছে। বিশেষ করে বড় বাজেটের ভাল ছবির দেখার নেই। এ ধরনের কিছু ছবি প্রস্তুত থাকলেও লোকসানের ভয়ে প্রযোজকরা তার মুক্তি দিচ্ছেন না। তাই পুরনো ছবি দিয়ে হল চালিয়ে রাখতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে সিনেমা হলের ব্যবসা। আক্ষেপ করে এই প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসায়ী বলেন, চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করা হলেও আমরা সেটার বেনিফিট পাই না। বিদ্যুত বিল দিতে হয় বাণিজ্যিক হারে। একইভাবেই সিনেমা হলের যন্ত্রপাতি আমদানিতেও কোন ছাড়া পাওয়া যায় না। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়া। মূলত আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে গেছে চলচ্চিত্র শিল্পের সুবিধা। এদিকে হল বাঁচাতে হাজার কোটি টাকার তহবিল বরাদ্দ করেছে সরকার। ইতোমধ্যে ৫০০ কোটি টাকা অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় আছে। ঋণ হিসেবে প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের দেয়া হবে টাকা। কিন্তু এই ঋণ সহজশর্তে এবং দীর্ঘমেয়াদী না হলে কোন লাভ হবে না। কারণ, এমনিতেই লোকসানের মধ্যে দিয়ে চলা হল মালিকরা নতুন করে ঋণ নিয়ে ঝুঁকি নিতে আগ্রহী হবে না। রাজধানীর সিনেমাপ্রেমীদের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েেেছ বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্স। একইসঙ্গে ছয়টি প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে চলা এই সিনেপ্লেক্সও এখন পাড়ি দিচ্ছে কঠিন সময়। সেই হতাশা প্রকাশ করে স্টার সিনেপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক মেজবাহ উদ্দিন বলেন, প্রদর্শনীর মাধ্যমে লাভ করা তো দূরের কথা খরচও উঠে আসছে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ৫০ শতাংশের কম দর্শক নিয়ে হলগুলো চালাচ্ছি। ভাল ছবির অভাবে সেই কাক্সিক্ষত দর্শকও পাচ্ছি না। সব মিলিয়ে সিনেমা ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। বলতে গেলে বর্তমানে শুধুমাত্র ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বাঁচিয়ে রাখতে হল খুলে রাখছি। তাই লাভের বদলে টিকে থাকার লড়াই করছি। এদিকে চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির পক্ষ থেকে গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত ১৬টি নতুন ছবি মুক্তি দেয়ার কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে মুক্তি পেয়েছে মাত্র চারটি। ছবিগুলো হলো ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’, ‘বিশ্বসুন্দরী’, ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ ও ‘সাহসী হিরো আলম’। নতুন ছবি মুক্তি না দেয়ায় প্রেক্ষাগৃহের মালিকরা অভিযোগের তীর ছুঁড়েছেন প্রযোজকদের প্রতি। নতুন ছবি মুক্তি না দেয়া প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু বলেন, প্রকৃতপক্ষে আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। আমরা আসলে বুঝতে পারছি না করোনার কারণে নাকি ভালো ছবির অভাবে দর্শক হলে যাচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে একটা বড় বাজেটের ছবি দিয়ে মুক্তি দিলে সেটার দর্শক টানা এবং লগ্নি উঠে আসার বিষয়ে আমরা সন্দীহান। একটা বড় বাজেটের ছবি মুক্তি দিলে প্রকৃত পরিস্থিতিটা বোঝা যাবে। আমরা বুঝতে পারব- করোনার কারণে দর্শক আসছে না বা ভাল ছবির অভাবে আসছে না। এই প্রেক্ষাপটে একটা বড় বাজেটের ছবি মুক্তি দিয়ে আমরা আস্থার জায়গাটা তৈরি করতে চাই। তাছাড়া লকডাউনের ১৮টা শর্তের মধ্যে সকল বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ থাকলেও সিনেমা হলের বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। এ কারণে গত ঈদে পাঁচ-ছয়টি জেলায় প্রেক্ষাগৃহ খুলতে দেয়নি স্থানীয় জেলা প্রশাসন। ফেনী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় গত ঈদে হল খুলতে দেয়নি জেলা প্রশাসন। সব মিলিয়ে একটা বিভ্রান্তি রয়েছে। তাই সিনেমা হল খোলা রাখার বিষয়ে সরকারীভাবে সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন। আগামী ঈদে প্রশাসনিক কোন বাধা না থাকলে নতুন ছবি মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করা হবে। মূলত মহামারীর আগে থেকেই দেশের প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসায় চলছিল মন্দাভাব। করোনায় সেই পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে শত কোটি টাকার। ইতোমধ্যে নিভে গেছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বেশ কিছু সিনেমা হলের আলো। বন্ধ হওয়ার এই তালিকায় আরও আছে ঢাকার অভিসার, কুমিল্লার মুন সিনেমা হলসহ অনেক প্রেক্ষাগৃহ। চলচ্চিত্রশিল্পের মন্দাবস্থায় লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে করোনাকালে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে টিকাটুলি এলাকার অর্ধশত বছরের পুরনো প্রেক্ষাগৃহ অভিসার। ২৬ কাঠার হলের জায়গাটিতে গড়ে তোলা হবে কমিউনিটি সেন্টার। শুধুমাত্র অভিসারের নামটি ধরে রাখতেই সেই ভবনে ছোট্ট করে একটি প্রেক্ষাগৃহ রাখার কথা জানিয়েছেন হলটির কর্তৃপক্ষ। সার্বিকভাবে প্রেক্ষাগৃহের ব্যবসাকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তার অন্ধকার। যেসব হল মালিকের নিজস্ব ভবন নেই তারা পড়েছেন আরও বেকায়দায়। ছবি প্রদর্শনীর মাধ্যমে আয়ের সুযোগ বন্ধ হলেও আছে অনেক খরচ। আটকে আছে কর্মচারীদের বেতন। অনেক পুরনো প্রেক্ষাগৃহের মালিকও বেতন দিতে পারছেন না হলের ক্লিনার থেকে শুরু করে লাইটম্যান, টিকেট বিক্রেতা, গার্ডসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মীর। বেতন না পাওয়ায় ছুটে গেছে অনেক হলের দক্ষ কর্মচারী। ফলে আগামীতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও হল চালাতে হিমশিম খেতে হবে এসব হল মালিককে। সারাবছর মানসম্মত ছবি না পাওয়ায় দর্শকখরাকেই এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন প্রেক্ষাগৃহ মালিকরা। একটি হলকে টিকিয়ে রাখতে বছরের ৫২ সপ্তাহে অন্তত দশ-বারোটি বড় বাজেটের ভাল ছবির প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে বছরজুড়ে দুই-তিনটির বেশি ব্যবসাসফল ছবি পাওয়া যায় না। এমনকি প্রতি সপ্তাহে চালানোর নতুন ছবিও মেলে না। উল্টোদিকে চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা দেয়া হলেও বিদ্যুত বিল প্রদান থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি; কোন কিছুতেই মেলে না সেই সুবিধা। সবকিছুই দিতে হয় বাণিজ্যিক হারে। ফলে চলচ্চিত্রশিল্পের ক্রমাগত ক্ষতির মুখে ক্রমশ কমেছে সিনেমা হলের সংখ্যা। ঢাকাই ছবির সোনালি সময়ে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ১২ শতাধিক। করোনার আগেও মৌসুমি হল বাদে দেশব্যাপী বছরজুড়ে চালু থাকা স্থায়ী সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০টি। করোনাকালে সেই সংখ্যা কমে ৬৬টিতে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় হল ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে দেশী ছবির পাশাপাশি বলিউড-হলিউডসহ বিভিন্ন দেশের ছবি উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন অনেকে। বিদেশী ছবির আমদানির প্রতিবন্ধকতা তুলে দেয়ার কথা বলছেন তারা। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হল মালিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে সিনেমা হলের নানা সঙ্কটের কথা। ২০০১ সালে কুমিল্লার হোমনা উপজেলায় গড়ে ওঠে মুন সিনেমা হল। করোনাকালে থমকে গেছে এই প্রেক্ষাগৃহের উনিশ বছরের পথচলা। আক্ষেপ করে হলটির মালিক জাহাঙ্গীর আলম শিকদার বলেন, আগে থেকেই ব্যবসা খারাপ ছিল। তার পরও দীর্ঘদিন লোকসান গুনে কোনমতে প্রেক্ষাগৃহটি টিকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু করোনাকালে আর পারিনি। আগে থেকেই ভাল ছবির অভাবে দর্শক হলে আসত না। বছরে একটা/দুইটা ছাড়া ব্যবসাসফল ছবি পেতাম না। শিল্পী সমিতিসহ চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের কোন্দলের কারণে ঢাকাই ছবির অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। বর্তমানে হল চালানোর মতো ভাল ছবির জোগান নেই। বছরজুড়ে হাতেগোনো কয়েকটি বড় বাজেটের ছবি আসে। প্রতিষ্ঠিত প্রযোজকের অনুপস্থিতিতে এমন ঘটেছে। এই ধারায় নতুনরা যুক্ত হলেও একটি-দুটি ছবির পর তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ধারাবাহিকভাবে ছবি করবে এমন প্রযোজকের অভাব দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু হল ব্যবসা চালাতে বছরে কমপক্ষে ৫০টি নতুন ছবির প্রয়োজন হয় । এখন কুড়িটি দর্শকটানা ছবি পেতেই হিমশিম খেতে হয়। স্বল্প বাজেটের কিংবা পুরনো ছবি নিয়ে হল চালানো সম্ভব নয়। দুই ঈদ ছাড়া সারাবছর হল চালানোর ছবি নেই। প্রেক্ষাগৃহটি পুনরায় চালু করতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত বিশেষ তহবিলের ঋণ গ্রহণ করবেন কিনাÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেখানে ভাল ছবির অভাবে দর্শক হয় না সেখানে ঋণ নিয়ে নতুন করে বোঝা বাড়াতে চাই না। হলের জায়গায় অন্য কিছু করার চিন্তা করছি। এই প্রেক্ষাগৃহ মালিক জানান, বর্তমানে পুরো কুমিল্লা জেলাতেই কোন সিনেমা হল নেই। কয়েকটি টিমটিম করে চললেও করোনাকালে বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হয়েছে দাউদকান্দি উপজেলার ঝুমকা ও ঝরনা সিনেমা হল এবং চান্দিনার পালকি। কুমিল্লা জেলা শহরে বন্ধ হয়েছে রূপালী, মধুমতি, দীপিকা ও গীতালী সিনেমা হল।
×