ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদুল আলম জয়

বিশ্ব মাতানোর অপেক্ষায় ইউরো ও কোপা আমেরিকা

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ৯ জুন ২০২১

বিশ্ব মাতানোর অপেক্ষায় ইউরো ও কোপা আমেরিকা

করোনা মহামারীর কারণে গোটা দুনিয়ার সবকিছুই থমকে দাঁড়ায়। এখনও সবকিছু স্বাভাবিক হয়নি; সময় যে ঢের লাগবে সেটাও স্পষ্ট। এই দুর্যোগে থমকে দাঁড়িয়েছিল বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনও। তবে সবার আগে বুক চিতিয়ে মাঠে ফিরেছে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। করোনাকে জয় করে গত বছর থেকেই নিয়মিতভাবে হচ্ছে সব ধরনের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। এ ধারাবাহিকতায় এবার প্রায় একসঙ্গে মাঠে গড়াতে যাচ্ছে বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম দুটি জনপ্রিয় আসর ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ ও কোপা আমেরিকা। ইউরোকে বলা হয় ইউরোপের বিশ্বকাপ, আর কোপা হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার বিশ্বকাপ। মেসি-নেইমারদের দেশের এই আসর আবার বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে প্রাচীন যজ্ঞ। করোনার দুঃসময়ের মধ্যেও ফুটবলপ্রেমীরা একসাথে দুটি জনপ্রিয় আসর উপভোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন। অর্থাৎ আবারও শুরু হচ্ছে রাত জাগার পালা! ইউরোপিয়ান ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের আসরের পর্দা উঠবে আগামী শুক্রবার রাতে। উদ্বোধনী ম্যাচে রাত ১টায় ‘এ’ গ্রুপ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তুরস্ক ও ইতালী। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এবারের ইউরোর স্বাগতিক দেশ ১১টি। করোনার কারণেই এত দেশে ম্যাচ আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপিয়ান ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা উয়েফা। এবারের আসরটি ইউরোর ১৬তম আয়োজন। আসরটি হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ১২ জুন থেকে ১২ জুলাই। কিন্তু করোনার কারণে এক বছর পর হচ্ছে। ছয়টি গ্রুপে মোট ২৪টি দেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল আছে ‘এফ’ গ্রুপে। এবার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর দলের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ। করোনার থাবা থাকলেও এবারের আয়োজক দেশগুলোতে এখন সাজ সাজ রব। দেশগুলোতে বর্তমানে ‘ফুটবল তো নয়, যেন উৎসব!’ অবস্থা বিরাজমান। ইউরোপ সেরার ফুটবলযজ্ঞকে উৎসবে মাতানোর সব পসরা সাজিয়ে বসে আছে তারা। এখন শুধুই অপেক্ষা। ঘড়ির কাঁটা ধরে এগিয়ে চলছে কাউন্ট ডাউন। কেমন হবে এবারের টুর্নামেন্ট, কারা ঔজ্জ্বল্য ছড়াবেন সবচেয়ে বেশি আর চ্যাম্পিয়নই বা হবে কোন্ দল? মাল্টিমিলিয়ন ডলারের এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাবার জন্য বিশেষজ্ঞরা মেতে উঠেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর শক্তিমত্তা, দুর্বলতা ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করার কাজে। এখানেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে নানা মুনির নানা মত। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর কর্তবাবুদের মাঝে শুরু হয়ে গেছে কথার লড়াই ও ভবিষ্যদ্বাণী। শুরু হয়েছে বাজিকরদের বাজির দরও। ইউরোপের সেরা ফুটবল শক্তিগুলোর অসামান্য ফুটবলশৈলীর উৎসব এই ইউরোর কদর বিশ্বফুটবলপ্রেমীদের কাছে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। সেরা টেকনিক আর পাওয়ার ফুটবলের অপূর্ব সমন্বয় ঘটবে এবারের আসরে এতে সন্দেহ নেই বিন্দুমাত্র। এদিক থেকে এবারের ইউরো বৈচিত্র্যের দাবিদার। তবে শুধু এ দিকটার জন্যই নয়, টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই মজার সব কা-কারখানা টুর্নামেন্টটিকে মহিমাম-িত করে তুলেছে। আসল লড়াই শুরুর আগেই ঘটে চলেছে বিভিন্ন বিচিত্র ঘটনা। ফুটবলের সর্ববৃহৎ আসর বিশ্বকাপ ফুটবলের পরেই মূল্যায়ন করা হয় ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপকে। অনেকেই এটাকে ‘ইউরোপের বিশ্বকাপ’ বলেও অভিহিত করে থাকেন। আবার অতি উৎসাহীরা ইউরোকে বিশ্বকাপের চেয়েও এগিয়ে রাখেন!! তাদের কথার ভিত্তি যে নেই তা নয়। কেননা এখানে একই মানের দল অংশগ্রহণ করে। এখানকার দলগুলোর মান ১৫-২০ নয়, ১৯-২০। কিন্তু বিশ্বকাপে এমন ভারসাম্যের বড়ই অভাব। যার মূল কারণ সেখানে অঞ্চলভিত্তিক কোটা থাকায় অনেক দুর্বল দল বিভিন্ন জোনের প্রতিনিধিত্ব করে। ইউরোতে সে সুযোগ নেই। এখানে সবাই প্রায় সমশক্তির দল। ফুটবল শক্তির নিরিখে এবারের আসরের সেরা দলগুলো হলো বর্তমান চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল, বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড, ইতালি ও ইংল্যান্ড। সুপারস্টার রোনাল্ডোকে সামনে রেখে একঝাঁক নতুন স্ট্রাইকারদের নিয়ে এবার মসনদ ধরে রাখার মিশনে নামছে পর্তুগাল। দলটিতে নতুন আক্রমণভাগে রোনাল্ডোকে সহযোগিতা করার জন্য আছেন বার্নান্ডো সিলভা, দিয়াগো জোতা, জুয়াও ফেলিক্স ও আন্দ্রে সিলভার মত তরুণরা। প্রতিবেশী স্পেনের পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে পরপর দুইবার ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপ ধরে রাখার হাতছানি পর্তুগীজদের সামনে। ইনজুরির কারণে ২০১৬ ইউরোতে খেলতে না পারা ২৬ বছর বয়সী বার্নান্ডো সিলভা পর্তুগালের মূল একাদশের একজন নির্ভরযোগ্য স্ট্রাইকার। এ পর্যন্ত ৫৪ ম্যাচে করেছেন সাত গোল। এছাড়া বাকিরাও আছেন দারুণ ফর্মে। তবে স্পটলাইটটা নিঃসন্দেহে থাকবে রোনাল্ডোর দিকে। কেননা ইরানের কিংবদন্তি আলি দাইয়ের সর্বকালের সর্বোচ্চ ১০৯ গোলে রেকর্ড স্পর্শ করতে সি আর সেভেনের প্রয়োজন মাত্র ৬ গোল। পর্তুগীজ অধিনায়কের বর্তমানে দেশের জার্সিতে গোলসংখ্যা ১৭৪ ম্যাচে ১০৩টি। অন্যদিকে আয়োজক হিসেবে আর্জেন্টিনা ও কলম্বিয়াকে বাদ দেয়ার পর এবারের কোপা আমেরিকার নতুন স্বাগতিকের মর্যাদা পেয়েছে ব্রাজিল। এ কারণে আগের সূচীতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন সূচীতে টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক ব্রাজিলের বিরুদ্ধে খেলবে ভেনিজুয়েলা। ব্রাসিলিয়ার এস্টাডিও ন্যাশিওনাল মানে গারিঞ্চা স্টেডিয়ামে ম্যাচটি হবে বাংলাদেশ সময় আগামী রবিবার দিবাগত রাত ৩টায়। আসরে ‘বি’ গ্রুপে ব্রাজিলের অন্য প্রতিপক্ষ কলম্বিয়া, ইকুয়েডর ও পেরু। ফাইনালের জন্য প্রস্তুত রাখা হচ্ছে বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়াম। টুর্নামেন্টে আরেক ফেবারিট আর্জেন্টিনা আসর শুরু করবে বাংলাদেশ সময় ১৪ জুন রিও’র সান্টোস স্টেডিয়ামে। ম্যাচে মেসিদের প্রতিপক্ষ চিলি। ‘এ’ গ্রুপে খেলা আর্জেন্টিনার অন্য তিন প্রতিপক্ষ হলো বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ে। আগামী ৫ জুলাই সান্টোস স্টেডিয়ামে হবে প্রথম সেমিফাইনাল। পরেরদিন গারিঞ্চায় হবে দ্বিতীয় সেমি। পূর্ব নির্ধারিত ১০ জুলাই মারাকানায় হবে ফাইনাল। ঐতিহ্যবাহী এই ভেন্যুতে টুর্নামেন্টের একটি ম্যাচই হবে। মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে এবার আসর আয়োজন নিয়ে বেশ বেকায়দায় আছে আয়োজকরা। দফায় দফায় সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হচ্ছে তাদের। এর আগে আসরটি আয়োজন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ১২ জুন থেকে ১২ জুলাই। তবে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে টুর্নামেন্টটি পিছিয়ে এ বছর আনা হয়। মূলত আর্থিক ক্ষতির কারণেই মরিয়া হয়ে কোপার আয়োজন করছে কনমেবল। এ পর্যন্ত ৫টি কোপা আমেরিকার আসর আয়োজন করেছে ব্রাজিল। এর সবকটিতেই সেলেসাওরা শিরোপা জিতেছে। সবেচয়ে বেশি পাঁচবার বিশ্বকাপ জয়ী দেশটিতে এখনও ভয়ানক করোনা সংক্রমণ চলছে। এ নিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো মহাদেশীয় টুর্নামেন্টটি বসতে যাচ্ছে ব্রাজিলে। ২০১৯ সালে সর্বশেষ পেলের দেশে হয়েছিল আসরটি। ওই বছরের ৭ জুলাই মারাকানায় হওয়া ফাইনালে পেরুকে ৩-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সাম্বা ছন্দের দেশ। এবারও আচমকা স্বাগতিকের মর্যাদা পাওয়ায় কাসেমিরো, নেইমার, জেসুস, ফিরমিনোদের টপ ফেবারিট বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশ্বসেরা সুপারস্টার লিওনেল মেসি থাকার পরও আধুনিক ফুটবলে সাফল্যহীন আজেন্টিনা। ১৯৯৩ সালে কোপা আমেরিকা জয়ের পর দেশটি আর কোন আন্তর্জাতিক সাফল্য পায়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিন তিনটি টুর্নামেন্টে ফাইনালে খেলে হারতে হয়েছে মেসি-মারিয়া-এ্যাগুয়েরোদের। এর মধ্যে ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল এবং ২০১৫ ও ২০১৬ সালে কোপা আমেরিকার ফাইনালে হারের জ্বালা এখনও কাঁদায় আর্জেন্টিনা ভক্তদের। কোপায় সেই ক্ষত মেটানোর আরেকটা সুযোগ পাচ্ছে দিয়াগো ম্যারাডোনার দেশ। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ফুটবল আসরে এবার চ্যাম্পিয়ন হতে চান মেসি। এক সাক্ষাতকারে তিনি এমন প্রত্যয়ের কথাই জানিয়েছেন। ক্লাব দল বার্সিলোনার হয়ে সাফল্যের ভা-ার অনেক সমৃদ্ধ হলেও জাতীয় দলের হয়ে এখনও শিরোপা জেতা হয়নি ক্ষুদে জাদুকরের। ২০০৭, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকার ফাইনাল এবং ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনার হারে স্বপ্ন ভাঙে তার। শেষ যে সম্ভাবনাগুলো আছে এর একটি এবারের কোপা আমেরিকা। রেকর্ড সর্বোচ্চ ছয়বারের ফিফা সেরা তারকা বলেন, ‘গত কোপা আমেরিকায় আমরা ভাল একটি ছাপ রেখেছিলাম। কিন্তু এতেই আমরা খুশি হতে পারি না। আমরা উন্নতি করে যেতে চাই। ট্রফি জিততে চাই। এটাই আমাদের লক্ষ্য। তরুণ ও অভিজ্ঞরা প্রস্তুত।’ কোচ লিওনেল স্কালোনির অধীনে আর্জেন্টিনা দল এখন আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ বলে মনে করেন মেসি, ‘আমি মনে করি শক্ত একটা ভিত নিয়ে আমরা খুব ঐক্যবদ্ধ একটা দল। লিওনেল স্কালোনি দায়িত্ব নেওয়ার পর তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে দলটা গড়ে উঠেছে। আমাদের দারুণ একটি দল আছে। আশা করছি এবার স্বপ্নপূরণ হবে।’
×