ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাবেয়া খাতুনের উপন্যাসে হাসপাতাল ও নার্সদের জীবন

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ৮ জানুয়ারি ২০২১

রাবেয়া খাতুনের উপন্যাসে হাসপাতাল ও নার্সদের জীবন

রাবেয়া খাতুনের মৃত্যু হলো ৩ জানুয়ারি ২০২১ সালে। জন্মেছিলেন ১৯৩৫ সারের ২৭ ডিসেম্বর, তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে মামার বাড়ি পাউসন্নে। তাঁর পিতার বাড়ি শ্রীনগর থানার ষোলঘর গ্রামে। বাবা মৌলভী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ, মা হামিদা খাতুন। রাবেয়া খাতুন ১২-১৩ চছর বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম প্রগতিশীল সাপ্তাহিক ‘যুগের দাবী’তে ছাপা হয় তাঁর ছোটগল্প ‘প্রশ্ন’। ১৯৬৩ সালের ১ জুলাইতে একাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘মধুমতি’। রাবেয়া খাতুনের ১০০-এর বেশি বই রয়েছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ-উপন্যাস : মধুমতি (১৯৬৩), অনন্ত অন্বেষা (১৯৬৭), মন এক শ্বেত কপোতী (১৯৬৭), রাজবিনো শালিমার বাগ (১৯৬৯), সাহেব বাজার (১৯৬৯), ফেরারী সূর্য (১৯৭৪), অনেক জনের একজন (১৯৭৫), জীবনের আর এক নাম (১৯৭৬), দিবস রজনী (১৯৮১), নীল নিশীথ (১৯৮৩), বায়ান্ন গলির এক গলি (১৯৮৪), মোহর আলী (১৯৮৫), হানিফের ঘোড়া ও নীল পাহাড়ের কাছাকাছি (১৯৮৫), সেই এক বসন্তে (১৯৮৬) ইত্যাদি। ছোটগল্প গ্রন্থ : আমার এগারোটি গল্প (১৯৮৬), মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী (১৯৮৬), সুমন ও মিঠুর গল্প (১৯৭৮), লাল সবুজ পাথরের মানুষ (১৯৮১), তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা (১৯৮৪) ইত্যাদি। ‘একাত্তরের নয় মাস’ ও ‘স্বপ্নের শহর ঢাকা’ নামের দুটি স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। রাবেয়া খাতুন অনেক ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন, এগুলো হলোÑহে বিদেশী ভোর, মোহময়ী ব্যাঙ্কক, টেমস থেকে নায়েগ্রা, কুমারী মাটির দেশে, হিমালয় থেকে আরব সাগরে, কিছুদিনের কানাডা, চেন্নি ফোঁটার দিনে জাপানে, মমি উপত্যকা, ভূস্বর্গ সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি। তাঁর গবেষণাধর্মী লেখা-জীবন ও সাহিত্য, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, স্মৃতির জ্যোর্তিময় আলোকে যাদের দেখেছি। এছাড়া তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে বেশ কটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, এসব চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- কখনও মেঘ কখনো বৃষ্টি ও মেঘের পর মেঘ। এ ছাড়া তার কাহিনী নিয়ে ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম কিশোর চলচিত্র তৈরি করা হয়। রেডিও ও টিভি থেকে প্রচারিত হযেছে তাঁর রচিত অসংখ্য নাটক। রাবেয়া খাতুনের প্রতিভার সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় হচ্ছে উপন্যাসগুলো। রাবেয়া খাতুনের উপন্যাসসমূহ কয়েকটি বিভাগে শনাক্ত করা যায়। ইতিহাসনির্ভর কাহিনী প্রধান উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে-মধুমতি, প্রথম প্রকাশেই যে উপন্যাসটি বিশেষভাবে আলোচিত হয়। সাহেব বাজার, বায়ান্ন গলির এক গলি, শালিমার বাগ এসব উপন্যাসে উঠে এসেছে পুরান ঢাকার বিচিত্র জীবনযাপন প্রণালী। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাসটিও রাবেয়া খাতুন রচনা করেন-ফেরারী সূর্য। এছাড়া, বাগানের নাম মালনীছাড়া, ঘাতক রাত্রি, মেঘের পর মেঘ-মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃত পটভূমিকায় লেখা তাঁর উপন্যাস। আর প্রেমের উপন্যাসে নর-নারীর সম্পর্ক ও নানা টানাপোড়েন তো আছে, আছে যৌনতা, আছে সে সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। প্রেমের উপন্যাস : মন এক শ্বেত কপোতী, সেই এক বসন্তে, রঙিন কাচের জানালা, কখনও মেঘ কখনো বৃষ্টি, শঙ্খ সকাল প্রকৃতি, সাকিন ও মায়াতরু, আকাশে এখনও অনেক রাত, সৌন্দর্য সংবাদ, ছায়া হরিণী, শুধু তোমার জন্য-ইত্যাদি। ২ মন এক শ্বেত কপোতী রাবেয়া খাতুনের একটি উপন্যাস, এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে, প্রকাশক-আবু তাহের মোহাম্মদ ফজলুল হক। প্রচ্ছদ এঁকেছেন হাশেম খান। এই উপন্যাসটির কাহিনী গড়ে উঠেছে-সেবাপরায়ণ নার্সদের জীবন নিয়ে। কাহিনীর প্রয়োজনে এসেছে হাসপাতারের পরিবেশ, রোগীদের মনস্তত্ত্ব¡, ধর্মঘট, জীবনসংগ্রাম, ব্যক্তিগত জীবনের কষ্ট, ভালবাসার নামে প্রতারণা ও প্রেম। কাহিনীতে নার্স সুর্মার ভালবাসা তৈরি হয় রোগী জাফরের সঙ্গে। জাফর ধনী পরিবারের সন্তান। অন্যদিকে সুর্মার প্রেমিক ছিল মুসা, সে সুর্মাকে শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করে না, দ্বন্দ্ব তৈরি হয় এদের মধ্যে। অবশেষে সুর্র্মার সঙ্গে জাফরের বিয়ে হয়। এসেছে আরও অনেক চরিত্র। নাইমা নামের এক নার্সকে হাসপাতারের সিএ ভালবাসার নামে প্রতারণা করে, সে কাহিনীও উপকাহিনী হিসেবে এ উপন্যাসে রয়েছে। দীনা নামের এক নার্স যৌবনকে বিভিন্নভাবে উপভোগ করে, তার চিত্রও আছে এই উপন্যাসে। শ্বেত কপোতীর মতন মেয়েরা বিভিন্ন কারণে নার্সের পেশায় আসে, মানুষের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেন, নিজেদের স্বাধীনতা অন্যান্য মেয়ের চেয়ে বেশি পান-এমন পরিস্থিতিতে তাদের জীবন বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। লেখক নার্সদের জীবনের বিভিন্ন দিক ও তাদের মনস্তত্ত্ব এই উপন্যাসে সূক্ষ্ম ও বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেছেন, এই বৈশিষ্ট্যের কারণে এই উপন্যাসটি ভিন্ন মাত্রা নিয়ে উজ্জ্বল। এই উপন্যাসে হাসপাতালের ওয়ার্ড ও রোগীর বর্ণনা রয়েছে অনেক, এর মধ্যে একটি বর্ণনা : ‘দুটি ওয়ার্ডের মাঝে অপরিসর প্যাসেজ। সেখানেই সে শুয়ে। অস্থায়ী অতিরিক্ত এক বেডে। শীর্ণ, পাংশুর, এতটুকু একটু দেহ। চাদরের এ পাশে মাথাটা খোলা বলেই শুধু বোঝা যাচ্ছিল ওর তলায় দেহ রয়েছে মানুষের। সাত দিনেও ওই কোণ থেকে, অবহেলিত নির্জনতা থেকে তাকে সরানো হয়নি। যক্ষ্মা রোগী। এখানে তার নির্দিষ্ট ওয়ার্ড নেই। চেষ্টার উসিলায় তাই যেন আত্মজনদের কাছ থেকে দূরের মৃত্যুকে তপস্যায় তুষ্ট করা।’ অথবা- ‘ম্লাান অথচ প্রদীপ্ত ঔজ্জ্বল্য তার দুটি চোখের তারায়। সেখানে চকিতে সুর্মার মনে চমক দিয়ে যায় আরও একটি রোগীর মুখ। সে ছিল ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডের পেশেন্ট। অবৈধ সন্তানের ভার বইতে না পেরে র‌্যাটম খেয়েছিল। বাঁচেনি। ... বড় করুণ চোখে সুর্মার দিকে চেয়ে এক সময় প্রশ্ন করেছিল-আমাদের তো পুনর্জন্ম নেই আপা। কিন্তু বুক ভরা এক সাধ নিয়ে এ কোথায় চলিলাম আমি?’ হাসপাতালের ধর্মঘট হয়, এ ধর্মঘট বিষয়ে আখতারী আপনা নামের চরিত্রের মধ্য দিয়ে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কথা উচ্চকিত হয়-‘এই স্ট্রাইকের ব্যাপারকে কেন্দ্র করে ওয়ার্নিং-ডিসচার্জ আরও হতে পারে কত কি? নার্সিং লাইনে যারা রয়েছে, যারা আসছে অধিকাংশই তারা বুকের পাঠা, মেরুদণ্ডের জোর আর চেতনার ধার নিয়ে আসেনি, এসেছে একান্ত বাধ্য হয়ে জীবিকা কিংবা জীবনের তাগিদে। এদের কাছ থেকে উহদ আউট লিডিংয়ে তোমরা কতটা কি আশা কর আমি বুঝতে পারছিনে।’ প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সঙ্কীর্ণ অর্থে নার্সের এ পেশাকে অনেকে শুধু অবজ্ঞা করে না, বাঁকা চোখে দেখে। নার্সদের অনেকে বিভিন্ন ভাবে হয়রানি করে, যৌন-নিপীড়নেও পিছপা হয় না, এ ধরনের ঘটনা বা চিত্র এই উপন্যাসের অনেক পরতে রয়েছে, এমনি উদাহরণ-‘নার্সদের নাইট ডিউটি পড়বেই, আর মধুলোভী মেয়ে শিকারী একটি দল হাসপাতালের ওই ডেটল গন্ধী হাওয়াতেও জেগে উঠতে চাইবে। তোমরা সরল বিশ্বাসের সঙ্গে যখন ফ্লার্ট চলবে তখন অনভিজ্ঞ তুমি বা অভিজ্ঞ তোমার সেই মাথার ছাতারা কি করবেন শুনি? তোমরা হাজার হলেও থাকো মফস্বলে, ক্যাপিটলের খবর জানবে কেমন করে?’ নার্স হিসেবে প্রেমের সম্পর্কে সুর্মার আত্মপোলব্ধি দেখা যায়, যা এক বেদনাদায়ক মনোভাবকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে তুলে ধরে-‘সুর্মা ফিরে এলা আবার নিজের মধ্যে। মুসা যে কথাটা বলতে পারল না তা হচ্ছে একটি নার্সের সঙ্গে বন্ধুত্বের নামে সব কিছুই চলতে পারে শুধু যা পারে না তার নাম আইনত এক স্থায়ী সর্ম্পক। সুর্মার প্রতি উপন্যাসের নায়ক জাফরের মায়ের উক্তি থেকে নার্সদের সম্পর্কে সমাজের অন্যদের মনোভাব বোঝা যায়-‘জাফর তোমাদের প্রশংসা করে, কাজ দেখে আমিও কি কম খুশি হয়েছি। বলতে গেলে তোমাদের জন্যই আমি আমার এক মাত্র সন্তানকে ফিরে পেয়েছি। কিন্তু তবু ভুলতে পারিনে বাছা ঘরের রোশনাই তোমরা আসরে জ্বলছো। আওরত পয়দা হয় স্বামী আর সন্তানের জন্য। তাই তো তোমায় দেখে বড় দুঃখ হয়।’ উপন্যাসে লেখক নার্সদের বাস্তব জীবনকে মমতায় টেনে এনেছেন পাশাপাশি মেয়ে হিসেবে তাদের জীবন সংগ্রাম ও সমাজের মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গিকে সুচারুভাবে প্রকাশ করেছেন। রাবেয়া খাতুনের সাবলীল বর্ণনা এ উপন্যাসেও সৃজনশীলতায় প্রয়োগ হয়েছে। বিষয়ের প্রতিভাসে ভাষা হয়ে উঠেছে পরিপূরক-এমন উদাহরণ : ‘ধোঁয়াটে আঁধারে ব্যালকনীর কোল ঘেঁষে মৃদু সুরের আমেজ। তন্ময় শিল্পী সুর বিস্তার করে চলেছে। সে সুরে রাতের মৌনাকাশ আর নীলাভ চন্দ্রাভাসকে অদ্ভুত প্রাণবন্ত মনে হলো। অপার্থিব শিল্প আর প্রকৃতির শিল্পীর সেই মহা মিলন ক্ষণকে উপভোগ নয়, খণ্ডিত করার ব্রত তার বর্তমান জীবনের। সুর্মা বেদনাবোধ করল।’ উপন্যাসে কাব্যিক-বর্ণনা কখনও কখনও বিষয়কে গভীর ব্যঞ্জনায় প্রসারিত করেছে, যেমন : ‘রজনীগন্ধার দুটি ডাঁটির সঙ্গে শুভ্র চাদরে বন্দী বিষণ্ন চঞ্চল এক যৌবন দেহ।’ এই উপন্যাসের নামকরণ বিশেষভাবে সার্থক হয়েছে। মানুষের মনকে শ্বেত কপোতীর সঙ্গে তুলনা করেছেন লেখক-যে মন স্থির থাকে না, আকাশ লীলিমায় উড়ে বেড়ায়, বন্ধন মানে না। অন্যদিকে নার্সদের শুভ্র সাদা পোশাকে সেবাপরায়ণতার সৌন্দর্য প্রতিভাত হয়, এই আবহও অনেকটা শ্বেত কপোতীর মতন।
×