ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টিক্কা খানের ভয়ঙ্কর রক্তস্নান- দু’টি শিশু বাদে গ্রামের কেউ বেঁচে নেই

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ২৪ ডিসেম্বর ২০২০

টিক্কা খানের ভয়ঙ্কর রক্তস্নান- দু’টি শিশু বাদে গ্রামের কেউ বেঁচে নেই

রাজন ভট্টাচার্য ॥ নিউজ উইকের টনি ক্লিফটন সম্প্রতি ভারতের উদ্বাস্তুভরা সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। ক্লিফটন তার রিপোর্টে বলেছেন, ‘পাকিস্তান ও ভারত সীমান্তের শরণার্থী শিবিরে গেলে, যে কেউ বুঝতে পারবে পাঞ্জাবী সেনাবাহিনীর পক্ষে যে কোন নৃশংস কাজ করা সম্ভব। গুলিবিদ্ধ শিশুর লাশ আর চাবুকের আঘাতে মানুষের ক্ষত-বিক্ষত পিঠ দেখেছি আমি। চোখের সামনে শিশু সন্তানের মৃত্যু দেখে কিংবা নিজের মেয়েকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখে আক্ষরিক অর্থেই বোবা বনে যাওয়া লোকজন দেখতে পেয়েছি। পূর্ব পাকিস্তানে শ’খানেক ‘মাইলাই’ আর ‘লিডিস’ আছে- এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমার মনে হয়, এ রকম স্থানের সংখ্যা আরও বহু বাড়বে।’ ১৯৭১ সালের ২৮ জুন নিউজ উইকে ‘টিক্কা খানের রক্তস্নান’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘আমার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, অন্য যে কোন অনুভূতির চাইতে, আমার মধ্যে বিস্ময়টাই সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে। একসঙ্গে এত মৃতদেহ দেখেছি যে, আর কোন কিছুতেই এর চেয়ে বেশি আতঙ্কিত হব না। কিন্তু তারপরও সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে বারবার ভেবেছি, এমন হত্যার উন্মাদনার মধ্যে কিভাবে মানুষ নিজেকে ধরে রাখতে পারে’। হত্যাযজ্ঞ ॥ বাংলাদেশ জেনোসাইড এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস বইতে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের বরাত দিয়ে আরও লেখা হয়, ‘লাল সবুজ ফুলে ভরা গোলাপি জামা পরা ছোট্ট লাজুক মেয়েটির গল্প শুনে অদ্ভুত রকমের আতঙ্ক জাগে। তারপক্ষে কারও জন্য বিপদ ডেকে আনা সম্ভব নয়। তারপরও কৃষ্ণনগরের একটি হাসপাতালে তার দেখা পাই আমি। অন্য রোগীদের দিকে পেছন ফিরে বসে থরথর করে কাঁপছিল সে। ঘায়ের দগদগে ক্ষতটা হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে। এক পাকিস্তানী সৈন্য বেয়নেট দিয়ে তার গলা কেঁটে দিয়েছিল।’ মেয়েটি আমাকে বলে, ‘আমি ইসমত আরা। মরহুম ইসহাক আলীর মেয়ে। আমার বাবা কুষ্টিয়ার একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। দু’মাস আগে দোকানে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। তারপর আর তাকে দেখিনি। ওই একই রাতে বিছানায় ঘুমাতে যাওয়ার পর চিৎকার আর কান্না শুনতে পাই। কি ঘটেছে দেখার জন্য ছুটে যাই। দেখে মেঝের ওপর মরে পড়ে আছে আমার চার বোন। পাঞ্জাবী সৈন্যরা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে পাই ওরা আমার মাকেও মেরে ফেলেছে। আমার চোখের সামনেই গুলি করে মারে ভাইকে। সে বিএসসি পাস করেছিল। এ সময় এক সৈন্য আমাকে দেখতে পায় এবং ছুরি দিয়ে আঘাত করে আমাকে। মেঝেতে পরে মরার ভান করি। সৈন্যরা চলে যেতেই আমি দৌড়ে বেরিয়ে আসি। এক লোক রাস্তা থেকে তার সাইকেলে তুলে নেয় আমাকে। তারপর আমাকে এখানে নিয়ে আসে। কথাগুলো বলার পর হঠাৎ করেই ঘর ছেড়ে চলে যায় মেয়েটি। মনে হচ্ছিল এই অগ্নিপরীক্ষা আর সে সইতে পারছে না। হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, আহত অবস্থায় যখন মেয়েটিকে এখানে আনা হয়, তার গা রক্তে ভাসছিল। এ সময় মেয়েটি আবার ফিরে এসে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এখন আমি কি করব?’ এক সময় আমার পাঁচ বোন, এক ভাই, বাবা আর মা ছিল। এখন কেউ নেই। আমি একজন এতিম। কোথায় যাব? আমার কি হবে?’ অসহায় শিকার ॥ ‘বোকার মতো বলে ফেলি সব ঠিক হয়ে যাবে। এখানে তুমি নিরাপদ।’ কিন্তু এই মেয়েটির মতো আরও হাজার হাজার ছেলে মেয়ে, নারী-পুরুষ যারা বাড়ি ঘর ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছে, আসলেই তাদের কি পরিণতি হবে? প্রতি রাতেই পূর্ব পাকিস্তানে ফেলে আসা জ্বলন্ত গ্রামগুলোর আগুনের লেলিহান শিখায় লাল হয়ে ওঠে আকাশ। ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার হাসপাতালটি সীমান্ত থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে। পাকিস্তানী সৈন্যদের নৃশংসতার শিকার বাঙালীদের ভিড়ে হাসপাতালটি ইতোমধ্যে ভরে গেছে। পাকস্থলিতে বুলেটের আঘাত নিয়েও বেঁচে আছে চার বছরের এক ছেলে। আরেক মহিলা অসংখ্যবার বলে যাচ্ছে, কিভাবে সৈন্যরা তার চোখের সামনে দুটি সন্তানকে হত্যা করল। ছোট্ট শিশুকে বুকে চেপে ধরা অবস্থায় মহিলাকেও গুলি করে তারা। মেডিক্যাল এটেনডেন্ট ডাঃ আর দত্ত জানান, গুলিটি শিশুর শরীর ভেদ করে তার বাম বাহুর ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যায়। ‘জ্ঞান ফিরে আসার পর শিশুটিকে নিয়েই সীমান্ত পর্যন্ত নিজেকে টেনে আনে মহিলাটি।’ নবজাতক শিশু কোলে আরেক মহিলার পায়ের হাড় বুলেটের আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সময়ের অনেক আগেই ধানখেতের মধ্যে সন্তান প্রসব করে মহিলাটি। তারপর শিশুটিকে এক হাত ধরে অন্যদের সঙ্গে পথে নামে সে। শেষ পর্যন্ত সীমান্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ডাঃ দত্ত বলেন, ‘যদিও এই লোকগুলো আমার চেনা। কিন্তু বিরূপ পরিস্থিতিতে তারা কি পরিমাণ কঠিনভাবে বাঁচতে পারে ভেবে, একের পর এক বিস্মিত হচ্ছি আমি।’ কিন্তু তারপরেও কেউ কেউ আছে যারা এ পরিস্থিতি মেনে নিতে পারে না। মেঝের ওপর ছোট্ট দুটি ছেলে শুয়ে আছে। বানরের মতো শক্ত করে পরস্পরকে আঁকড়ে আছে তারা। ডাক্তার দত্ত বলেন, ‘অন্য শরণার্থীরা জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ আগে ওদের গ্রামটি পুড়িয়ে দেয়া হয়। এই শিশু দুটি বাদে গ্রামের আর কেউ বেঁচে নেই। তিনদিন ধরে তারা এখানে রয়েছে। কিন্তু এখনও তাদের পরিচয় উদ্ধার করতে পারিনি। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনার ভয়াবহতায় তারা বাগ্শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সারাদিন পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে শুয়ে থাকে। শিশু দুটিকে একেবারেই আলাদা করা যাচ্ছে না, এমনকি খাওয়ার সময়ও। কখন যে তারা কথা বলতে পারবে কিংবা স্বাভাবিক হবে, এ সম্পর্কে কিছু বলা মুশকিল।’ নিউজার্সির কংগ্রেসম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালেয়ার আগরতলা হাসপাতাল সফর করার পর বলেন, ভারতে আসার সময় তিনি ভেবেছিলেন পাকিস্তানী সৈন্যদের নৃশংসতার কাহিনীগুলো অতিরঞ্জিত। কিন্তু আহতদের স্বচক্ষে দেখার পর তার মনে হয়েছে, রিপোর্টগুলোতে নৃশংসতার কথা অনেক কমিয়ে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে মার্কিন ট্যাংক বাহিনীর পদকভূষিত সেনা কর্মকর্তা গ্যালেয়ার আমাকে বলেন, ‘যুদ্ধের সময় ফ্রন্সের সবচেয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত জায়গাগুলো, নরম্যান্ডির হত্যাযজ্ঞের স্থানগুলো দেখেছি আমি। কিন্তু এখানকার মতো ঘটনার মুখোমুখি হইনি কখনোই। কান্নায় ভেঙ্গে পড়া থেকে কিছুতেই নিজেকে বিরত রাখতে পারিনি।’ ধর্ষণ ॥ অন্যান্য বিদেশী পর্যবেক্ষক প্রথমে পাকিস্তানী নৃশংসতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে থেকে একের পর এক বিরামহীন নির্যাতনের কাহিনী শুনতে শুনতে, পরে ব্যাপারটা বিশ্বাস করেন তারা। ২০ বছর ধরে এদেশে বসবাসকারী জন হেস্টিং বলেন, ‘পাকিস্তানী সৈন্যরা যে শিশুদের শূন্যে ছুড়ে দিয়ে বেয়নেটে গেঁথে গেঁথে হত্যা করেছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত আমি। আমি নিশ্চিতভাবে আরও বলতে পারি, সৈন্যরা মেয়েদের পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। তারপর দু’ঊরুর মাঝখানে বেয়নেট ঢুকিয়ে তাদের হত্যা করেছে।’ এসব বর্বরতার কাহিনী থেকে মনে হচ্ছে, হয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রক্তের নেশায় পাগল হয়ে গেছে অথবা সমগ্র বাঙালী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরও আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত গণহত্যার নীতি অনুসরণ করছে তারা। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গবর্নর টিক্কা খান এই ষড়যন্ত্রের হোতা। ধারণা করা যায়, কি ঘটেছে সে সম্পর্কে কিছুটা জানেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু হয়ত তিনি বুঝতে পারছেন না, শিশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে, গোটা পরিবার ধরে খুন করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব দিয়েছেন মিলিটারি জেনারেল টিক্কা খানকে। দক্ষতার সঙ্গে আর নির্দয়ভাবে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন টিক্কা খান। ফলশ্রুতিতে পূর্ব পাকিস্তান নামমাত্র পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু গত তিনমাসে পশ্চিমারা পূর্বাঞ্চলের মানুষের ওপর যে নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে, তার ফলে পাকিস্তানের বিভক্ত যে সময়ের ব্যাপার মাত্র- তা নিশ্চিত বলা যায়। আর সেই দেশটির বিভক্তির ক্ষতটা সহজে সরানো যাবে না। অন্তত যারা বেঁচে থাকবে, জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তারা এই ভয়াবহ স্মৃতি মনে রাখবে যে, দেশের অখণ্ডতা রক্ষার ব্যাপারে ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের পর তাদের ওপর কি তাণ্ডব চলেছিল। পেছনের মাংস ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেঁটে এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় ... ॥ ‘নরহত্যা ও নারী নির্যাতনের কড়চা’ বইতে মেজর রফিকুল ইসলাম (অব) লিখেছেন, ‘...শাঁখারী বাজার এলাকায় প্রতিটি ঘর থেকে যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, শিশু ও বৃদ্ধার লাশ তুলছে ডোম চুন্ন। চুন্ন ডোম জানায়, ‘২৯ মার্চ ঢাকা মিটফোর্ড এর লাশঘর থেকে লাশ বের করে ময়লার ডিপোতে ফেলার জন্য ট্রাকে তুলতে গিয়ে দেখি প্রতিটি লাশের বুক গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে আছে। মেয়েদের লাশের অধিকাংশের স্তন ছিল না। যৌনি পথ ক্ষত-বিক্ষত এবং পেছনের মাংস কাটা দেখেছেন। মেয়েদের লাশ দেখে মনে হয়েছে, তাদের হত্যার পূর্বে তাদের স্তন সজোরে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। যৌনি পথে লোহাড় রড বা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। যুবতী মেয়েদের যৌনি পথে এবং পেছনের মাংস যেন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়।’ আমরা সকল পাক সেনা মিলে ওকে ... ॥ একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভয়াবহ নৃংশসতার চিত্র ওঠে আসে মেজর রফিকুল ইসলামের লেখনিতে। তিনি আরও লিখেছেন, ‘...সাহেব আলী দুই গালে আঘাতের চিহ্ন দেখলেন। পরক্ষণই সাহেব আলী দেখলেন এক কিশোরীর উলঙ্গ লাশ। অপরূপ রূপসীর ফলের মতো টকটকে চেহারা, সারাদেহে বুলেটের আঘাত। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকে পাক সেনাদের এক মেজর পৌরসভায় টেলিফোনে সংবাদ দেন রোকেয়া হলের চারদিকে মানুষের পচা গন্ধে সেখানে বসা যাচ্ছে না। অবিলম্বে ডুম লাগিয়ে লাশ তোলে ফেলা হোক। সাহেব আলী ছয়জন ডুম নিয়ে রোকেয়া হলের প্রতিটি রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোন লাশ না পেয়ে চার তলার ছাদে গিয়ে ১৮ বছরের রূপসীর উলঙ্গ লাশ দেখতে পান। সাহেব আলী তার সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈনিক পাক সেনাকে জিজ্ঞেস করল, ছাত্রীর দেহে গুলির কোন আঘাত নেই, দেহের কোন স্থান কোন ক্ষত চিহ্ন নাই, অথচ মরে চিৎ হয়ে পরে আছে কেন। পাক সেনাটি অট্ট হাসিতে ফেঁটে পড়ে বলল, আমরা সব পাক সেনা মিলে ওকে ধর্ষণ করতে করতে...।’ ও মা গো, ও মা গো... ॥ ইমরান মাহফুজের ‘লালব্রিজ গণহত্যা’ বইতে, ’৭১ এ হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী আবুল হোসেনের জবানিতে বলা হয়েছে, ‘ কি বলব আর, সে সময়ের কথা মনে হলে কোন কথা বের হয় না। কে যেন মুখ ধরে রাখে। গুনু মিয়ার বাপ বলে জানতাম যাকে, সে হয়ে গেল পিস কমিটির চেয়ারম্যান। আরেকজন হলেন সেক্রেটারি। মুগু, হারেছ কাজ করত। কাজ মানে, পাকিস্তানী ক্যাম্পে ভাত রান্না করা। আমি সবার ছোট ছিলাম বলে পূর্ণ কাজ সম্ভব হতো না। তাই যোগালি (সহযোগিতা করা) দিতাম। বিনিময়ে প্রতিদিন দুই টাকা আর ভাতের মাড় খেতে পারতাম। এর মধ্যে আমাদের পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে প্রতিদিনের সংবাদ তথা কোথায় কী হচ্ছে তা যতটুকু সম্ভব পৌঁছে দেয়ার চেষ্টায় থাকতাম। একদিন আমাদের বলে আজ (ব্রিজ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে) ওইখানে গর্ত খুঁড়তে হবে। আমরা তো ভয়ে পাথর, কোন কথা বলতে পারছি না। পিস কমিটির চেয়ারম্যান ইউসুপ মিয়া, সদস্য আহমেদ বুকড়া বাধ্য করেছে সেখানে যেতে। তাদের এত প্রভাব ছিল যে কেউ তাদের কথা অমান্য করার সাহস করত না। সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত তাদের এই কাজ (গর্ত খোঁড়া) করতে হতো। চারটার পর আমাদের কাউকে থাকতে দিত না। তবে যে দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়েছে তা মনে করলে বেহুশ হয়ে যাই। চারদিকে মানুষের মুখ থেকে শুনা যেত ... ও আল্লাহ গো, ও আল্লাহ গো, ও মা গো, ও মা গো। এমন আর্তনাদ-আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে যেত। দ্বিতীয় দিন যখন আমাকে নেয়া হয়, সেদিন মনে হয় আমার জীবন যেন এখানে শেষ হয়ে যাবে। প্রথমে গিয়ে দুটি গর্ত খুঁড়ি। তাদের একজন অস্ত্র হাতে এসে বললো ... এই লোকটিকে ফেলে দে, এখনি ফেলে দে। আমি যেন জল্লাদ, গর্তের মধ্যে ফেলে দিলাম লোকটিকে। তখন আমার মাথা ঘুরছিল। একজন মানুষের মৃত্যু আমার হাতে! এও কী করে সম্ভব! ১৯৭১ সালে ২৮ জুন নিউজ উইক ‘টিক্কা খানের ভয়ঙ্কর রক্তস্নান’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ‘গত মার্চে পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাঙালীদের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংসতার খবর যাতে বহির্বিশে^ না পৌঁছাতে পারে, এজন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। অধিকাংশ বিদেশী সাংবাদিককে পূর্ব পাকিস্তানে যেতে দেয়া হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানী সাংবাদিকদের মধ্যে যারা সন্তোষজনক রিপোর্ট তৈরি করতে পারে, শুধুমাত্র তাদেরই পূর্ব পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। যাতে তারা বাঙালীদের বিদ্রোহ সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত করতে পারে। অবশ্য অন্তত একটি ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকারের পদক্ষেপ উল্টো কাজ করেছে। করাচীর একটি দৈনিকে কাজ করতেন ব্রিটিশ সাংবাদিক এ্যান্থনি মাসকারেনহাস। সানডে টাইমসে মাঝে মাঝে লিখতেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তিনি এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন যে, পুরো ঘটনা বিশ^বাসীকে জানানোর জন্য তিনি সপরিবারে পালিয়ে লন্ডনে চলে যান। গত সপ্তাহে টাইমসে লেখা এক প্রতিবেদনে মারকারেনহাস বলেন, পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষ তাকে বারবার বলেছে ‘পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিণ্নতার হুমকি চিরদিনের জন্য নির্মূল করবেন তারা। এজন্য যদি ২০ লাখ লোককেও হত্যা করতে হয়, প্রয়োজনে তারা তাই করবেন’। মারকারেনহাসের ভাষায় ‘সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে পুরাদস্তুর আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে ঠিক সে কাজটাই করছে তারা।’ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর রক্তের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। সাংবাদিক এবং অন্যান্য যারা, ভারতে আশ্রয় নেয়া ৬০ লাখ ভীত সন্ত্রস্ত শরণার্থীর অবস্থা সচক্ষে দেখে এসেছেন, এ কথার সত্যতা স্বীকার করছেন তারা।
×