ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ধ্বংসপ্রায় কর্ণফুলী, রক্ষার উদ্যোগ নেই

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০

ধ্বংসপ্রায় কর্ণফুলী, রক্ষার উদ্যোগ নেই

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্ণফুলী নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ দখল, ভরাট ও দূষণে ভয়াল রূপ নিয়েছে। ৮৬৬ মিটার প্রস্থের এ নদী এখন ৪০০ মিটারে হ্রাস পেয়েছে। নদীর স্বাভাবিক গতিশীলতা ও নাব্য রক্ষায় কার্যকর কোন প্রকল্প নেই। কর্ণফুলী ও চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষায় মাস্টারপ্ল্যানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রায় পৌনে দুই লাখ বর্গফুট নদী এলাকা একটি সমিতিকে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে লিজ দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, পানি আইন ও জাতীয় নদী কমিশন আইনে দ-নীয় অপরাধ করেছে। খেয়াল খুশিমতো লিজের কারণে কর্ণফুলীর হয়েছে সর্বনাশ। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের ব্যবহৃত অংশে নদী খনন, শাসন ও উভয় তীরে সীমানা প্রাচীর দেয়নি। এর ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ধ্বংস হয়েছে। সোমবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পেশ করা হয়েছে চার দফা দাবি। সংস্থাটি ‘টানা ২১ দিন কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত শাহ আমানত ব্রিজ থেকে ফিরিঙ্গীবাজার মনোহরখালী পর্যন্ত প্রস্থ জরিপ করেছে। বিএস শীট অনুযায়ী এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট, চিটাগং পোর্ট অথরিটি প্রণীত স্ট্রাটেজিক মাস্টার প্ল্যান চিটাগং পোর্টের জেনারেল ইনফরমেশন সিপিএ ল্যান্ড ইউজ ২০১৪ অনুযায়ী কর্ণফুলী প্রস্থ ধরে উক্ত জরিপ করা হয়েছে। জরিপে যে চিত্র উঠে এসেছে তা ভয়াবহ। শুধু তাই নয়, ধসে পড়তে পারে শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণপ্রান্ত। কর্ণফুলী ব্রিজ নির্মাণের সময় এডিবির মাস্টার প্ল্যান ও বিএস শীট অনুযায়ী এ নদীর প্রস্থ ছিল ৮৮৬ দশমিক ১৬ মিটার। জরিপে শাহ আমানত সেতুর নিচে বর্তমানে ভাটার সময় নদীর প্রস্থ পাওয়া গেছে মাত্র ৪১০ মিটার। জোয়ারের সময় চর অতিক্রম করে ৫১০ মিটার পর্যন্ত নদীর উত্তর পাড়ে পানি উঠে, ভরাট হয়ে যাওয়া সে অংশে কোন প্রকার নৌযান চলাচল করে না। নদী ভরাট হওয়ায় শাহ আমানত সেতুর মাঝ পিলারের পাশে অঘোষিত একটি যাত্রী পারাপার ঘাট তৈরি করেছে স্থানীয়রা। জোয়ার ভাটার সময় লিংক রোড থেকে অর্ধ কিলোমিটার নদীর অংশ হেঁটে যাত্রীরা ব্রিজের নিচে কর্ণফুলী নদীর মাঝখানে এসে উক্ত ঘাট থেকে সাম্পানে উঠে। জরিপে আরও উঠে এসেছে, রাজাখালি খালের মুখে নদীর প্রস্থ ৮৯৮ মিটার ছিল। যা এখন ৪৬১ মিটার। বিএস শীট ও এডিবি মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী চাক্তাই খালের মুখে প্রস্থ ছিল ৯৩৮ মিটার, এখন তা ৪৩৬ মিটারে হ্রাস পেয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্মিত মেরিনার্স পার্ক এলাকায় কর্ণফুলীর প্রস্থ ৯৮১ মিটার। বন্দর কর্তৃপক্ষ বর্তমানে সে অংশে খনন করেছে। খননের পর প্রস্থ হ্রাস পেয়ে হয়ছে ৮৫০ মিটার। এরপর ফিরিঙ্গীবাজার মোড়ে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ছিল ৯০৪ মিটার। বন্দরের খনন কাজের পর সেখানে কমে প্রস্থ হয়েছে ৭৫০ মিটার। অবশিষ্ট অংশে ইচ্ছেমত গাইড ওয়াল নির্মাণ করে চিরতরে বিলুপ্ত করে দেয়া হয়েছে। এ জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হয়েছে। জরিপে আরও পাওয়া গেছে, কর্ণফুলী ব্রিজের উত্তর অংশে ৪৭৬ মিটার নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় জোয়ার ভাটার সময় দক্ষিণাংশে ব্যাপক স্রোতের সৃষ্টি হয়। স্রোতের এ তীব্রতার চাপ দক্ষিণ প্রান্তে শাহ আমানত ব্রিজের সংযোগ সড়কের বর্ধিত অংশের পিলারে লাগছে। যা এ সেতুর জন্য বিপজ্জনক। বন্যা বা সাইক্লোন হলে এ ব্রিজের বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া রাজাখালি ও চাক্তাই খালের মোহনা কর্ণফুলী সেতুর মাঝ বরাবর সংযুক্ত হয়েছে। বৃষ্টি বা নদীতে জোয়ারের উচ্চতা বাড়লে ছোট হয়ে আসা কর্ণফুলী অংশে প্রবল চাপ সৃষ্টি হয় এবং পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। যে কারণে নগরী থেকে চাক্তাই ও রাজাখালি খালে প্রবাহিত পানি নদীতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়। আর এরফলে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ থেকে শুরু করে বহদ্দারহাট পর্যন্ত জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী কর্ণফুলী ব্রিজের পশ্চিম পাশে রাজাখালি খালের পূর্ব পাড়ে ভেড়া মার্কেট বস্তি, রাজাখালি ও চাক্তাইখালের সংযোগস্থলে সোনালী মৎস্য আড়ত, চাক্তাই খালের পশ্চিম পাড় থেকে ফিরিঙ্গীবাজার পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশন মেরিনার্স পার্কের পুরোটাই কর্ণফুলী নদী দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ, জেনারেল ইনফরমেশন সিপিএ ল্যান্ড ইউজ ২০১৪ প্ল্যানে এ সমস্ত মার্কেটের অস্তিত্ব নেই। সেই ম্যাপে এ স্থানে নদীর অস্তিত্ব দেখানো হয়েছে। এছাড়া বন্দর চ্যানেলের স্বাভাবিক স্রোতধারা অব্যাহত রাখতে, কর্ণফুলী ব্রিজ রক্ষা ও চাক্তাই খাতুনগঞ্জসহ নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়মিত জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করতে এবং কর্ণফুলী নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ঠিক রাখতে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করে মেরিন ড্রাইভ সড়কের কর্ণফুলীর তীর ধরে গাইড ওয়াল নির্মাণ জরুরী। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের পক্ষ থেকে চার দফা সুপারিশ পেশ করা হয়েছে। সুপারিশসমূহের মধ্যে রয়েছে, অবিলম্বে কর্ণফুলী মেরিনার্স পার্ক, সোনালী মৎস্য সমিতির লিজ বাতিল ও উচ্ছেদ, বরফকলসহ অন্য অবৈধ স্থাপনা ও ভেড়া মার্কেটসহ অবৈধ সকল স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ফিরিয়ে আনতে হবে। নিয়মিত ড্রেজিং করে প্রয়োজনীয় নদী শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাবাজার, সদরঘাট, চাক্তাই, রাজাখালি এলাকার নৌবন্দরসমূহ সচল ও মূল সমুদ্রবন্দর এলাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। নদীরপাড় স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করতে হবে। মেরিনার্স সড়কের নদীর পাড় বরাবর প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করতে হবে। প্রস্তাবিত ব্রিজ নির্মাণের সঙ্গে হাইড্রো মরফোলজিক্যাল মডেল স্টাডির মাধ্যমে কর্ণফুলীর মোহনা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত নদী এলাকায় প্রবাহ ও নৌচলাচল পথকে স্থিতিশীল করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল নদী শাসন, রিভেটম্যান এর কাজ সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নিতে হবে। উল্লেখ্য, নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন ও জেলা প্রশাসনের জরিপ বিএস রেকর্ড অনুযায়ী কর্ণফুলীর তীরে অবৈধ স্থাপনা ২ হাজার ১১২টি। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে ২ হাজার ১০৮টি, বেসরকারী সংস্থার ১টি ও সরকারী সংস্থার ৩টি স্থাপনা রয়েছে। অপরদিকে, আরএস রেকর্ড অনুযায়ী ৭৫টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে ৬২টি, বেসরকারী সংস্থার ৯টি ও সরকারী সংস্থার ৪টি স্থাপনা রয়েছে। কর্ণফুলী নদী রক্ষায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্টে রিট করে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইআরপিবি)। এর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনাসহ রায় দেয়। রায়ে ওই নদীর তীরে থাকা ২ হাজার ১৮১টি অবৈধ স্থাপনা সরাতে নির্দেশ দেয়া হয়। রায়ে অপসারণের বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকসহ বিবাদীদের দাখিল করতে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, বিষয়টি চলমান পর্যবেক্ষণ থাকবে। এরইমধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে নদীর উভয় পাড়ে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বাইরে রয়ে গেছে। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর মাঝ বরাবর বন্দরের দেয়া লিজে ভরাট করে যে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, বরফকল ইত্যাদি গড়ে তোলা হয়েছে এর সবই অবৈধ। এ নদীকে বাঁচাতে এসব স্থাপনা দ্রুততম সময়ে উচ্ছেদ আবশ্যক। বন্দরের প্রাণ হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। আর এ কর্ণফুলী নদীকে অবৈধ পথে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে যারা অনিয়মের মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধনে লিজ দিয়েছে তাদেরও চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা জরুরী। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান। উপস্থিত ছিলেন জরিপ পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ, অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া, অধ্যাপক ড. মোঃ ইদ্রিস আলী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ প্রমুখ।
×