ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিনহা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য ঘটনা এখনও স্পষ্ট নয়

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ১১ আগস্ট ২০২০

সিনহা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য ঘটনা এখনও স্পষ্ট নয়

চট্টগ্রাম অফিস, স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ টেকনাফে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যাকা-ের নেপথ্য ঘটনা এখনও সম্পূর্ণভাবে স্পষ্ট হয়নি। র‌্যাবের তদন্ত কার্যক্রম জোরালোভাবে চলছে। নিহত সিনহা টেকনাফে অবস্থান করে গুরুত্বপূর্ণ যেসব ভিডিও চিত্র ধারণ করেছেন তাকে হত্যার পর পুলিশ সেগুলোর কি করেছে তা এখনও জানা যায়নি। এই ভিডিও চিত্র নিয়ে গত ৩১ জুলাই সিনহা টেকনাফের তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সাক্ষাতকার নেয়ার পরই তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে মিশন সম্পন্ন করা হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে তথ্য রয়েছে। কিন্তু বিষয়টি এখনও শতভাগ নিশ্চিত নয়। তবে এই পর্যন্ত সিনহা হত্যাকাণ্ড নিয়ে যেসব তথ্য উদঘাটিত হয়েছে ইতোমধ্যে টেকনাফে মানব ও ইয়াবা পাচার নিয়ে ভিডিও চিত্র, ওসি প্রদীপ ও পুলিশের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রদীপের বক্তব্য গ্রহণের পরপরই তাকে হত্যার যে মিশন পরিচালিত হয়েছে তাই ঘটনার নেপথ্যের বিষয়গুলোকে ইঙ্গিতবহ করে তুলেছে। সিনহা হত্যাকা-ের পর পুলিশ যে দুটি মামলা দায়ের করে সে মামলাগুলো সোমবার আদালতের নির্দেশে র‌্যাবের কাছে অর্পণ করা হয়েছে। অপরদিকে, নিহত সিনহার আরেক সহযোগী সিফাতকে আদালত সোমবার জামিনে মুক্তি দিয়েছে। নাম্বার প্লেটবিহীন একটি মাইক্রোবাসে করে সাদা পোশাকধারী কিছু ব্যক্তি তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেছে। এর আগের দিন রবিবার মুক্তি পান সহযোগী শিপ্রা দেবনাথ। এদিকে, কারা ফটকে র‌্যাব যে চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তাদের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও ১০ দিন রিমান্ড চেয়েছে। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি আরও ৭ দিন সময় চেয়েছে। নিহত সিফাতের মা সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে পুত্র হত্যার সঠিক বিচার চেয়েছেন। জামিনে মুক্ত সিফাত ॥ নিহত মেজর সিনহার সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে দুটি মামলায় জামিন দিয়েছেন। পাশাপাশি সিফাত, শিপ্রার বিরুদ্ধে পুলিশ যে দুটির মামলা করেছে তার তদন্তভারও র‌্যাবের হাতে অর্পণ করা হয়েছে। সোমবার কক্সবাজার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালত এ আদেশ দিয়েছেন। সোমবার দুপুরে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর সিফাতকে একটি নম্বরবিহীন মাইক্রোবাসে করে সাদা পোশাকধারী কয়েক ব্যক্তি তার আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে জেলখানা প্রাঙ্গণ থেকে নিয়ে চলে যায়। মুক্তিপ্রাপ্ত সিফাতকে সাংবাদিকসহ কারও সঙ্গে কোন কথা বলতে দেয়া হয়নি। উল্লেখ করা যেতে পারে এর আগে রবিবার মুক্তি পান সিনহার আরেক সহযোগী শিপ্রা দেবনাথ। এছাড়া আরেক সহযোগী তাহসিন নূরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আগেই তার অভিভাবকদের জিম্মায় দেয়া হয়। এদের নিয়ে সিনহা কক্সবাজারের নীলিমা রিসোর্টে প্রায় এক মাস ধরে অবস্থান করছিলেন। প্রচার আছে সিনহা ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ভিডিও চিত্র নির্মাণ করছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে গত ৩১ জুলাই টেকনাফের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা করা হয়েছে। একটি মামলা হয়েছে টেকনাফে, আরেকটি হয়েছে রামু থানায়। উখিয়ায় দায়েরকৃত মামলায় আসামি সিফাত আর রামুতে দায়ের করা মামলায় আসামি শিপ্রা দেবনাথ। প্রসঙ্গত, মেজর সিনহাকে হত্যা করার সময় স্পটে ছিলেন সিফাত। তিনি একমাত্র এই হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষদর্শী। আদালতে সিফাতের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মোঃ মোস্তফা। জামিন মঞ্জুর হওয়ার পর তিনি আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের জানান, ‘আমরা পুলিশের সাজানো মামলা থেকে সিফাতের মুক্তি এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করে র‌্যাবের কাছে হস্তান্তরের আবেদন জানিয়ে ছিলাম।’ দুপুর ২টার পর কক্সবাজার কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে কারা ফটকে স্বজনদের দেখে কেঁদে ফেলেন সিফাত। এই সিফাত ঢাকার স্ট্যামফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ে ফিল্ম এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগে শিক্ষার্থী। চার আসামিকে ১০ দিনের রিমান্ডে আবেদন ॥ জেলগেটে এই মামলার চার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ সম্পন্ন হওয়ার পর তদন্ত সংস্থা র‌্যাবের পক্ষ থেকে সোমবার তাদের আরও ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আবেদনের উপর শুনানি বা কোন আদেশ দেয়া হয়নি। তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে আবেদনে জানানো হয়েছে, জেলগেটে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের কাছ থেকে যে বক্তব্য পাওয়া গেছে তা নিয়ে নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। তাই ১০ দিনের রিমান্ড দরকার। আসামিরা হচ্ছেÑ কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও এসআই লিটন। অপরদিকে, এই মামলার অন্যতম আসামি কিলার এসআই লিয়াকত আলী, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও এসআই নন্দলাল রক্ষিতকে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর থাকলেও তদন্ত সংস্থা র‌্যাব এদের কাউকে এখনও হেফাজতে নেয়নি। তদন্ত কমিটি আরও ৭ দিন সময় চেয়েছে ॥ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকা-ের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চার সদস্যের গঠিত তদন্ত কমিটি সোমবার আরও ৭ দিন সময় চেয়েছে। গত ৪ আগস্ট চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোঃ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ৪ সদস্যের এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে তাদের বেশির ভাগ কার্যক্রম সম্পন্ন করলেও পুরোপুরিভাবে তা শেষ না হওয়ায় সোমবার আরও ৭ দিনের সময় চেয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। প্রদীপের আস্থাভাজনরা আতঙ্কে ॥ প্রায় ২ বছর ধরে ওসির দায়িত্ব পালনকালে প্রদীপ কুমার দাশের যারা আস্থাভাজন ছিলেন এবং কখনও কখনও সাধারণ মানুষকে হয়রানি করেছেন তারা এখন চরম আতঙ্কে রয়েছেন। বিশেষ করে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে, তারা এখন সোচ্চার হচ্ছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রদীপের বিভিন্ন কুকর্মের ব্যবহার হতো দুটি টিম। একটি পুলিশের আরেকটি সাধারণ পাবলিকদের নিয়ে গড়া। যাদের প্রদীপ বিশেষ বিশেষ মিশনে নিয়ে যেতেন। প্রদীপের গায়েবি মামলার ভিডিও ॥ মেজর সিনহা হত্যার সপ্তাহখানেক আগে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের কিছু বক্তব্য ভিডিওতে ধারণ করা আছে। এসব বক্তব্য এখন ইউটিউবে প্রচার হচ্ছে। প্রদীপ এই ভিডিও ফুটেছে বলেছেন, ‘আগামী ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নির্মূলে তাদের বাড়ি ঘরে গায়েবি হামলা হবে। গায়েবি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটবে। গায়েবি আগুনে ছারখার হয়ে যাবে বাড়িঘর।’ প্রদীপের এই বক্তব্য শুনে নিরীহ অনেকে অন্যত্র পালিয়ে যান। বর্তমানে তারা নিজ নিজ ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। কমিউনিটি পুলিশিংয়ে রয়েছে প্রদীপের বহু অনুগত ॥ টেকনাফের কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমে রয়েছে তৎকালীন ওসি প্রদীপের অনুগত অনেকে। এরা মূলত প্রদীপের পক্ষে দালালির কাজ করত। অনেকে ইয়াবাসহ মাদক চোরাচালীনদের জন্য প্রদীপের দফারফা করত। শুধু তাই নয় এসব কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কিছু সদস্য প্রদীপকে গোপনে জানিয়ে দিত এলাকার মানুষের বিভিন্ন তথ্য। সেই অনুযায়ী প্রদীপ তার সিদ্ধান্ত নিত। এদের মধ্যে কারও থেকে টাকা আদায়, আবার কাউকে ক্রসফায়ারে দেয়া এবং আবার কাউকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে চালান দেয়া হতো। মামলার দুই আসামির খবর নেই ॥ সিনহা হত্যা মামলায় শেষোক্ত অর্থাৎ ৯ ও ১০ নম্বর আসামি হয়েছেন যথাক্রমে- এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোঃ মোস্তফা। এ মামলায় অভিযুক্তদের ৭ জন আত্মসমর্পণ করে এখন জেলে রয়েছেন। শেষোক্ত এই দুইজন এখনও আত্মসমর্পণ করেননি। টুটুল ও মোস্তফা নামের কোন পুলিশ আছে কিনা তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে দু’দফায় জানিয়ে দেয়া হয়েছে এ নামে কোন পুলিশ সদস্য কক্সবাজারে নেই। তবে তদন্ত সংস্থা এদের খোঁজ খবর নেয়ার কাজ জোরালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, নাম বিভ্রাটের কারণে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। ইলিয়াছ কোবরা প্রসঙ্গ ॥ টেকনাফের অধিবাসী ইলিয়াছ কোবরা। ঢাকার চলচ্চিত্র জগতে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। সিনেমা জগতে কোবরা নামে তার উপাধি। অভিনয়ের সূত্রে ইলিয়াছ ঢাকায় গিয়েও বাড়িঘর করেছিলেন। কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। পরে নিজ এলাকা টেকনাফে বাহারছড়ায় দ্বিতীয় বিয়ে করে সংসার জীবন অতিবাহিত করছেন। ৬৫ বছর বয়সের এই অভিনেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি মেজর সিনহা হত্যাকা-ের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত। তবে তিনি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছেন। ইলিয়াছ কোবরার পিতা ছিলেন মিয়ানমারের বাসিন্দা। বাংলাদেশ স্বাধীনের আগে তার পিতার পরিবার সীমান্ত অতিক্রম করে টেকনাফের বাহারছড়ার নোয়াখালী পাড়ায় বসতি স্থাপন করেন।
×