ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চাঁপাইয়ে পাগলা নদী ফিরে পেয়েছে হারানো যৌবন

নদীপাড়ে ওয়াকওয়ে ওয়াটার এ্যাম্বুলেন্স, বাড়বে চাষাবাদ

প্রকাশিত: ২২:১৮, ১৪ জুলাই ২০২০

নদীপাড়ে ওয়াকওয়ে ওয়াটার এ্যাম্বুলেন্স, বাড়বে চাষাবাদ

মামুন-অর-রশিদ, চাঁপাই থেকে ফিরে ॥ ভারতের ফারাক্কার পাদদেশ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্ত পেরিয়ে বয়ে আসা নদী ‘পাগলা’। এক সময় এই নদীটির উন্মাদনা আর প্রচ- স্রোতের কারণে স্থানীয় লোকজন এর নাম দিয়েছিলেন ‘পাগলা’। কিন্তু ফারাক্কার প্রভাবে দুই দশক আগে থেকে সে দিনের সেই পাগলা নদী ক্রমে তার নাব্য হারাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে নদীটি হারিয়ে যাচ্ছিল দেশের মানচিত্র থেকে। অনেকটা বিলীন হতে চলেছিল নদীটির অস্তিত্ব। তবে সরকারের ডেল্টা প্ল্যানের অংশ হিসেবে দেশের ৬৪ জেলার অভ্যন্তরে ছোট নদী, খাল ও জলাশয় খননের আওতায় এ নদীটিও খননের উদ্যোগ নেয়া হয়। নদীটি খননের ফলে আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ভরা মৌসুমের শুরুতেই এবার নদীটি পানিতে ভরে গেছে। বর্তমানে রূপ নিয়েছে সেই আগেকার পাগলা নদীর মতোই। পাগলা নদী চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সোনা মসজিদ এলাকা দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর শিবগঞ্জের কানসাট, তক্তিপুর, বহলাবাড়ি, ঘোড়াপাখিয়া পাড়ি দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার সতেরোরশিয়া, চামা হয়ে কালিনগর এলাকায় নদীটি মহানন্দা নদীর সঙ্গে মিলেছে। নদীটির গতিপথ ৪১ কিলোমিটার। খননের পর পুরো এলাকাটি এখন পানিতে ভরে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নদীটি নাব্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে একে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডেল্টা প্ল্যানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তৈরি করা হয় খনন প্রকল্প। সেটিকে ‘৬৪ জেলার অভ্যন্তরের ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনর্খনন (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পে রাখা হয়। পাগলা নদী খনন প্রকল্পের সঙ্গে সাড়ে ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঁচটি খালও আছে। সব প্রকল্পের কাজ শুরু হয় গত বছরের এপ্রিলে। পাগলা নদী খনন এখন শেষ পর্যায়ে। এরই মধ্যে যৌবন ফিরে পেয়েছে নদীটি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, নদীটি নির্ধারিত সময়ে খননে ছয়টি প্যাকেজে বিভক্ত করা হয়। এরপর উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নদী পুনর্খননের কাজ পায়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ আগামী নবেম্বর পর্যন্ত রয়েছে। তবে এরই মধ্যে খননের কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে (অল্প কিছু বাকি)। নির্ধারিত সময়েই এর খনন কাজ শেষ হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নদীটির খনন কাজ মোটেও সহজ ছিল না। নদীগর্ভ দখল করে ইটভাঁটি নির্মাণ, চাষাবাদ এবং নদীপাড়ে স্থায়ী-অস্থায়ী স্থাপনা গড়ে তুলেছিলেন অবৈধ দখলদাররা। তারা নদী খনন কাজে বাধা দেয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য, প্রশাসন এবং পাউবো কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টায় দখলদারদের উচ্ছেদ করে হারিয়ে যেতে বসা নদীটি উদ্ধার করা হয়েছে। প্রস্থে ৩৫ মিটার করে খনন করা হয়েছে দৈর্ঘ্যরে ৪১ কিলোমিটার। গড়ে গভীর করা হয়েছে অন্তত ৯ মিটার। নদীর ওপর রেহাইচর এলাকায় নির্মিত হচ্ছে একটা ব্রিজ। শনিবার সকালে সেই ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দা আফসার আলী বলছিলেন, বর্ষার কয়েক মাস ছাড়া সারাবছর হেঁটেই নদী পার হওয়া যেত। কিন্তু বর্ষাকালে একটু বেশি পানি থাকত। যার কারণে ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। নদীটাও খনন করা হলো। এখন নদীতে থৈ থৈ পানি। ব্রিজও হলো। আমরা খুব উপকৃত হলাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, এক সময় পাগলা নদী প্রচ- খরস্রোতা ছিল। ধীরে ধীরে নদীটি মরে যায়। এবার খননের ফলে নদী তার নাব্য ফিরে পেয়েছে। এরপর এবার নদী পাড়ের মানুষ যে পরিমাণ মাছ ধরেছেন তা বিগত ২০-৩০ বছরেও পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, নদীর পানি ব্যবহার করে দুই পাড়ে চাষাবাদও হচ্ছে খুব ভালভাবে। নদীটি যদি আগামীতেও এমনই থাকে, তাহলে বাংলাদেশ যে নদীমাতৃক দেশ তার স্বচ্ছ চিত্র এখানেই ফুটে উঠবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ডাঃ সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল বলেন, পাগলা নদী খননের ফলে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীতে মাছ বেড়েছে। এখন আমরা নদীর দুই পাড়ে বৃক্ষরোপণ করব। পাশাপাশি ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। এতে নদী পাড়ের সৌন্দর্য আরও বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, আগে নৌপথই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেত। এখন নদী নাব্য ফিরে পাওয়ায় একটা ওয়াটার এ্যাম্বুলেন্স কিনেছি। সেটা এই নদীতে চলবে। চরাঞ্চল থেকে রোগী আনার জন্য আমরা আরেকটি নৌ এ্যাম্বুলেন্স কিনব। সেটা দিয়ে ২০ মিনিটের মধ্যে চর থেকে রোগী এপারে আনা যাবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল আলম বলেন, নদী খনন প্রকল্পের ৯০ শতাংশেরও বেশি কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে। এরই মধ্যে নদীতে পানি এসেছে। প্রতিবছরই এখন পানি থাকবে। এই পানিটা এখন ধরে রাখতে হবে। সে জন্য একটা ড্যাম নির্মাণ করতে হবে। তাহলে বর্ষা শেষে পানি আবার নেমে চলে যাবে না। এতে জেলাবাসী সুফল পাবে। নদীর পানি ব্যবহার করে শুষ্ক মৌসুমে চলবে চাষাবাদ।
×