ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গাজীপুরের কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভ

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ৫ এপ্রিল ২০২০

গাজীপুরের কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভ

স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর ॥ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এক সপ্তাহ ছুটি বাড়ালেও পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা ১০দিন ছুটি কাটিয়ে ঝুঁকির মধ্যে রবিবার কাজে যোগ দিতে দল বেঁধে কারখানার গেইটে জড়ো হয়েছে। পরে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা ছুটির নোটিশ পেয়ে তারা আবার ফিরে গিয়েছে। রবিবার জেলার প্রায় সবক’টি পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল। তবে জেলায় প্রায় তিন’শ কারখানার উৎপাদন চালু অব্যহত ছিল। এদিকে করোনা ঝুঁকির মাঝে শ্রীপুরের এক পোশাক কারখানা চালু রাখায় ওই কারখানার শ্রমিকরা এদিন বিক্ষোভ ও মহাসড়ক অবরোধ করেছে। মন্ডল গ্রুপের কোনাবাড়ি এলাকার কটন ক্লাব পোশাক কারখানার জিএম আমিনুল ইসলাম জানান, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে ৪এপ্রিল পর্যন্ত এ পোশাক কারখানাটি ছুটি ঘোষণা করা হয়। ৫ এপ্রিল (রবিবার) হতে কারখানাটি চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিজিএমইএ ওই ছুটি ১১এপ্রিল পর্যন্ত বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন। শনিবার রাত ১০টার দিকে এ সংবাদ জানতে পেরেছি। ছুটির এ ঘোষণার এ সিদ্ধান্ত রাতে শ্রমিকদের জানানো সম্ভব হয়নি। ফলে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে রবিবার সকালেই কারখানায় চলে আসে। এসময় কারখানা না খুলে ছুটির নতুন সিদ্ধান্ত জানিয়ে তাদেরকে আগামী ১১এপ্রিল আসতে বলা হয়েছে। ১১এপ্রিল কারখানা খুললে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধের কথা ঘোষনা দেওয়া হবে। একই কথা জানিয়ে গরীব এন্ড গরীব সোয়েটার কারখানার পরিচালক মো. ফজলুল হক, ওডেসা পোশাক কারখানার ব্যবস্থাপক সৈয়দ মাহবুবুল বারী, গড়গড়িয়া মাস্টার বাড়ি এলাকার মেঘনা নিট কম্পোজিট লিমিটেড কারখানার এজিএম মো. ইকবাল হোসেন জানান, বিজিএমইএ’র ছুটি বাড়ানোর এ ঘোষণা আগের ছুটি শেষ হওয়ার আগেই দেয়া উচিৎ ছিল। গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের ইন্টিলিজেন্স শাখার ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মোঃ ইসলাম হোসেন জানান, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ি ছুটি ঘোষণা করে গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানা বন্ধ রাখা হয়। তবে রবিবার পর্যন্ত জেলার ডেগেরচালা এলাকার এমাজিন ফ্যাশন, ছয়দানা এলাকার ইস্ট ওয়েস্ট ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্ক, শ্রীপুরের বহেরারচালা এলাকার নান্তাবুর গ্রুপের তাকওয়া গার্মেন্টস, বড়বাড়ি এলাকার পাক ষ্টার বাংলাদেশ লিমিটেড সহ প্রায় আড়াইশ’ থেকে ৩শ’ পোশাক কারখানার উৎপাদন অব্যহত রয়েছে। এদিকে করোনা ঝুঁকির মাঝে শ্রীপুরের গড়গড়িয়া মাষ্টারবাড়ি এলাকার প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল কারখানা চালু রাখায় ওই কারখানার শ্রমিকরা রবিবার বিক্ষোভ ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেছে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কারখানার অপারেটর জুয়েল মিয়া জানান, ৯বছর ধরে কাজ করছি। করোনার পরিস্থিতিতে অন্যান্য পোশাক কারখানাগুলো ১০দিনের ছুটি দিলেও এ কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম অব্যহত রয়েছে। ছুটি কাটিয়ে রবিবার শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে গেলে কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, ছুটির মধ্যেও যারা কারখানায় কাজ করেছে শুধু তারাই এখন এ কারখানায় কাজ করবে। এসময় অন্যদের কারখানা এলাকা থেকে চলে যেতে বলেছে। এতে শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিক্ষোভ ও কারখানার পার্শ্ববর্তী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে। একই কারখানার হেল্পার ফারুক জানান, গত ২৬ মার্চ মাইকে ঘোষনা দিয়ে কারখানাটি ছুটি দেয় কর্তৃপক্ষ। ফলে শ্রমিকরা কাজ না করে ছুটিতে চলে যায়। কিন্তু ছুটি চলাকালে কর্তৃপক্ষ কিছু শ্রমিককে ফোনে ডেকে নিয়ে কারখানার উৎপাদন কাজ চালিয়েছে। যারা ছুটিতে গেছে তাদেরকে রবিবার কাজে যোগ দিতে দেয়নি। বাইরে তালা লাগিয়ে অন্যদের দিয়ে কারখানার ভেতরে কাজ অব্যাহত রাখা হয়েছে। এমতাবস্থায় বেতন না দিয়ে শ্রমিকরা ছাঁটাই আতঙ্কে ভুগছে। এব্যাপারে গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের ইন্সপেক্টর মো. আসাদুজ্জামান জানান, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ি ওই কারখানা চলেছে। কিন্তু অধিকাংশ শ্রমিককেই ফোনে না জানিয়ে ১১এপ্রিল পর্যন্ত ছুটির নোটিশ দেয় কর্তৃপক্ষ। তবে কারখানার ভেতরে কিছু লোক মেইন্টেনেন্সের কাজ চলালেও তাতে উৎপাদন কাজ বন্ধ ছিল। কিন্তু পুর্বের সিদ্ধান্ত মতে রবিবার সকালে কাজে যোগ দিতে না দেয়ায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করে। ভেতরে কারখানার উৎপাদন কাজ চলছে ভেবে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে ও পাশের মহাসড়কে অবস্থান নেয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। পুলিশ কর্মকর্তা আরো জানান, শ্রীপুর এলাকায় ১০দিন বন্ধ থাকার সময়ও নিজ দায়িত্বে কিছু কারখানা চলেছে। গাজীপুর সদরের হোতাপড়া এলাকায় এনার্জিপ্যাক ফ্যাশন লিমিটেড কারখানার ব্যবস্থাপক মো. সফিকুল ইসলাম রাজীব জানান, করোনা সংক্রমন রোধের সকল ব্যবস্থা রেখেই আমরা কারখানা (অর্থাৎ নিরাপদ দূরত্ব, তাপমাত্রা মাপা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া) চালু রেখেছি। আগের ১০দিন বন্ধ ছিল। যেগুলোর ক্রয়াদেশ আছে আমরা সেগুলোর কাজ করছি। এখনও জার্মান মার্কেট খোলা আছে। কারখানা বন্ধ রাখলে জার্মানীতে আমাদের অর্ডারগুলো বাতিল হয়ে যাবে। তাই আমরা উৎপাদন অব্যাহত রেখেছি। আমাদের জনবল সাড়ে চার হাজার। সকলেই নিরাপদে কাজ করছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কারখানার কয়েক কর্মকর্তা ও শ্রমিক জানিয়েছেন, কারখানা কর্তৃপক্ষের এসব নিরাপত্তায়ও করোনা সংক্রমন থেকে তারা নিরাপদে থাকার ভরসা পাচ্ছেন না। তাই এ বিপদকালীন সময়ে তারা ঘরে থাকার ছুটি চাচ্ছেন। গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানার একাধিক শ্রমিক জানান, ২৬মার্চ ছুটি পেয়ে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা ১১এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি বাড়ানোর কথা জানতেন না। পূর্ব ঘোষণানূযায়ী শ্রমিকরা রবিবার কাজে যোগ দিতে কারখানায় গিয়েছিলন। কিন্তু মালিকপক্ষ ছুটি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে কারখানার গেইট থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তবে আমরা কবে বেতন পাব, তা জানতে চাইলে কারখানা কর্তৃপক্ষ তারিখ না জানিয়ে শুধু পরে দেয়া হবে বলেছে। অথচ এখন আমাদের হাত খালি। বাড়ি ভাড়া, দোকান বাকি দিতে হবে। এনিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু জানান, পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে এরকম ক্রাইসিস মুহুর্তে অনেক কারখানা মালিকরা শ্রমিক ছাটাই করে থাকে। চট্টগ্রামের কর্নফুলী ইপিজেড’র ইন্টিমেট এপারেলস কারখানার এক শ্রমিক তাকে জানিয়েছেন, কারখানা কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে যেসব শ্রমিকদের চাকুরীর বয়স ৬মাসেরও কম, তাদের নাকি ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করছেন। শুধু তাই নয় শ্রমিকরা শ্রমঘন এলাকায় করোনা ভাইরাস থেকে কতটুকু নিরাপত্তা পাবেন তা নিয়েও আতঙ্কে আছেন তারা। ৪১লাখ শ্রমিকদের কারখানা কর্তৃপক্ষ কিভাবে করোনা সংক্রমনের নিরাপত্তা দেবেন? সামনে ঈদ, শ্রমিকরা পুরো মাসের বেতন পাবে কি-না তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি আরো বলেন, শ্রমিকরা চাকুরি রক্ষা করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেঁটে, ট্রাকে ও ভ্যানে করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কারখানার কাজে যোগ দিতে এসেছে। অথচ শ্রমিকরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসার পর বিজিএমইএ পক্ষ থেকে গার্মেন্টস বন্ধ রাখার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। বিষয়টি শ্রমিকদের সঙ্গে তামাশা বলে মনে হচ্ছে। কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রমিকরা যাবে কোথায় সেটি নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে ইতোমধ্যে যারা গাজীপুর ও ঢাকায় চলে এসেছে তারা যেন এখানেই অবস্থান করে, আর যারা এখনো বাড়ি থেকে আসেনি তারা যেনো ১১ তারিখের আগে কোনোভাবেই না আসে। মালিকপক্ষ যাই বলুক না কেন তাদেরকে গ্রামে থাকার জন্য আমাদের আহ্বান রয়েছে। এক্সপোর্টার্স এসাসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সদস্য মো. আব্দুস সালাম মোর্শেদী জানান, ৫এপ্রিল পোশাক কারখানা খুলছে। পোশাক শ্রমিকদের সবেতনেই ছুটি দেয়া হয়েছে। তাদের বেতনের কোন সমস্যা হবে না। আশুলিয়া এলাকায় কারখানার মালিকদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। এতে ১২-১৫এপ্রিলের মধ্যে যাতে সকলেই বেতন-ভাতা প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া কারখানায় করোনা সংক্রমন রোধে সকল সতর্কতা ও প্রতিরোধী ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক শনিবার রাতে জানিয়েছেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ১১এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখার জন্য সকল কারখানা মালিক ভাই-বোনদের বিনীত অনুরোধ জানিয়েছি। একই সঙ্গে শ্রমিক ভাই-বোনদের আশ্বস্ত করতে চাই। তারা মার্চের বেতন পাবেন। এনিয়ে শ্রমিকদের শঙ্কিত হবার প্রয়োজন নেই। একইভাবে ছুটিতে চাকুরীক্ষেত্রে অনুপস্থিতির কারণে তারা চাকুরি হারাবেন না। অনেকে ছাটাই আতঙ্কে ভুগছেন। এ ব্যাপারে সকল কারখানা মালিক ভাই ও বোনদের মানিবিক বিবেচনার অনুরোধটুকু করেছি। আইইডিসিআর’র পরিচালক মিরজাদী ফ্লোরা জানান, যে কোন জনসমাবেশ এড়িয়ে চলতে হবে। সে-টা যে কোন প্লাটফর্মেই, যে কোন পরিসরেই হোক না কেন। সে-টা করোনা সংক্রমনের আশঙ্কা বাড়বে। এ মূহুর্তে আমাদের সামাজিক দূরত্ব নীতি অবশ্যই মানতে হবে। তা না হলে আমরা ঝঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। পোশাক শ্রমিকদের বাইরে থেকে কর্মস্থলে যোগ দেয়া ঠিক হবে কিনা এ বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সর্বত্র এ রোগী ঘুরে বেড়াচ্ছে না। আমাদের দেশে এখনও করোনা রোগী সীমিত পরিসরে রয়েছে। শ্রমিকরা বাইরে থেকে ঘুরে এসছে বলেই তাদে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে তা নয়। তবে তারা ছুটিতে যেভাবে এসেছে সেটা ঠিক হয়নি। এখন আবার ঘর থেকে বের হওয়া ঠিক হবে না। তাদের সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে। কোনভাবেই এক সঙ্গে জমায়েত হবে না। তাদের প্রত্যেককে ঘরের মধ্যে থাকতে হবে।
×