ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মিসেস মরিয়ম খানম

চিরঅম্লান স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৮:৩৬, ২৯ মার্চ ২০২০

চিরঅম্লান স্মৃতি

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ ছোট একটি দেশ বহু আন্দোলনের সূতিকাগার আমাদের প্রাণপ্রিয় সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে বহুদিনের পরিশ্রম, লড়াই, কারাভোগের যন্ত্রণা সয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে যিনি সুন্দর স্বাধীন দেশটি আমাদের সাত কোটি মানুষকে উপহার দিয়েছিলেন, তিনি আর কেউ নন- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি মাথার মুকুটসম আমাদের হৃদয়-মন্দিরের সমৃদ্ধ আসনে বসে রয়েছেন সমগ্র দেশ ও জাতির অস্তিত্বে মিশে একাকার হয়ে। তিনি বিশ^বন্ধু হয়েছেন তাঁর কর্মকা- ও অসাধারণ ৭ মার্চের ভাষণের জন্য। তাঁর মতো বিরল চরিত্রের মহান দেশপ্রেমিক মানুষ আমরা হয়তো আর পাব না। সত্যিই তিনি অনন্য। এই জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে আমার স্কুলজীবনের একটা ছোট্ট মধুর স্মৃতি রয়েছে। আমি তখন যশোর সরকারী মনমোহিনী বালিকা বিদ্যালয়ের নিউ টেনের ছাত্রী। আমার বড় দি ছিলেন ওল্ড ট্রেনের ছাত্রী। বাবা সে সময় যশোরে জেলা আনসার এ্যাডজুটেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আমি গার্লগাইড লিডার ছিলাম। ১৯৭৪ সাল। আমাদের প্রধান শিক্ষিকা শ্রদ্ধেয় প্রয়াত ফাতেমা আপা আমাকে তার দফতরে ডাকলেন। বললেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যশোর আসবেন। মশিউর রহমান স্মৃতিফলক উন্মোচন করতে। তুমি গার্লস টিম নিয়ে তাঁকে ফুলেল অভ্যর্থনা জানাবে সম্মানের সঙ্গে। ঠিক আছে?’ বললাম, ‘আচ্ছা আপা।’ স্কুলের পাশে টেনিস ক্লাবের মাঠ। তার পাশে স্মৃতিফলক রয়েছে। সমান মঞ্চাকারে সীমিত আয়োজন। জনাব মরহুম মশিউর রহমান কে ছিলেন, তখন জানতাম না। তবে পরে পেপার পড়ে ঝাপসা মনে আছে তিনি যশোরের বিশেষ ব্যক্তিত্ব বা বঙ্গবন্ধুর কাছের কেউ বা তাঁর প্রিয় সহযোগী নেতা হবেন হয়তো। আমি যথারীতি খুব সকালে আমার টিম নিয়ে সেখানে নির্দিষ্ট স্থানে হাজির হলাম, তারিখটা মনে নেই। সকালে গোলাপ ফুলের পাঁপড়ি হাতে নিয়ে দুই সারিতে দাঁড়ালাম। আমি রঙিন ফুলের বড়ো মালা হাতে ফলকের কাছে শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে কৌতূহল মনে অপেক্ষায় থাকলাম। মনে মনে জাতির পিতাকে কাছ থেকে দেখার অপূর্ব সুযোগ পেয়ে আবেগে আপ্লুত। ঠিক সময়ে সেই অমিত সাহসী দীর্ঘদেহী আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আয়োজনমঞ্চে খালি পায়ে প্রবেশ করলেন। আমি কিশোরী মনের শিহরিত আবেগ নিয়ে অপলক চেয়ে থাকলাম। সাদা পাঞ্জাবি, মুজিব কোট, ভুবনজোড়া খ্যাতির মানুষটিকে বড়োই পবিত্র মনে হচ্ছিল। ফুলের পাঁপড়ি ছিটানোর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মুগ্ধ নয়নে দেখলাম তিনি ও তাঁর পাঁচ-ছয়জন সঙ্গী নিয়ে খুব সাধারণভাবে এগিয়ে এলেন হাসিমুখ নিয়ে। জেলা প্রশাসক মহোদয় হয়তো ছিলেন। পরে তিন-চারজন পুলিশ প্রটেকশন নজরে এল। তিনি আমাদের মেয়েদের অভ্যর্থনা পেয়ে বড়োই খুশি হলেন। মাথায় আমি সুন্দর মালাটি তাঁকে সালাম দিয়ে পরাতে উদ্যত হলাম। আমি খাটো মেয়ে, উনি ঝুঁকে নিচু হয়ে আমার হাত থেকে মালাটি পরলেন। দেশপ্রেমিক বীর বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা আনন্দচিত্তে আমার মাথায় হাত রেখে হাসিমুখে আশীর্বাদ করলেন। কুশলবিনিময় করলেন। তাঁর সস্নেহ আদরে আমি স্তম্ভিত, বাক্্রুদ্ধ। আজও ভুলিনি সে দৃশ্যপট। আমার চোখে জ্বলজ্বল করছে। এই সুন্দর মুহূর্তটির আজ এতবছর পর আমার সেই ছোট্ট মনের অব্যক্ত গল্পটি প্রকাশ করলাম। মনের ভেতরে সেকি শিহরণ। বাংলার মহামূল্যবান রতœ জাতির পিতাকে খুব কাছ থেকে দেখা চাট্টিখানি কথা! অভূতপূর্ব সে দৃশ্য! বঙ্গবন্ধুর গর্জনে ইতিহাস আলিঙ্গন করেছে তাঁকে। সেই গর্বিত বীর মানুষটিকে বড় অকালে চলে যেতে হলো- এদেশ ছেড়ে চিরকালের মতো। আফসোস। তবে বিশ^বন্ধুর সেই ছবিটি আমার স্বচ্ছ হৃদয়ের আয়নায় অঙ্কিত হয়ে থাকবে চিরকাল। কবির ভাষায় বলতে চাই, ‘ভরা থাক স্মৃতি সুধায় বিদায়ের পত্রখানি মিলনের উৎসবে তাই ফিরায়ে দিও আনি।’ আমার স্কুলজীবনের এই সুন্দর ছোট্ট স্মৃতিটুকুর গল্পটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি বলতে ইচ্ছে হয়েছে বারংবার। কিন্তু সে সুযোগ আজও হয়নি। অপেক্ষাটা থেকেই গেল। পরিশেষে এটুকুই বলতে চাই, মুজিববর্ষের এই মহা আয়োজনে শেষ স্মৃতি হিসেবে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে এসে বাঙালীর জীবনে যে ইতিহাস তৈরি হয়েছে, তারই নাম বাংলাদেশ। ‘মুজিব’ তোমায় মনে পড়ে সংগীতের সম্মোহনের বেহালার টানে... মনে পড়ে সেই স্মৃতিটুকু... কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়- ‘ছিঁড়ে গেছে তার বাজিবে না আর হাসিও হারিয়ে গেছে আছে শুধু স্মৃতির হাহাকার।’ লেখক : সাহিত্যসেবী
×