ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভালবাসার ফাল্গুন ফাল্গুনের ভালবাসা

প্রকাশিত: ১০:৪০, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ভালবাসার ফাল্গুন ফাল্গুনের ভালবাসা

তোমার গোপন কথাটি/সখী, রেখো না মনে/শুধু আমায় বোলো/আমায় গোপনে- কবিগুরুর উচ্চারণে এই গোপন কথাটি প্রেমিকার মনের গভীরে সযতনে লুকিয়ে রাখা প্রেমের কথা, ভালবাসার কথা। প্রেমিক কবি নিশ্চিত যে, এই প্রেম তাঁর জন্য নিবেদিত। তাইতো শুধু তিনি নিজেই এই কথাটি প্রেমিকার কাছ থেকে শুনতে চান গোপনে। প্রেম-ভালবাসা মূলত প্রেমিক-প্রেমিকার গোপন কথা, গোপন সম্পর্ক। যে কথাটি জনসমক্ষে বলা যায় না- শুধু একজন আরেকজনের চোখে চোখ রেখে, হাতে হাত রেখে, বুকে দুরুদুরু কম্পন নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠেÑ সেটাই ভালবাসার কথা, প্রেমের কথা। তাই কখনও কখনও প্রেমিক কবির মনের চাওয়া আর ভালবাসার চাওয়া এক হয়ে যায় এভাবেÑ ভালবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে/ ‘চলো’ যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাই/ যাবে?-হেলাল হাফিজ হাজার বছরের মানব-মানবীর সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে যে ভালবাসা, তা এসে এখন পৌঁছে গেছে ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালবাসা দিবস উদযাপনের উৎসবমুখর পরিবেশে। পৃথিবীর নানা দেশে এ দিনটি উদযাপিত হয় প্রেমিক- প্রেমিকার একান্ত দিন হিসেবে। এ দিনে তারা নিজেদের মতো সময় কাটায়, ঘুরে বেড়ায়, একসঙ্গে রেস্টুরেন্টে বা কফি শপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একজন আরেকজনের সঙ্গ উপভোগ করে। কেউ কেউ দামী উপহার দিয়ে গভীর ভালবাসার প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। কেউবা দামী পাথরের আংটি দিয়ে বাগদান পর্বও সম্পন্ন করে। কার্ড আর ফুলের ব্যবসা হয়ে উঠে রমরমা। খাবারের দোকানগুলো অধিক মুনাফার হিসাব করে রাখে বছরের শুরুতে। একই দৃশ্য চোখে পড়ে আমাদের দেশেও। যে দিনের কথা শত শত বছর কেউ জানত না, নব্বইয়ের দশকে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক যায় যায় দিন-এর হাত ধরে এটির আবেদন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তরুণ সমাজে। তারপরও এই বিশেষ দিনটি এ প্রান্তের বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা যেভাবে উদযাপন করে, তাতে কিছুটা ভিন্নতা চোখে পড়ে। শীতের জীর্ণ পত্রপল্লব ভেদ করে জেগে ওঠে বসন্তের নতুন পাতা, নতুন ফুলের কুঁড়ি। শুরু হয় মৃদুমন্দ বাতাসের দোলা লাগা পহেলা ফাল্গুনের ভোর। একইসঙ্গে ভ্যালেন্টাইনস ডের মিষ্টি সুরের মূর্ছনা ভেসে আসে মধ্য ফেব্রুয়ারির আকাশে বাতাসে। ভালবাসা দিবস আর পহেলা ফাল্গুন পাশাপাশি হাত ধরে হেঁটে চলে প্রেমিক-প্রেমিকার মতো। দু’জনের শরীরে নানা বর্ণের নানা ছন্দের কাঁপন, দু’জনের কণ্ঠে ভালবাসার গান, নতুন দিনের সুর – মধুর মধুর ধ্বনি বাজে/ হৃদয় কমল বন মাঝে। দু’জন দু’জনকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, হাতের শক্ত মুঠিতে সারাজীবন ধরে রাখতে চায় প্রেমাস্পদের হাতখানি। এ জীবনের চাওয়া, যৌবনের চাওয়া। তাইতো দু’জনের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়Ñ তোমার জন্য সকাল, দুপুর তোমার জন্যে সন্ধ্যা, তোমার জন্য সকল গোলাপ এবং রজনীগন্ধা।Ñহেলাল হাফিজ দুজন তরুণ-তরুণী তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নিয়ে গোলাপ, রজনীগন্ধা হাতে এগিয়ে চলে অমর একুশে গ্রন্থমেলার বিশাল প্রাঙ্গণে। ওখানে তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আরও অনেক জুটির সঙ্গে, যারা সারা বছর ধরে প্রতীক্ষার প্রহর গোণে এই দিনটির জন্য। যারা তাদেরই মতো একে অপরকে প্রেমের কবিতার বই, ছোটগল্প অথবা উপন্যাস উপহার দিয়ে পরস্পরের ভালবাসা আদান-প্রদান করে থাকে। বিশ্ব ভালবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন আর একুশের বইমেলা হয়ে ওঠে একে অপরের পরিপূরক। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, ভালবাসা দিবসের অনুষঙ্গ হচ্ছে পহেলা ফাল্গুন আর বইমেলা। যে ভালবাসা দিবসে প্রেমিক কবি তাঁর প্রেমিকার কাছে চিঠি পাঠায় এই বলে – কিন্তু তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকব না, —প্রতীক্ষা করবÑরফিক আজাদ আর তখন প্রেমিকার কোমল মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, প্রতীক্ষার প্রহর গোণে সে আপনমনে। এই ভালবাসা দিবসের ঠিক শুরুটা হয়েছিল কবে থেকে? ভ্যালেন্টাইনস ডে অথবা সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে– ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখের দিনে ভালবাসার মানুষের কাছে ফুল বা অন্য কোন উপহার পৌঁছে দিয়ে নিজের ভালবাসার কথাই প্রকাশ করা হয়ে থাকে। মূলত প্রাচীন যুগে রোমানরা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে লুপারকেলিয়া উৎসবের আয়োজন করত। বসন্ত আগমন উৎসব ও উর্বরতার লাভের সময় হিসেবে এটাকে বিবেচনা করা হতো। লটারির মাধ্যমে নারী-পুরুষের জোড়া মেলানোর পর্ব ছিল এই উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। পঞ্চম শতাব্দীতে পোপ গিলেসিয়াস ওয়ান লুপারকেলিয়া উৎসবকে ভ্যালেন্টাইনস ডের উৎসবে রূপান্তরিত করেন। চৌদ্দশত শতাব্দীতে এসে এটি প্রেম-ভালবাসা-রোমান্সের একটি বিশেষ দিন হিসেবে পালন করা শুরু হয়। এই দিনের নামটি গ্রহণ করা হয়েছে একজন পাদ্রির নামানুসারে, যিনি ২৭০ খ্রিস্টাব্দে স¤্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস কর্তৃক নিগৃহীত ও নিহত হন। এই লোককাহিনী অনুযায়ী, এক রূপসী কন্যাকে এই পাদ্রি চিঠি লেখেন, যার শেষে লেখা ছিল– ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন। কথিত আছে এই কন্যাটিকে তিনি অন্ধত্ব থেকে ভাল করে দেন এবং তার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অন্য সূত্রে জানা যায় যে, টেরনি অঞ্চলের একজন বিশপ ছিলেন সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন, যার নামানুসারে ভালবাসা দিবসের নাম রাখা হয়েছে। এই দু’জন পাদ্রির একই ব্যক্তি হবার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আরেকটি লোককথায় বর্ণিত আছে যে, সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন স¤্রাটের আদেশ অমান্য করে তরুণ-তরুণীদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। এর আগে স¤্রাট যুদ্ধক্ষেত্রে তরুণদের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য রাজ্যে বিয়ে প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এই কাজের শাস্তি হিসেবে তাঁকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করা হয়। পরবর্তীকালের ইতিহাসে এই দিনের সঙ্গে ভালবাসার একটি নিবিড় সংযোগ স্থাপন করা হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এই দিনকে উপলক্ষ করে বিশেষ বার্তা আদান-প্রদান করা হতো, যা ভ্যালেন্টাইনস নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। ব্যবসায়িকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এ উপলক্ষে কার্ড ছাপানো শুরু হয়। এই কার্ডগুলোতে হৃদয়ের আকৃতি নিয়ে ছবি ও রোমান প্রেমের দেবতা কিউপিড-এর ছবি যুক্ত থাকত। ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ থেকে পাাখিদের মিলনের উপযুক্ত সময় শুরু হয় বলে মনে করা হয়ে থাকে। তাই পাখিকেও এদিনের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। ভালবাসা দিবসের ঐতিহ্যবাহী উপহার হচ্ছে ক্যান্ডি ও নানারঙের ফুল। বিশেষ করে লাল গোলাপ প্রেম ও সৌন্দর্যের একটি অসাধারণ প্রতীক হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। গত কয়েকশ’ বছর ধরে চলে আসা এই দিনটি বিশেষভাবে পালনের রীতি একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেশে দেশে আরও বেশি বিস্তার লাভ করেছে। এখন ভালবাসা দিবস মানে কফি শপ আর রেস্টুরেন্টগুলোতে তরুণ-তরুণীদের উপচে পড়া ভিড়। পার্ক আর বড় বড় উদ্যানে প্রেমিক-প্রেমিকার হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো। সিনেমা হলে বা শপিং মলে নতুন কোন সিনেমা বা উপহার কেনার ছলে নিজের মনের কথাটি প্রিয়জনের কাছে নিবেদন করা। ফাল্গুনের মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলতে থাকে প্রেমিক-প্রেমিকার মন। বইমেলায় রঙিন পোশাকে আবৃত হয়ে দু’জন দু’জনার হয়ে কখনও কফি খায়, কখনও বা প্রেমের কবিতা – গল্প খুঁজে বেড়ায় বিভিন্ন স্টলে। এত লোকজনের ভিড়েও তারা দু’জন দু’জনকে দেখতে থাকে- কখনও সরাসরি কখনও বা আড়চোখে, স্বপ্ন বুনতে থাকে আগামী দিনের। মাত্র দুই দশক আগেও যে প্রেমের কথা, যে গোপন কথা নিবেদনের মাধ্যম ছিল ফুল, লতাপাতা, হৃদয়ের আকৃতি দিয়ে ভরপুর নীল কাগজ, যাতে লেখা থাকত – সে আমার গোপন কথা/ শুনে যা ও সখী। সেই নীল চিঠি গোলাপের পাপড়ি দিয়ে মাখামাখি হয়ে কোন কবিতার বইয়ের ভাঁজে পৌঁছে যেত প্রেমিকার কাছে। আজ তাতে লেগেছে পরিবর্তনের মাতাল হাওয়া। ভালবাসা দিবসের নানা কথায় নানা ছবিতে প্লাবিত হচ্ছে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম। ভার্চুয়াল জগতের নানা উপাদান নতুন নতুন রং ছড়াচ্ছে প্রেমিক হৃদয়ে। মন প্রাণ আন্দোলিত হচ্ছে টুংটাং শব্দে। রাত জেগে জেগে মোবাইলের নীল আলোতে বেঁধে ফেলছে জীবনের তানপুরার তার। তবে ভালবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন ও বইমেলা– এই তিনটি উৎসব সববয়সী মানুষদের সমানভাবে রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এসব উৎসব জাতীয় জীবনে নিঃসন্দেহে আনন্দের ফল্গুধারা প্রবাহিত করছে। ভালবাসা শুধু একটি মানুষের সঙ্গে নয়, ভালবাসা হতে পারে আশপাশের অনেক মানুষের সঙ্গেও প্রেমিকার ভালবাসাই একমাত্র ভালবাসা নয়। বাবা-মা, ভাই-বোন-স্ত্রী-সন্তান, সহকর্মী ও বন্ধু- সকলের সঙ্গে হৃদয়ের যে বন্ধন, সেটাও ভালবাসারই বন্ধন। দেশের জন্য ভালবাসা ও দেশের মানুষের জন্য ভালবাসা এক অপূর্ব অনুভবের স্পন্দন শুধু নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা দায়িত্ব ও কর্তব্যের তাড়না। সব ভালবাসা একই সূত্রে গাঁথা, একই সুরে বাঁধা। যেমন- একটি মালায় আমরা গাঁথতে পারি গোলাপ, বেলি, রজনীগন্ধা, হাসনা হেনা। একটি গানে বাঁধতে পারি নানা সুর। সব ফুল যখন এক সঙ্গে সুরভি ছড়াবে, সব সুর যখন এক সঙ্গে মোহাচ্ছন্ন করে রাখবে- তখন মনে হবে পৃথিবীটা সত্যিই একটি আনন্দ-উৎসবের জায়গা। তখন পৃথিবীতে থাকবে না কোন রণক্ষেত্র, কোন যুদ্ধের দামামা, কোন মারণাস্ত্রের হুমকি, কোন ক্ষুদ্র স্বার্থ সংঘাত, কোন হিংসা-দ্বেষ, কোন করোনা ভাইরাস। সবাই মিলে আমরা কেবলই গাইব ভালবাসার জয়গান- ভালবাসি, ভালবাসি/ এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি। লেখক : সাহিত্যসেবী
×