ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ র ই শামীম

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ॥ কোন্ পথে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১২:১৮, ২০ অক্টোবর ২০১৯

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ॥ কোন্ পথে বাংলাদেশ

জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন সোনালি সময় পার করছে। আমাদের নির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেশি। জনসংখ্যার ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী এখন শতকরা ৬৮ ভাগ। জনমিতির পরিভাষায় এটাই হলো একটি দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ। কোন জাতির ভাগ্যে এ ধরনের জনমিতিক সুবর্ণকাল একবারই আসে যা থাকে কমবেশি ৩০-৩৫ বছর। বাংলাদেশ এই সোনালি সময়ে পদার্পণ করেছে আরও ৭ বছর আগে (২০১২ সাল থেকে) যা শেষ হবে ২০৪০ এর দিকে। এরপর থেকে আবার কর্মক্ষম জনসংখ্যার চেয়ে নির্ভরশীল জনসংখ্যা বাড়তে থাকবে। জনমিতির হিসেবে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীকে একটি রাষ্ট্রের জন্য উৎপাদনশীল, কর্মমুখী ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ের জন্য সক্রিয় বিবেচনা করা হয়। এ জন্য একটি দেশের মানবগোষ্ঠীর এই পর্যায়কে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য মানবপুঁজি হিসেবে দেখা হয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড একটি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাব ফেলে। এজন্য অনেক চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই একটি দেশকে জনসংখ্যার এই সুযোগ নিতে হয়। চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলায় সফলতার ওপরই নির্ভর করে এই সুযোগ কতটা জাতির জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে। তাই জনগোষ্ঠীর কর্মক্ষম বিশাল অংশকে মানবসম্পদে পরিণত করে উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকা-ে কাজে লাগানোই মুখ্য বিষয়। এর ওপরই নির্ভর করে জনমিতির সুযোগ ঘরে তোলা না তোলা। এটা কাজে লাগানোর জন্য রাষ্ট্রের সঠিক সময়ে ব্যাপক প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে তা হিতে বিপরীত ফল বয়ে আনে। ডিভিডেন্ডের বাড়তি জনগোষ্ঠী তখন রাষ্ট্রের সম্পদ না হয়ে বোঝায় পরিণত হয়। দক্ষ জনসংখ্যার সুযোগ কাজে লাগানোর মাধমেই জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া আজ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। চীনের মতো রাষ্ট্র তাদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নিয়োজিত করেই আজ এতদূর এগিয়ে গেছে। তাহলে আমরা কেন পারব না? আমাদের বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো চাট্টিখানি বিষয়ও নয়। নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই একাজে এগোতে হবে। এই সুবিধা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আছে আমাদের সামনে। বর্তমানে আমাদের মোট জনসংখ্যা প্রায় সতেরো কোটি। যদি ১৫ বছর ধরে হিসাব করা যায় তবে আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ শতাংশই সবচেয়ে কর্মঠ ও সক্রিয়। এর মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ যুব সমাজ, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী আমাদের বর্তমান শ্রমশক্তির পরিমাণ পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। বর্তমানে আমাদের বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২৬ লাখ। এটা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের হিসাব। বর্তমানে তা আরও বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ ৬০ হাজার। এর পূর্বের ৩ বছর বেকারের সংখ্যা মোটামোটি স্থির ছিল। বেকারত্ব উন্নত অনুন্নত সকল দেশের জন্যই কঠিন চ্যালেঞ্জ। সারা বিশ্বেই বিগত বছরগুলোতে বেকারত্বের হার বেড়েছে। বৈশ্বিকভাবে বেকারত্বের গড় হার শতকরা ১৩, বিশ্বব্যাংকের মতে বাংলাদেশে বেকারত্বের প্রকৃত হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। সম্প্রতি ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দি ইকোনমিস্ট’এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে প্রতি বছর উচ্চশিক্ষা লাভের পর শ্রমবাজারে আসা চাকরি প্রার্থীদের অর্ধেকই বেকার থাকেন বা তাদের চাহিদা অনুযায়ী কাজ পান না। প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪৭ ভাগ স্নাতকধারীই বেকার। প্রতিবছর নতুন করে ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে প্রায় সাত লাখ কর্মক্ষম মানুষ কাজ পায়। অর্থাৎ দুই তৃতীয়াংশই উল্লেখ্যযোগ্য কাজ পায় না। এর মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বেশি এবং এরাই বেশি শ্রমশক্তির যোগান দিচ্ছে। বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৩ মোতাবেক বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুব শ্রমশক্তির আকার ২০০৫-০৬ সালের ১০ দশমিক ৮ মিলিয়ন হতে বেড়ে ২০১৩ সালে হয়েছে ১৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন। এক্ষেত্রে গ্রাম-শহর এবং জেন্ডার ভিত্তিক বেশ পার্থক্যও লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে এখানে লক্ষণীয় যে শহরের তুলনায় গ্রামীণ যুব শক্তি ৩ গুণ বেশি এবং নারীর তুলনায় পুরুষ শ্রমশক্তি দুই মিলিয়ন বেশি। এছাড়া যুব জনগোষ্ঠীর নির্ভরশীলতার হার শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি। এদের মধ্যে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ১৪ দশমিক ৪ শতাংশের কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জনশক্তি রফতানির পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৮৫ লাখ। এর আগের বছর ছিল ৫ দশমিক ৫৬ লাখ অর্থাৎ জনশক্তি রফতানির পরিমাণ বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তা বলা চলে স্থিতিশীল আছে। কিন্তু এখাতেও নানা প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা আমাদের এখনও আছে। ফলে বৈদেশিক শ্রমবাজার আশানুরূপ সম্প্রসারিত হচ্ছে না। অদক্ষ ও অযোগ্যতার কারণে অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা অনুযায়ী রেমিটেন্সও কম আসছে। আবার আমাদের দেশ থেকেও রেমিটেন্স বিদেশে চলে যাচ্ছে। নিয়োগকারীরা বলেন, দেশের অনেক সেক্টরে উপযুক্ত দক্ষ জনশক্তি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের নানা জায়গা বিদেশীরা স্থান করে নিচ্ছে এবং বিলিয়ন টাকা রেমিটেন্স বিদেশে চলে যাচ্ছে। এটা এখন শুধু উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেই, আশঙ্কার পর্যায়ে চলে গেছে। কেন আমাদের বেকার জনগোষ্ঠী এ পদের জন্য অনুপযুক্ত সে সব কারণ খুঁজে দ্রুতই সমাধানের পথ খোঁজা প্রয়োজন। তাহলে বিপুল কর্মসংস্থান এখানেও সম্ভব। দুই দশক আগেও মালয়েশিয়ান ছাত্ররা বাংলাদেশে (মেডিকেলে) পড়াশোনা করতে আসত। মানব সম্পদের দক্ষতার অভাব দূর করে এবং এখাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করে মালয়েশিয়া আজ কী পর্যায়ে আছে আমরা জানি। আমাদের সন্তানরা এখন উল্টো ওখানে পড়তে যাচ্ছে। এদেশে মালয়েশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ছাত্র নিতে সেমিনারও হচ্ছে। এসব কি ভাবা যায়? এই অবস্থার কারণ খুঁজে বের করে সমাধান কি কঠিন বিষয়? আমাদের অর্থনীতি বিগত এক দশকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পেরেছে। জিডিপিতে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যেই একটি উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছি এবং সে অনুযায়ী সরকার কাজও করছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রায়ও আমরা প্রশংসাসূচক সফলতা দেখাতে পেরেছি। বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনাও (এসডিজি) বাস্তবায়িত হচ্ছে পরিকল্পনা মাফিক। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একজন দক্ষ ও সুযোগ্য সমন্বয়ক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, ফলে এসডিজি বাস্তবায়ন যথাযথ তদারকি হচ্ছে। কিন্তু যে সুযোগ জাতির জীবনে একবারই আসে (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) সেই সুযোগকে কাজে লাগানোর কর্মসূচী গ্রহণ, বাস্তবায়ন, তদারকি, পরীবিক্ষণ এর জন্যও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সেল গঠন করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এবং অনেকেই মনে করেন জাতির এই গোল্ডেন পিরিয়ডকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে যুব কর্মসংস্থান কমিশন বা টাস্ক ফোর্স গঠন করা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে সারা বিশ্বেই বেকারদের মধ্যে যুব বেকারত্বই বেশি। আর এরাই একটি দেশের সবচেয়ে মূল্যবান মানব সম্পদ। মানব সম্পদের উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের সাফল্য থাকলেও, যুব উন্নয়ন ইনডেক্স অনুযায়ীও আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও পিছিয়ে আছি। যুব জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি, যুব সম্পদকে মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও বিনিয়োগের অভাব ইত্যাদি কারণেও যুব জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানই তাই বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ কাজে লাগানোর পরিকল্পনায় এইজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে যুব জনগোষ্ঠীকে । কোন্ পথে বাংলাদেশ : একসঙ্গে বিপুল জনগোষ্ঠীর সকলের কর্মসংস্থান করা আদৌ সম্ভব নয়। তবে এ সমস্যা সমাধানে অধিকসংখ্যক বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, আত্মকর্মসংস্থান, দক্ষতাবৃদ্ধি ও উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে। সরকার সে লক্ষ্যেই কাজ করছে। দেশের বেকারদের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। বেকারত্বের হার ২০২৩ সার নাগাদ ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং অতিরিক্ত ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পাঁচ বছর মেয়াদে ১২ দশমিক ৯ মিলিয়ন অতিরিক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯ লাখ ২৫ হাজার ১৫০ জন যুবক ও যুবনারীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সরকারীভাবে আইটি খাতে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীর সংখ্যা হবে সাত লাখ। এই সেক্টরে ৬৮ হাজার কর্মসংস্থান হয়েছে ২০১৮ সালে, যা ২০২১ সাল লাগাদ হবে ৩ লাখ। এছাড়া ২৮টি হাইটেক পার্ক ও রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে সম্পূর্ণ চালু হলে প্রায় ৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। এছাড়া পর্যটন খাতে ২০২৩ সালের মধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজার কর্মসংস্থান করা হবে। এছাড়া আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে বিনা জামানতেও সহজ শর্তে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত কর্মসংস্থান ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রমকে আরও সম্প্রসারণ করা হবে। যুব উদ্যোক্তা তৈরির জন্য ‘তরুণউদ্যোক্তা নীতিমালা’ তৈরি হচ্ছে। এছাড়াও যুবদের দক্ষতা বৃদ্ধি, আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ, সুস্থ বিনোদন, তথ্যপ্রযুক্তি সেবা সুবিধা প্রদানের জন্য উপজেলা পর্যায়ে যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কেন্দ্্র স্থাপনসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হয়েছে। আশা করা যায় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের এই সুযোগ কাজে লাগাতে সরকারের নানামুখী এইসব পদক্ষেপের মাধ্যমেই ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসাবে আমরা আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হব।
×