ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নেয়ায় দলে অচলাবস্থা

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ২৭ আগস্ট ২০১৯

 একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নেয়ায় দলে অচলাবস্থা

শরীফুল ইসলাম ॥ কোন সিদ্ধান্তেই স্থির থাকতে পারছে না বিএনপি। একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন না করেই আবার পিছু হটে আসে। দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে থাকায় সঠিক সময়ে সঠিক দিকনির্দেশনা না পেয়ে যে কোন কর্মসূচী পালনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতারা থাকেন অস্থির। আর এর ঢেউ লাগে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীর মাঝেও। এ কারণেই দলটির সর্বস্তরে এখন চরম অচলাবস্থা বিরাজ করছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি ওই নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকি দেয়। কিন্তু এক পর্যায়ে সে অবস্থান থেকে সরে আসে। পরে সর্বস্তরে দল পুনর্গঠন শুরু করে দল গুছিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার কথা বলে। কিন্তু দল গোছাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পিছু হটে আসে। এর পর জানায়, তাদের দলের নির্বাচিত ৬ এমপি সংসদে যাবে না। কিন্তু এক পর্যায়ে সে সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসে। লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তে দলীয় এমপিরা সংসদে যোগ দেয়। দলীয় এমপিরা সংসদে যোগ দেয়ার পর বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা প্রকাশ্যে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে থাকে। এ নিয়ে দলের মধ্যে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। তবে দল সংসদে যোগ দেয়ার পর স্বয়ং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সংসদে যোগ না দেয়ার ব্যাপারে বিএনপি আগে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা ভুল ছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোন নির্বাচনে অংশ নেবে না বলেও বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ কারণে উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়ায় ৩ শতাধিক তৃণমূল নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে বিভিন্ন মহল ও দলের তৃণমূল নেতাকর্মীর চাপে বিএনপি সকল নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আর বহিষ্কৃত নেতাদের বহিষ্কারাদেশও প্রত্যাহার করা হয়। ইতোমধ্যেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ছেড়ে দেয়া আসনে নির্বাচন করে বিএনপি বিজয়ী হয়। একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপি দলীয় কর্মকা-ে অচলাবস্থা সৃষ্টি করায় সাধারণ নেতাকর্মীর মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। তবে বিএনপি নেতাকর্মীদের হতাশা দূর করতে এমন কোন পন্থা নেই যা দলীয় হাইকমান্ড অবলম্বন করছে না। কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। দলের নেতাদের মধ্যে কেউ বলছেন আন্দোলনের মাধ্যমে দলকে এগিয়ে নেয়া হবে আবার কেউ বলছেন সর্বস্তরে সংগঠনকে গুছিয়ে শক্তি সঞ্চয় করা হবে। কিন্তু চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে অবস্থান করায় সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায় কোনভাবেই দলকে এগিয়ে নিতে পারছে না। বরং দলটি ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপি এখন সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। একদিকে দলের চেয়ারপার্সন জেলে ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে অবস্থান করছেন। অপরদিকে সরকারের কঠোর নজরদারির কারণে রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনের ক্ষেত্রেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া দলের অসংখ্য নেতাকর্মীর নামে মামলা থাকায় এবং কিছু নেতাকর্মী জেলে থাকায় তারা দলীয় কর্মকান্ডে অংশ নিতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে কোন বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তা সব সময় ঠিক রাখা যাচ্ছে না। সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর কারাবন্দী খালেদা জিয়া ও লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের নির্দেশনায় সরাদেশের সর্বস্তরে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করে মাঠের রাজনীতি সক্রিয় করার চেষ্টা করেন বিএনপি মহাসচিবসহ দলের সিনিয়র নেতারা। এ জন্য বেশ কটি বৈঠক করে দলের কিছু সিনিয়র নেতাকে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় পাঠানো হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের তেমন উপস্থিতি না ঘটা এবং বেশ কটি এলাকায় উপস্থিত হওয়া নেতাকর্মীরা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হয়ে কর্মসূচী পন্ড করে দেয়ায় পর কেন্দ্র ঘোষিত গণসংযোগ কর্মসূচী থেমে যায়। অবশ্য সম্প্রতি ৩ বিভাগীয় সদরে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপি ৩ টি সমাবেশ করেছে। যদিও সর্বস্তরের নেতাকর্মীর সক্রিয় উপস্থিতি না থাকায় এসব সমাবেশ তেমন সফল হয়নি। কেন্দ্রীয় নেতাদের গণসংযোগ কর্মসূচী বিফল হওয়ার পর সর্বস্তরে সাংগঠনিক অবস্থা জোরদার করার চেষ্টা করে বিএনপি হাইকমান্ড। সিদ্ধান্ত হয় দলের জেলা-উপজেলা কমিটি পুনর্গঠনের পর জাতীয় কাউন্সিল করার। কিন্তু কিছু জেলা ও উপজেলা কমিটি এবং ১১ টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে দু’একটির কমিটি পুনর্গঠন করতে গিয়ে বড় রকমের হোঁচট খায় বিএনপি। এর পর সর্বস্তরে দল গোছানোর কাজও স্থবির হয়ে পড়ে। এ কারণে জাতীয় কাউন্সিলের পরিকল্পনাও ভেস্তে যায়। এর ফলে দল গুছিয়ে মাঠের রাজনীতি চাঙ্গা করার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়। দল গোছানো কার্যক্রম ব্যর্থ হওয়ার পর এ বছর মে মাস থেকে থেকে লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে স্থায়ী কমিটির নেতাদের বেশ কটি বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে রাজপথের আন্দোলন চাঙ্গা করার। এ সিদ্ধান্তের পর বিএনপির সিনিয়র নেতারা আন্দোলন চাঙ্গা করার কথা জোরেশোরে বলতে থাকেন। কিন্তু তারেক রহমানের সাম্প্রতিক কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে মনোক্ষুন্ন থাকায় দলের সিনিয়র নেতারা দলে নিষ্ক্রিয় থাকে। এ কারণে তাদের অনুসারীরাও নিষ্ক্রিয় থাকে। এর ফলে কিছু নেতা তারেকের নির্দেশে আন্দোলনের কথা বললেও বাস্তবে আন্দোলনের ধারেকাছেও যেতে পারেনি। কেন্দ্রের এ অবস্থা দেখে তৃণমূল নেতাকর্মীরাও আন্দোলনের বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দল গুছিয়ে সারাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে মাঠের রাজনীতিতে সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে সক্রিয় করার যে চিন্তা করেছিল দলীয় হাইকমান্ড তা সফল হয়নি কেন্দ্রীয় নেতাদের কারণেই। সর্বস্তরে দলের কমিটি পুনর্গঠনের কাজও ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে পারেনি সিনিয়র নেতারা। দলের দুর্দিন কাটাতে সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করতে পারেনি। তাই দলীয় কর্মকান্ড গতিহীন হয়ে পড়েছে। সূত্র মতে, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর মহাসচিবসহ কিছু সিনিয়র নেতা বিভিন্নভাবে দলকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে কিছু নেতার অনীহাসহ নানান সমস্যার কারণে এ কাজে সফল হতে পারেনি বিএনপি। দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা মনে করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া হয়ত গ্রেফতার হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যেই জামিনে মুক্তি পেয়ে যাবেন। আর জামিনে মুক্তি পেলে তিনি সরাসরি সময়োপযোগী নির্দেশনা দিয়ে দলীয় কর্মকান্ড গতিশীল করতে পারবেন। কিন্তু তা যখন হলো না তখন নতুন করে দল নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়। ইদানীং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সিনিয়র নেতারা বেশি বেশি করে একটি কথা বলছেন। আর তা হচ্ছে সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আবার দলকে সুসংগঠিত করা হবে। আর এভাবেই বিএনপি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু সিনিয়র নেতারা বার বার দলকে ঐক্যবদ্ধ করার কথা বলে বাস্তবে দলে যে অনৈক্য আছে তাই ফুটিয়ে তুলছেন। আর এ বিষয়টি বুঝতে পেরে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আরও বেশি হতাশ হচ্ছেন। অভিজ্ঞ মহলের মতে, বিএনপির উচিত ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সর্বস্তরে দল গুছিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথের আন্দোলন চাঙ্গা করার চেষ্টা করা। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচী দিতে না পারায় সর্বস্তরের বিএনপি নেতাকর্মীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। আর দলের সিনিয়র নেতারা হাঁকডাক দিয়েও রাজপথে কোন কর্মসূচী দিতে না পারায় বিএনপির রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষেরও আগ্রহ কমে যায়। বিএনপির সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে না পারার সমস্যা অনেক পুরনো। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল চেয়েছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটি সমঝোতা করে নির্বাচন সম্পন্ন করতে। বিএনপিও প্রথমে এতে রাজি ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে বিএনপি ওই নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৩ সালের শেষদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশব্যাপী লাগাতার সহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। এর ফলে সমঝোতার উদ্যোগ ভেস্তে যায়। আর সরকার কঠোর অবস্থানে থাকায় এক পর্য়ায়ে আন্দোলনে ব্যর্থ হয় বিএনপি। এ পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে চরম বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পর সরকার পতনের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিনের অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচী পালন করে বিএনপি। এ আন্দোলনে ব্যাপক হারে পেট্রোলবোমা ও জ্বালাও-পোড়াও এর ঘটনা ঘটায় প্রায় ২শ’ মানুষ নিহত, হাজার তিনেক যানবাহনসহ অসংখ্য স্থাপনার ক্ষতি হয়। দেশের মানুষ এখনও ভুলতে পারেনি সেই সহিংস আন্দোলনের কথা। এ আন্দোলনের পর বিদেশীরাও বিএনপির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যার ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বিদেশীদের সহযোগিতা চেয়েও পায়নি বিএনপি। এই আন্দোলনের পর সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাবে এখনও স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ফিরে আসতে পারেনি বিএনািপ। সর্বশেষ ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন করতে গিয়েও বিএনপি একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েছে। প্রথমে অছাত্রদের নিয়ে কমিটি করবে না বলে ঘোষণা দিয়ে কাউন্সিলরদের যে তালিকা প্রকাশ করে তাতে অনেক অছাত্রকে রেখে দেয়া হয়। এ নিয়ে আন্দোলন শুরু হলে ১২ ছাত্রদল নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। এ নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু বহিষ্কৃত ছাত্রদল নেতারা তাদের অনুসারীদের নিয়ে সহিংস আন্দোলন শুরু করলে আবার তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। কিছু বিএনপি নেতার চাপে আগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সবাইকে নতুন কমিটির নেতা নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট করে পুনরায় তফসিল দেয়া হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত দলটি যত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোন সিদ্ধান্তেই অটল থাকতে পারেনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দল থেকে সরকারের কাছে শর্ত দেয়া হয়েছিল খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার মুক্তি না হলেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
×