ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ সাগর কন্যার আঁচলতলে

প্রকাশিত: ০৬:১১, ২১ জুলাই ২০১৯

 ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ সাগর কন্যার আঁচলতলে

এবারও ভেস্তে যাচ্ছিল। কেউই বিশ্বাস করতে পারিনি যে অবশেষে আমাদের শিক্ষাসফরটি হবে। তা নাহলে গত সাড়ে তিন বছরে যা সম্ভব হয়ে উঠেনি তা মাত্র ১৫ দিনের মধ্যেই বাস্তবায়ন হয়! বলে রাখি, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম আমরা। প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত এটাই প্রথম ট্যুর। তাই উদ্দীপনাও স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি। ট্যুরের শুরুটা এভাবে, রাশেদ স্যার পুনরায় বিভাগের ট্যুর কমিটিতে দায়িত্ব পেলেন। অতঃপর খুশির সংবাদটি ক্লাসে এসে জানালেন। ভাবলাম, এবারই শেষমেশ একটা সুযোগ নেয়া যায়। যেই কথা, সেই কাজ। বিষয়টি জানাতেই তিনি সাহস দিলেন। পরে রেজাউল স্যারের সঙ্গে আলাপ করলাম। এসে যোগ দিলেন মনজুর স্যারও। ব্যস, শুরু হয়ে গেল আয়োজন। ক্লাসে এসে স্যাররা শিক্ষাসফরের বিষয়টি বলতেই বন্ধুরা রাজি হয়ে গেল। চার বছরের খরা কাটাতে রাজি না হয়ে উপায় কি! যাই হোক, তারিখ নির্ধারণ করে ঘুরে এলাম ‘লাল কাকড়া’ আর ‘সাগর কন্যার দেশ’ কুয়াকাটায়। শিক্ষাসফর মূলত শিক্ষার উদ্দেশ্য সফর বা যাত্রা। কিন্তু আমাদের সফরের শিক্ষাটি যেন শুরু গেল যাত্রার প্রারম্ভেই। স্যাররা কুষ্টিয়া থেকে গাড়ি আর টেলিফোনে হোটেল ম্যানেজ করে বাকি দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন ছাত্রদের উপর। দুর্ভাগ্যক্রমে বড় দায়িত্বটা আমার কাঁধেই পড়েছিল। তাই ফন্দি আটলাম; সবাইকে কিভাবে কাজের সঙ্গে জড়ানো যায়। দুষ্টামি করেই ছোট ছোট কয়েকটি কমিটি করলাম। আর তাতে একে একে দায়িত্ব দিলাম সবচেয়ে চুপচাপ আর সবচেয়ে চঞ্চল বন্ধুদের। অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলাম তাদের এক একজনের কাজের দক্ষতা। যাই হোক, কাজগুলো গুছিয়ে নিয়ে ভাড়া করা একটা বড়সড় বাসে চড়ে যাত্রা শুরু হলো বেলা বারোটার দিকে। চেয়ারম্যান স্যার রবীন্দ্র-নজরুল অনুষদ ভবনের সামনে এসে গাড়িতে শুভাশীষ জানিয়ে বিদায় দিলেন। লটারিতে আসন বণ্টন করে শুরু হলো গন্তব্যের উদ্দেশ্য যাত্রা। সাগরকন্যার টান শুরু থেকেই উচ্ছ্বসিত করে তুলছিল। সিনেমায় দেখা ঢেউয়ের গর্জন আর আচড়ে পড়া জলের দৃশ্য কিভাবে কাছ থেকে উপভোগ করব; সাগরের নোনাজল পানি কিভাবে গায়ে মাখবো; কিভাবে সাঁতার কেটে ভেসে বেড়াব; উত্তাল শুভ্র ঢেউয়ের সঙ্গে কিভাবে ছবি তুলব সবই যেন মনের কোণে অংকন হচ্ছিল আপন মনে। ফুরফুরে উৎসুক মনে আসন্ন গ্রীষ্মের আলো বাতাস মাড়িয়ে চলতে থাকে বাংলা পরিবারকে বহন করা বাসটি। বাসচালক সেকান্দার মামা আর তার সহকারী আব্দুল আলিম পথিমধ্যে পড়া দর্শনীয় স্থানগুলো একঝলক করে দেখার সুযোগ করে দিচ্ছিলেন। মিহি কালো রাজপথে ক্ষিপ্র বেগে চলতে চলতে পার করছিলাম আঁকাবাকা উঁচুনিচু রাস্তায় সারি সারি গাছ, বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ, ইট পাথরের ভবন আর গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘের দলা। গন্তব্যে পৌঁছুতে গিয়ে একে একে আমরা পেছনে ফেলতে থাকলাম ঝিনাইদহ, মাগুরা, ফরিদপুর আর বরিশাল শহর। সাহিত্যের ছাত্রদের নিয়ে একটি মিথ প্রচলিত আছে, তারা নাকি রসিক আর রোমান্টিক হয়। আসলে হয় বৈকি! সারা রাস্তায় চলতে থাকল হৈ-হুল্লোড়। গান কবিতা আর নাচে মেতেছিলাম আমরা। প্রায় দশ ঘণ্টার জার্নি শেষে যখন কুয়াকাটা গিয়ে পৌঁছালাম; তখন রাত ঠিক ১১টা। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি সত্ত্বেও ঠিক করলাম রাতে সমুদ্র দেখব। বাস থেকে তাড়াহুড়ো করে নেমে হোটেলে ব্যাগ রেখে দৌড়ে গেলাম বীচে। আহা! সে কী আনন্দ! অন্যরকম এক অনুভূতি। রাতের সমুদ্রদর্শন আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। দূর থেকে ঢেউগুলো সশব্দে এসে আঁচড়ে পড়ছিল কিনারে। ধুয়ে দিচ্ছিল পদযুগল। কি অমায়িক দৃশ্য। নিশিথের সমুদ্রবিলাস শেষে হোটেলে ফিরলাম। শুরু হলো রাতের আড্ডা। সারারাত আড্ডা জমিয়ে ভোরেই আবার সূর্যের উদয় দেখার পালা। ক্লান্তশ্রান্ত শরীরে ভোরে ঘুম থেকে উঠেই দেখি হোটেলচত্বরে মোটরসাইকেল অপেক্ষা করছে। অচেনা জায়গা বলে ছেলে-মেয়ের কম্বিনেশন করে উঠে পড়লাম বাইকে। একে একে ঘুরে দেখলাম ছাগলছেঁড়া বাজার, জাতীয় উদ্যান, গঙ্গামতি চর, কাউয়ার চর, লাল কাকরার চর, ঝাউবন, রাখাইন পল্লী, বৌদ্ধ মন্দির, মিষ্টি পানির কূপ। দুপুরে হলো সমুদ্র স্নান। শিক্ষক ছাত্রের বেড়া ভেঙে সবাই তখন হয়ে গেলাম খেলোয়াড়। ফুটবল নিয়ে মেতে উঠলাম অশান্ত সমুদ্রের পানিতে। মুগ্ধহয়ে ঘুরতে ফিরতে ঘনিয়ে এলো সময়। এবার ফিরতে হবে। দুই দিনের ভ্রমণেই কুয়াকাটার পটে এঁকে দিয়ে এলাম বাংলা পরিবারের নাম। রেখে ফিরলাম কতশত স্মৃতি। সময় হয়ত আবারও কোন একদিন আমাদের নিয়ে যাবে সাগরকন্যার আঁচলতলে। কিন্তু সেইদিন বন্ধুত্বের মধুমাখা জায়গাটি হয়ত দখল করে নেবে অর্ধাঙ্গ/অর্ধাঙ্গী আর তনয়-তনয়ার স্নেহময় বন্ধনে। সেই যাত্রাটি হবে স্মৃতি শুধু আঁকতেই নয়; স্মৃতি খুঁজে ফিরতেও। অনি আতিকুর রহমান
×