ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

১৫ মে, ১৯৭১ ॥ ‘বিশ্ব শান্তি’ সংসদের সংহতি

প্রকাশিত: ০৮:১৯, ১৫ মে ২০১৯

১৫ মে, ১৯৭১ ॥ ‘বিশ্ব শান্তি’ সংসদের সংহতি

১৯৭১ সালের ১৫ মে দিনটি ছিল শনিবার। এই দিন সিলেটের নালুয়া চা-বাগানের সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর একটি সামরিক বহরকে এ্যামবুশ করলে ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এতে পাকবাহিনীর একটি ট্রাক সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং ২৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিরাপদ এলাকায় চলে আসেন। লে. মোরশেদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একদল যোদ্ধা সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে পাকসেনাদের এ্যামবুশ করে। এতে পাকবাহিনীর একটি জীপ ও একটি ট্রাক ধ্বংস হয়। কিশোরগঞ্জ থেকে পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে নান্দাইল প্রবেশ করে। স্থানীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির পরামর্শ ক্রমে পাকবাহিনী নান্দাইল থানার ওসি আবদুল আওলাকে নান্দাইলের সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেয়। এই সাতজন মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন-শাহ নেওয়াজ ভূঁইয়া, শশীকান্ত রায়, সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু এবং মোঃ রইসউদ্দিন ভুঁইয়া। ঠাকুরগাঁওয়ের সদর থানার ফারাবাড়িতে সন্তান মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় পিতা শেখ শহর আলী ও তার ভাই শেখ বহর আলীসহ ১৯ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে পাকবাহিনী তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। পাক বর্বরদের গুলিতে তারা সবাই নিহত হন। অপর এক ঘটনায় রামনাথ হাটে রফিকুল ইসলাম, রেজাউল, বেলাল ও দেলোয়ারসহ ১১ জন নিরীহ মানুষ পাক হানাদরদের গুলিতে নিহত হন। এদিন গৌরনদীর হরহর মৌজার নন্দি পাড়ার বনজঙ্গল বেষ্টিত জলাভূমিতে হানাদাররা ব্রাশফায়ার করে ১৩৫ জনকে হত্যা করে। এই দিন পাথরঘাটা থানার বেশ কয়েকজনকে ধরে এনে বিষখালী নদীর তীরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিষখালী নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। আর এ হত্যাকা-ে নেতৃত্ব দিয়েছিল, পটুয়াখালী জেলা সামরিক আইন প্রশাসক মেজর নাদের পারভেজ। এ সময় পাথরঘাটার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লক্ষণ দাস, তার ছেলে কৃষ্ণ দাস, অরুণ দাস ও স্বপন দাসকে ধরে এনে বরগুনা কারাগারে আটক রাখা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অবস্থানের কারণে সাবেক সিও আতিকুল্লাহ, এসআই আবদুল মজিদ, সিপাহী আড়ি মিয়া ও আবদুল জববার এবং বরগুনার সিদ্দিকুর রহমান চেয়ারম্যানকে পটুয়াখালী নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য ‘রাজাকার বাহিনী’ গঠন করা হয়। এদিন সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন, তিনজন এমপিএ যথাক্রমে যশোরের মইনুদ্দিন মিয়াজী, খুলনার হাবিবুর রহমান খান ও মোহাম্মদ সাঈদ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ করেছেন। পৃথক পৃথক বিবৃতিতে তারা পাকিস্তানের অখ-তা ও সংহতির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি এএসএম সোলায়মান এক বেতার বক্তৃতায় বলেন, পাকিস্তান টিকে থাকতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার এ্যালেক ডগলাস হিউম কমন্স সভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলোচনায় বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি। হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে চতুর্থ বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে (মে ১৩-১৬) ১২৪টি দেশ থেকে উপস্থিত প্রায় ৮০০ সদস্য অবিসংবাদিতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া পাশবিকতা এবং গণহত্যার প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করে। ‘বিশ্ব শান্তি সংসদ’ স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, ব্রিটিশ সরকারের এই অবস্থান প্রত্যাখ্যান করে, বাংলাদেশ থেকে ইসলামাবাদ যতক্ষণ না পর্যন্ত সেনা প্রত্যাহার না করে তখন অবধি পাকিস্তানকে সহায়তা প্রদান বন্ধ রাখার দাবিকে গতকাল ব্রিটিশ এমপি, শিক্ষাবিদ, রিপোর্টার ও ব্যবসায়ী নিয়ে গঠিত ২০০ জনের ও বেশি একটি দল আবার পুনর্জীবিত করেছে। পিটিআইএ’র বরাত দিয়ে দ্য টাইমস পত্রিকা গতকাল এক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, ব্রিটিশ সরকারকে বাংলাদেশের সর্বত্র ব্যাপক হারে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা দেয়ার উদ্যোগে অংশগ্রহণ করার আর্জি জানিয়েছেন। এ্যাকশন বাংলাদেশ এর অর্থায়নে ‘হাউস অফ কমন্স’-এর শ্রম সংক্রান্ত সাধারণ আলোচনার প্রাক্কালে বিজ্ঞাপনটি প্রদর্শিত হয়েছে। বিজ্ঞাপনটি হলো : ‘২৫ মার্চ, পাকিস্তানী বাহিনী বর্বরতার সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষ হত্যা শুরু করেছিল যাদের লক্ষ্য ছিল দেশের নকশাল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া।’ ‘রয়টার আরো লিখেছে- ব্রিটেনের ইয়ং লিবারেলের চেয়ারম্যান পিটার হেইন আজ বলেছেন যে, দেশটির পূর্বাংশ হতে, সেনা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত, ব্রিটেনের উচিত পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো সকল সাহায্য বন্ধ করা। দ্য টাইমস পত্রিকায় পাঠানো চিঠিতে তিনি লিখেছেন : ‘সম্ভবত পাকিস্তান সঙ্কট বিষয়ে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টিকে কেন্দ্র করে, এ সপ্তাহে একটি পার্লামেন্টারি বিতর্কের মাধ্যমে বাংলাদেশ এর মানুষের ওপর চালানো পশ্চিম পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের কারণে সৃষ্ট অপরাধবোধ থেকে ব্রিটিশ সরকারকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করবে। দি ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ রাষ্ট্রপতি নিক্সনকে পরামর্শ দিয়ে সম্পাদকীয় কলামে লিখেছে, পাকিস্তানী সেনা সরকারের একজন প্রতিনিধি তার দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় প্রতিরোধ করার জন্য একশ মিলিয়ন ডলার সাহায্য চাইতে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে কোন সহায়তা দেয়ার পূর্বে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উচিত বিষয়টি ভালভাবে বিবেচনা করা। ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে বাংলাদেশের পাশে থাকার আহ্বান জানান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি সরাসরি তত্ত্বাবধান করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। এই দিন আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘গেরিলা আক্রমণে রেলপথ ও সেতু ধ্বংস, তামাবিল হাতছাড়া’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে এদিন ধামাইরহাটের কাছে একদল পাকসেনার ওপর গুলি চালিয়ে ৪ জন সৈন্যকে খতম করেন। মুক্তিসংগ্রামীরা মঙ্গলবার জয়পুরহাটের কাছে ৪০ ফুট দীর্ঘ একটি রেলসেতু উড়িয়ে দেন এবং একটি পাওয়ার হাউস ধ্বংস করেন। পাঁচবিবি স্টেশনের কাছে রেললাইন উড়িয়ে দেয়া হয়। গভীর রাতে চট্টগ্রাম ও ফেনীর মধ্যে শুভপুর এলাকায় মুক্তিফৌজের সঙ্গে প্রচ- যুদ্ধে গতকাল ২০০ জনেরও বেশি পাকসেনা খতম হয়েছে। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের উঃ-পঃ সীমান্তে প্রদেশ থেকে আধা-সামরিক বাহিনীর লোকদের এনে পাকবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে একটি ব্যাটালিয়নকে মোতায়েন করা হয়েছে। মেহেরপুর সীমান্তের পশ্চিম দিকে দৌলতদারের গ্রামে এবং চুয়াডাঙ্গা শহরে পাক-সৈন্যদের একটি বিরাট দল ঘাঁটি স্থাপন করেছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে ৬০টি ট্রাক। কৃষ্ণনগরে আগত প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পাকবাহিনী রোজ মেহেরপুর- চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে ওঁৎপেতে থাকে। তাঁরা বেপরোয়াভাবে নিরস্ত্র লোকদের হত্যা করে মৃতদেহগুলো গর্তে ফেলে দেয়। পাকসেনারা চুয়াডাঙ্গা মহকুমার দুটি গ্রাম বাদে আর সব এলাকা তছনছ করে দিয়েছে। ব্যাপক লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং নারী নির্যাতন তাদের দৈনিক কাজ। পাকিস্তানী বর্বররা বহু তরুণীকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। মেহেরপুরে দুটি গ্রামে হানা দিয়া পাক সেনারা ১২ জনকে হত্যা করেছে। মুক্তিফৌজ বিভিন্ন অঞ্চলে এর আগে যেসব পরিখা খুঁড়েছিলেন, নিহত ব্যাক্তিদের মৃতদেহ ফেলে পাকসেনারা সেগুলো ভরে তুলেছে। ডাওকি থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়- তিন দিন প্রবল প্রতিরোধের পর মুক্তিফৌজ আজ তামাবিল থেকে পিছু হটেছে। তামাবিল এখন পাকবাহিনীর দখলে। তামাবিল শ্রীহট্ট খ-ে বাংলাদেশের শেষ চেকপোস্ট এবং ডাওকি থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে। গতকাল বেলা দেড়টা নাগাদ মুক্তিফৌজ সুবিধাজনক স্থানে সরে যান। পাকসেনারা তামাবিল দখলের পর বাংলাদেশের পতাকা ফেলে দিয়ে পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলন করেন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×