ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে কালোছায়া

প্রকাশিত: ১০:৩০, ১২ মে ২০১৯

 তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে কালোছায়া

এ বছরের প্রথমদিকে বিশ্ব অর্থনীতির উপর নৈরাজ্যবাদের কালোছায়া পড়েছিল। সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে সেই কালোছায়া উঠে যেতে শুরু করেছে। এশিয়ায় বাণিজ্যের প্রবাহ বেড়েছে। আমেরিকার খুচরা ব্যবসায়ে তেজীভাব দেখা দিয়েছে। ইউরোপের মুমুষর্ূু কারখানা শিল্পেও প্রাণের স্পন্দন দেখা দিয়েছে। তবে বছরের প্রথম দিককার নিরানন্দ ভাবটা ফিরিয়ে আনার জন্য দু’একটা খারাপ সংবাদই যথেষ্ট। তার একটি হচ্ছে তেলের দরের ক্রমাগত উর্ধমুখী হওয়ার হুমকি। গত ২৩ এপ্রিল প্রতি ব্যারেল অশোধিত তেলের দাম ৭৪ ডলার ছাড়িয়ে গেছে যা কিনা গত প্রায় ৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিগত দশকে তেলের বাজারের গতি প্রকৃতি বদলালেও এই তেল এখনও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির চাকাকে পেছনের দিকে টেনে ধরার ক্ষমতা রাখে। তেলের দামের সর্বশেষ উল্লম্ফনটা চাহিদা বৃদ্ধির কারণে হয়েছে তা নয় বরং সরবরাহের উপর অভিঘাত সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে গেছে। গত ২২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে যে চীন, ভারত ও তুরস্কসহ বৃহৎ অর্থনীতির বেশকিছু দেশকে যে অব্যাহতি দিয়েছিল তা তুলে নেবে। এ অব্যাহতি বলে এসব দেশ আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে ইরানের তেল আমদানি করতে পারত। অব্যাহতি ২ মে শেষ হবার কথা এবং সেটা হলে বিশ্বব্যাপী তেলের সরবরাহ দৈনিক ১০ লাখ ব্যারেলেরও বেশি অর্থাৎ মোট সরবরাহের প্রায় ১ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। তেলের সরবরাহের ক্ষেত্রে এটাই যে একমাত্র ঝুঁকি তা নয়। যুদ্ধের কারণে লিবিয়ায় তেল উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে। ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ফলে বাজারে ওই দেশের তেলের সরবরাহ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। আমেরিকার অব্যাহতি ঘোষণার পর ইরানের নৌবাহিনী প্রধান বলেছেন যে তার দেশকে হরমুজ প্রণালীর ব্যবহারে বাধা দেয়া হলে ইরান অন্যদেরও এই জলপথ ব্যবহার বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করবে। সেটা হলে তো পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হবে। কারণ বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহের এক পঞ্চমাংশ এই হরমুজ প্রণালী দিয়েই হয়। তেলের এই সরবরাহ হ্রাসের প্রেক্ষাপটে অন্যান্য তেল উৎপাদক দেশ যে এই ঘাটতি পূরণে নিজেদের উৎপাদন বাড়িয়ে দেবে তা মোটেই পরিষ্কার নয়। শেষ বিচারে তেলের আকাশছোঁয়া মূল্য পরিহার করার মতো কারণ সৌদি আরব ও অন্যান্য অনেক দেশের রয়েছে। কেননা তেলের দাম আকাশছোঁয়া হলেই আমেরিকার কোন তেল উৎপাদনে মূলধন ঢালবার এক নতুন জোয়ার সৃষ্টি হবে। হোয়াইট হাউসের অনুরোধে সৌদি আরব মাঝে মধ্যে তেল উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। শেষবার সৌদি আরব এমন অনুরোধ রেখেছিল ট্রাম্প ইরান চুক্তি বাতিল করে দেয়ার পর। তেলের বাজারের ভারসাম্য রক্ষার জন্য সৌদি আরবের প্রকাশ্য অঙ্গীকার রয়েছে। তবে তারা এটাও বলে যে এ ব্যাপারে আশু কোন ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন নেই। তেলের দাম বাড়লে বিশ্ব অর্থনীতিতে তার কি প্রতিক্রিয়া হবে? এ প্রশ্নের জবাবটা আগের চেয়ে আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। আমেরিকার গ্যাস ব্যবহারকারী ভোক্তাদের গাড়িতে গ্যাস ভরার জন্য আরও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। তবে সেদেশে কোন অয়েল বিপ্লব শুরু হবার পর থেকে অধিক মূল্যের কারণে পার্শিয়ান ও অন্যান্য শেল অববাহিকার বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় মার্কিন জিডিপিতে অনুকূল প্রভাব পড়েছে। অন্যান্য তেল উৎপাদক দেশও বর্ধিত বৈশ্বিক চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে মুফতে যে বাড়তি অর্থ লাভ করবে তা অন্যান্য কাজে ব্যয় করার সুযোগ পাবে। কিন্তু তার পরও তেলের মূল্যবৃদ্ধি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য দুঃসংবাদ। এটা দুর্বলতর জায়গাগুলোতে আঘাত হানবে। ইউরোপের অর্থনীতি আমেরিকার চেয়ে খারাপ অবস্থায়। ভোক্তাদের উপর আঘাত নেমে এলে তা পুষিয়ে নেয়ার মতো শেল-তেল শিল্প সেখানে নেই। চীন বিপুল পরিমাণ অশোধিত তেল আমদানি করে থাকে। তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে চীনের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে সম্প্রতি যে উৎকণ্ঠার ভাব দেখা দিয়েছে এটা তার এক বড় কারণ। ওদিকে তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আগে থেকেই অর্থনৈতিক সংকটগ্রস্ত তুরস্ক, আর্জেন্টিনা ও পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতি ও চলতি হিসাবে ঘাটতি বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। তেলের দর বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনীতির নিম্নগতি রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগও মার খাবে। ২০১৮ সালে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পর উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কায় ব্যাংকের সুদের হার বাড়িয়েছিল। ইউরোপ ও আমেরিকায় নীতি নির্ধারকরা এ বছর মুদ্রানীতি শিথিল করে অর্থনীতিতে অতি প্রয়োজনীয় গতিবেগ সঞ্চার করেছিল। কিন্তু তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সেই গতিবেগ বিপরীতমুখী ধারায় চলে যাওয়া শুরু করতে পারে। এই পর্যায়ে অর্থনীতির উপর তেলের মূল্যবৃদ্ধিজনিত আঘাত একটা সম্ভাবনা হিসাবে রয়ে গেছে। তবে বিশ্ব অর্থনীতি এখনও ভঙ্গুর প্রায় অবস্থায় থাকায় অর্থনীতি পরিচালনায় একটা অস্বস্তিকর ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×