ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুকুর জলাশয় উধাও, ফায়ার হাইড্রেন্ট জরুরী

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

পুকুর জলাশয় উধাও, ফায়ার হাইড্রেন্ট জরুরী

শাহীন রহমান ॥ অগ্নিদুর্ঘটনার হাত থেকে নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবস্থার নাম ফায়ার হাইড্রেন্ট। বিশ্বের প্রায় সব শহরে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে এই ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত এই ঢাকা নগরীতে আজও ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। নিমতলী এবং চকবাজারের ঘটনায় দেখা গেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সরু অলিগলি পেরিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারলেও প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের অভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। ফলে আগুনের ব্যাপ্তি আর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফায়ার হাইড্রেন্ট হচ্ছে পানির একটি সংযোগ উৎস। যা পানির প্রধান উৎসের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যে কোন জরুরী প্রয়োজনে এই উৎস থেকে পানি ব্যবহার করা যায়। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর সঙ্গে লম্বা পাইপ যুক্ত করে ইচ্ছে মতো যে কোন দূরত্বে পানি সরবরাহ করা যায়। তারা বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বহু আগে থেকেই ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবহার হয়ে আসছে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই। এটি মূলত রাস্তার ধারে স্থাপন করা এক ধরনের পানির কল। যা থেকে জরুরী পানি সরবরাহ করা যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার মানুষের জন্য প্রথম সাপ্লাই পানির ব্যবস্থা করে ঢাকার নবাব পবিবার। তখন পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সেই ফায়ার হাইড্রেন্টে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে ব্যবহার না হলেও সাধারণ মানুষ গোসল খাওয়া দাওয়াসহ বিভিন্ন কাজেই সেই ফায়ার হাইড্রেন্ট থেকে পানি ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে এসব পানির উৎস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ এগুলো আজও চালু থাকলে প্রয়োজনীয় পানি পেতে বেগ পেতে হতো না। শুধু ফায়ার হাইড্রেন্ট নয়, ঢাকায় এক সময় প্রচুর পরিমাণে পুকুর ডোবাসহ নানা ধরনের জলায়শও ছিল। এসব থেকে অগ্নি দুর্ঘটনারোধে সহজেই পানি পাওয়া যেত। কিন্তু কর্র্তৃপক্ষের চরম গাফিলতির কারণে এগুলো ভরাট, দখল হয়ে গেছে। আজ উদ্ধারের কোন ব্যবস্থা নেই। উন্মুক্ত এসব জলাশয় বন্ধ করে দেয়ার কারণে আগুনের হাত থেকে রেহাই পেতে বা দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায় না। দূর থেকে গাড়ি ভরে পানি এনে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পরিবেশ সংগঠন বাপার সাধারণ সম্পাদক ডাঃ আব্দুল মতিন বলছিলেন, একদিকে পুকুর জলাশয় বন্ধ করে দেয়া হবে। নদী ভরাট-দখল করে ফেলা হবে। এই অবস্থায় কোথাও আগুন লাগলে তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা তো কঠিন হবেই। পুকুর, জলাশয় আগের অবস্থায় থাকলে আগুনের দুর্ঘটনা রোধে এত বেগ পেতে হতো না। তিনি বলেন, ঢাকায় নবাবী আমলে নবাবরা অনেক স্থানে হাইড্রেন্টও নির্মাণ করেছিলেন। সেখান থেকে সাধারণ মানুষ পানি ব্যবহার করত। সেই হাইড্রেন্টও আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। পানির এই উৎস বন্ধ না করে রক্ষণাবেক্ষণ করলে পানি পাওয়ার দ্রুত একটা উপায় থাকত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্রুত পানি পাওয়ার উপায় হিসেবে ঢাকার একটি স্থানেও এই ধরনের হাইড্রেন্ট নেই। কিছু কিছু ফ্ল্যাট বাড়িতে হাইড্রেন্টের বিকল্প হিসেবে পাইপ লাইনের পানি ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কোনদিন ব্যবহার হয় না বা মহড়া দেয়া হয় না। অথচ পার্শ্ববর্তী কলকাতা শহরেও রাস্তায় রাস্তায় দ্রুত প্রয়োজনের পানির ব্যবহারের উৎস হিসেবে ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে এসব উৎস থেকে পানি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া সাধারণ মানুষ গোসল বা অন্য কাজে হাইড্রেন্ট থেকে পানি ব্যবহার করে থাকে। ঢাকা শহরে প্রায় দেড় কোটি লোকের বসবাস। অথচ এই শহরে জরুরীভাবে পানির উৎস হিসেবে ব্যবহারের জন্য সরকারীভাবে একটিও ফায়ার হাইড্রেন্ট করা হয়নি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। শুধুমাত্র ওয়াসা সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পানি সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা করে থাকে। কিন্তু ওয়াসার পানি অগ্নিদুর্ঘটনায় ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। বাসাবাড়িতে যে পাইপ লাইনের সাহায্যে পানি সরবরাহ করা হয় সেখান থেকে আগুন নেভানোর জন্য পানি ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। পানির উৎসের ব্যবহারের কোন সুযোগ না থাকায় প্রতিবার আগুন দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়। প্রয়োজনীয় পানির অভাবে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি আরও বেড়ে যায়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হাইড্রেন্ট স্থাপনের কোন বিকল্প নেই। আগুন নিয়ন্ত্রণে আরও একটি সমস্যা হচ্ছে ঘিঞ্জি পরিবেশ। পুরান ঢাকার অলিগলি এতটাই ঘিঞ্জি যে ফায়ার সার্ভিসের কোন গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবস্থা শুধু পুরান ঢাকায় নয়। কাঁঠালবাগান, নাখালপাড়াসহ আরও অনেক স্থানে ঘিঞ্জি পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ঘিঞ্জি পরিবেশে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বড় সমস্যায় পড়তে হয়। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক আব্দুস সোবহান বলেন, ঢাকায় পুকুর জলাশয় নষ্ট করে পানির উৎস যেমন নষ্ট করা হয়েছে। আবার ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণেও ঘটনাস্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, সরকারের উচিত হবে আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে উৎসের পানির ব্যবহারের জন্য হাইড্রেন্ট নির্মাণ করা। পাশাপাশি ঘিঞ্জি পরিবেশে ফায়ার সার্ভিস ছোট গাড়ি ব্যবহার করতে পারে। বড় গাড়ি দূরে রেখে সেখান থেকে পাইপে করে ছোট গাড়িতে করে পানি নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় দুইশ’ বছর আগে থেকে ফায়ার হাইড্রেন্ট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে বাংলাদেশে এখনো এই ব্যবস্থাটির ব্যবহার হয় না। ফায়ার হাইড্রেন্টকে ফায়ার প্লাগ, ফায়ার পাম্প কিংবা শুধু পাম্প নামেও বিভিন্ন দেশে ডাকা হয়। এটি মাটির ওপরে কিংবা নিচে দুইভাবেই স্থাপন করা যায়। এটি দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি ‘ওয়েট ব্যারেল ফায়ার হাইড্রেন্ট’। এতে অবিরত পানি সরবরাহ থাকে। অন্যটি হলো ড্রাই ব্যারেল হাইড্রেন্ট। এ ধরনের পাম্পে বৈদ্যুতিক যন্ত্র বা ঢাকনি দ্বারা পানি সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। প্রয়োজনের সময় ঢাকনি সরিয়ে দিলে বা বৈদ্যুতিক যন্ত্র চালু করলে পানি সরবরাহ হয়। এটি এমন এক ব্যবস্থা যা পানির প্রধান উৎসের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যে কোন জরুরী প্রয়োজনে এই উৎস থেকে পানি সরবরাহ করা যায়। এর বড় সুবিধা হচ্ছে এর সঙ্গে লম্বা পাইপ যুক্ত করে ইচ্ছেমতো যেকোন দূরত্বে পানি সরবরাহ করা যায়। এ কারণেই বিশ্বের বড় বড় শহরে অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা হিসেবে এই প্রযুক্তির প্রচলন রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত বড় শহরগুলোর বিভিন্ন রাস্তায় ফায়ার হাইড্রেন্ট বা পানির পাম্প স্থাপন করা হয়। কোথাও কোন আগুন লাগলে এই পাম্প থেকে অল্প সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হয়। তাদের মতে, পুরান ঢাকার মতো অনেক স্থানে আগুন লাগলে সরু রাস্তা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। এই অবস্থায় এসব এলাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে এসব এলাকায় ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা থাকলে লম্বা পাইপ দিয়ে প্রয়োজন অনুসারে পানি সরবরাহ করা যায়। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার ৫ দশক হয়ে গেল, অথচ এখনও বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির প্রচলন দেখা যায়নি। অথচ প্রতিবছরই প্রধান এই শহরে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। ফায়ার সার্ভিস আধুনিক করা হলেও জনাকীর্ণ এলাকায় প্রয়োজনীয় পানি নিয়ে সেখানে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এসব এলাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য পানি সরবরাহে ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা স্থাপনে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরী হয়ে পড়েছে।
×