ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চোখের জলে লেখা ১৬১ সাক্ষ্য বলছে- গণহত্যা

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

চোখের জলে লেখা ১৬১ সাক্ষ্য বলছে- গণহত্যা

মোরসালিন মিজান ॥ মানুষ-ই মারছে আরেক মানুষকে। দানবের হয়েছে রাষ্ট্র। নিজ দেশের নাগরিকের সুরক্ষায় কোন উদ্যোগ নেই। বরং সরাসরি সরকারের নির্দেশে হত্যাকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। ভয়ঙ্কর বীভৎস এই আক্রমণের শিকার মিয়ানমারের সংখ্যালঘু অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। গোটা পৃথিবী এখন এই বর্বরতা সম্পর্কে অবগত। বিচারের জোর দাবি উঠেছে। কাজ শুরু করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। তবে এই বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে হলে গণহত্যা প্রমাণ করা জরুরী। আর এ জরুরী কাজটি গত এক বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে করছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। জাদুঘরের ‘সেন্টার ফর দা স্টাডি অব জেনোসাইড এ্যান্ড জাস্টিস’ মানবিকতার বোধ সম্পন্ন এক ঝাঁক তরুণ-তরুণীকে একত্রিত করেছে। সকলেই স্বেচ্ছা কর্মী। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সমব্যথী হয়ে নির্যাতিতদের সঙ্গে মিশছেন। তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করছেন। এভাবে বহু মানুষের সাক্ষাতকার। ১৬১ টেস্টিমনি। প্রতিটি টেস্টিমনি যেন চোখের জলে লেখা। আহারে মৃত্যু! মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া। আগুন। ধর্ষণে ক্ষতবিক্ষত শরীর। নতুন করে সামনে আসে সব। নিজের অজান্তেই মনে পড়ে যায় একাত্তরের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত বাঙালী আজকের বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ঠিক আপন করে নিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, একই বোধ থেকে গণহত্যার তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। সেন্টারের পক্ষে নেমে পড়ে একদল তরুণ-তরুণী। ভাবতে অবাকই লাগে, বিশেষ কোন প্রাপ্তির কথা চিন্তা না করেই এমন চ্যালেঞ্জিং কাজে নেমে পড়ার মতো ছেলে মেয়ে আছে জাদুঘরের সন্ধানে। গবেষণার মন নিয়ে এগিয়ে এসেছেন সবাই। গত বছরের অক্টোবরে শুরু। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিল থেকে মে পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে সাক্ষাতকার গ্রহণ ও তথ্য সংগ্রহের কাজ চলে। তিন দফায় কক্সবাজারের আটটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যায় গবেষক দল। আক্রমণের শিকার ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী এবং ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার ১৬১ জনের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে। এরই ফল- ‘The Rohingya Genocide : Compilation and Analyses of Survivors Testimonies’ শীর্ষক ৯২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিটি ধারা উপধারা মেনে তথ্য সংগ্রহ ও বিচার বিশ্লেষণ শেষে প্রকাশ করা প্রতিবেদনটি হয়ে ওঠেছে গণহত্যার দলিল। এসব দলিল গণহত্যাসহ অন্যান্য মারাত্মক অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। শনিবার সকালে জাদুঘর মিলনায়তনে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। গবেষক দলের সদস্যরা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন। এ সময় জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সেন্টারের পরিচালক মফিদুল হক, জিয়া উদ্দীন তারিক আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত প্রতিবেদন ছয়টি অধ্যায়ে ভাগ করে নেয়া হয়েছে। রয়েছে ১১টি সংযুক্তি। তারও আগে গবেষণা পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। কিছু প্রশ্ন ছিল নির্যাতিদের কাছে। সময় নিয়ে ধৈর্যসহকারে সেইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন নিবেদিত প্রাণ কর্মীরা। পুস্তিকার প্রথম অধ্যায়ে গবেষণার ধরন, পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা দেয়া হয়েছে। এ থেকে কাজের মান ও অভিষ্ট লক্ষ্য সম্পর্কে পূর্বানুমান করা সম্ভব হয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইতিহাসের আলোকে রোহিঙ্গা নির্যাতন। রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার অতীত। নিগৃহীত হওয়ার প্রেক্ষাপট। তথ্য প্রমাণ তুলে ধরে দেখানো হয়েছে, এই নির্যাতন হঠাৎ করেই নয়। শুধু ধর্ম এবং জাতিগত কারণে রোহিঙ্গারা যুগের পর যুগ ধরে আক্রান্ত হচ্ছে। জাতিগত নির্মূলের লক্ষ্যেই এমন আক্রমণ। তৃতীয় অধ্যায়ে মিয়ানমারের আইনী কাঠামো। নাগরিকত্ব আইনটি বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, কিভাবে রোহিঙ্গারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। মিয়ানমারে যা হয়েছে এবং হচ্ছে তা ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’ বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। চতুর্থ অধ্যায়ে মূল বলাটি। এ অধ্যায়ে সমকালীন আন্তর্জাতিক দু’টি আইন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একটি ১৯৪৮ সালের গণহত্যা নিরোধ কনভেনশন। অন্যটি ১৯৯৮ সালে গৃহীত আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন। উভয় আইনের আলোকে গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, মিয়ানমারে যে মানুষ হত্যা হয়েছে তা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ‘গণহত্যা’ বৈ সাধারণ খুনোখুনি নয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের সব বৈশিষ্ট্য গবেষকরা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। পঞ্চম অধ্যায়ে অসহায় নারীদের, ছোট ছোট মেয়েদের ধর্ষিতা হওয়ার করুণ কাহিনী। শাফাত আরা ছদ্ম নামে এক ধর্ষিতা জানিয়েছেন, মিয়ানমার আর্মি তাদের বাসায় আক্রমণ করে। তাকেসহ তার দুই ছোট বোনকে বাবা-মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। রক্ষা করতে এগিয়ে এলে বাবা মা ও ভাইদের বেদম প্রহার করা হয়। তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। পরে অন্য রুমে নিয়ে গিয়ে তিন থেকে চারজন সৈন্য তাদের ধর্ষণ করে বলে তথ্য দেন শাফাত আরা। হাসিনা বেগম ছদ্ম নামের আরেক নারী জানান, মিয়ানমার আর্মির সদস্যরা ঈদ-উল-আজহার মাত্র চারদিন আগে তাদের বাড়িতে হামলা চালায়। একপর্যায়ে ১২ আমি সদস্য মিলে তাকে টেনে হিচড়ে পাশের জঙ্গলে নিয়ে যায়। এবং সেখানেই ধর্ষণ করা হয় তাকে। হাসিনা খাতুন ছদ্মনামে দেয়া বর্ণনাটি আরও হৃদয় বিদারক। তিনি জানান, ধর্ষণের শিকার হয়ে নগ্ন অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবেশ করেন তিনি। ধর্ষণের আরও অনেক তথ্য আইনী কাঠামোর আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন গবেষকরা। এভাবে ষষ্ঠ অধ্যায়ে এসে যৌক্তিকভাবে বিচারের দাবি তোলা হয়েছে। বিচার কীভাবে করা যাবে? বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। কারা দায়ী? কীভাবে তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা দেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে নিজেদের গবেষণা তথ্য তুলে ধরে দলের অন্যতম সদস্য ইমন আজাদ বলেন, আমাদের জন্য কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। জটিলতা ছিল অনেক। এর পরও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছি। গণহত্যার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা প্রকাশ করেছি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মিয়ানমারে সংগঠিত গণহত্যার বিচারের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে। আমরা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিচার প্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে চাই। তাদের গবেষণায় পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেন উদ্যমী তরুণ। আরেক গবেষক শাওলি দাসগুপ্ত বলেন, আমরা ফিল্ড ওয়ার্কের মাধ্যমে ১৬১টি হিউম্যান স্টোরি সংগ্রহ করেছি। ‘র ইমেজটা’ তুলে এনেছি। আমাদের ফাইন্ডিংস বলবে, মিয়ানমারে গণহত্যা হয়েছে। গবেষক দলে ছিলেন একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। নামÑ শারমিন সুলতানা স্বাতি। কথা বলার সময় বার বার কণ্ঠ যেন বুজে আসছিল তার। চোখ যে ভেজা, দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছিল। কেন? কারণ ধর্ষিত নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে মিশেছিলেন তিনি। বলছিলেন, ধর্ষিতারা এখনও আতঙ্ক থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি। সেক্সচুয়াল ভায়োলেন্সের কথা বলতে গিয়ে তারা অঝর ধারার কাঁদছিলেন। বারবার কথা আটকে যাচ্ছিল। কথা শেষ করতে পারছিলেন না। কেউ কেউ সেন্স লেস হয়ে পড়ছিলেন। এ অবস্থায় মনো চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কাজ করেছি আমি। গবেষকরাও বর্ণনা শুনে স্থির থাকতে পারেনি। তারাও কেঁদেছেন। আমাদের একাত্তরের কথা মনে পড়ে গেছে... স্বাতিরও কথা আটকে যায়। আবেগঘন হয়ে ওঠে মিলনায়তনের পরিবেশ। এ ধরনের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে, গবেষণাকে সফল করতে নেপথ্যে থেকে কাজ করছেন মফিদুল হক। জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সেন্টারের পরিচালককে এদিন বেশ তৃপ্ত বলে মনে হয়েছে। গবেষণায় অংশ নেয়া তরুণ-তরুণীদের নিয়ে গর্ব করেন তিনি। আনুষ্ঠানিক আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রক্তাক্ত ভ‚মিতে পরিণত হয়েছিল। এদেশের এক কোটি মানুষ প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আর ২০১৭ সালে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা নৃজাতির সদস্যরা গণহত্যার শিকারে পরিণত হয়। সেখানকার ক্ষুদ্র এই জনগোষ্ঠীর প্রায় দশ লাখ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ ঘটনা আমাদের একাত্তরের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর একাত্তরের গৌরবময় সংগ্রাম ও গণহত্যার স্বরূপ উদ্ঘাটন, সংরক্ষণ ও উপস্থাপনের কাজের পাশাপাশি গণহত্যার বিচার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা জেনোসাইড বিষয়ে গবেষণার উদ্যোগ নেয়া হয়। গবেষণা মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, আমাদের বিশ্লেষণ একান্তভাবে আইনগত দৃষ্টিতে করা হয়েছে। গণহত্যা ও মানবতবিরোধী অপরাধীরা যেন কোনভাবে কখনই রেহাই পেতে না পারে, সেই প্রত্যয় থেকে সাক্ষ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণে আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি পরিপূর্ণভাবে অনুসরণের চেষ্টা করা হয়েছে। তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার কাজকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
×