ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিপিডির সংলাপে রেহমান সোবহান

ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা ও খেলাপী ঋণের সংস্কৃতি জিয়ার আমল থেকেই

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৫ জুন ২০১৮

 ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা ও খেলাপী ঋণের সংস্কৃতি জিয়ার আমল থেকেই

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে আজকে ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা ও খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি, এটা এই সরকারের সৃষ্টি নয়। বরং এটা অনেক বছরের জিইয়ে রাখা একটা সমস্যা। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসন আমল থেকে এটার শুরু। এরপর থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এ সমস্যা আজ প্রকট আকার ধারণ করেছে। রবিবার রাজধানীর এক হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সংস্থাটির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান এসব কথা বলেন। তবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ব্যাংক সেক্টরে রিফর্মস (সংস্কার) এনে ভালদের পুরস্কৃত করা হবে। আর খারাপরা যতই প্রভাবশালী হোক তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে পাওনা আদায় করা হবে। ‘সিপিডি বাজেট ডায়লগ ২০১৮’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক অডিটর জেনারেল এম হাফিজ উদ্দিন খান, মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি নিহাদ কবির, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও সাবেক সচিব সোহেল আহমেদ চৌধুরী আলোচনা করেন। সংলাপের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সঞ্চালনা করেন সংস্থার সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, দেশে দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। খেলাপী আমাদের আশঙ্কা নয়, বরং আর্থিক খাতের কাঠামোর ধরন নিয়েই আমাদের শঙ্কা। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে কাজ করে যাওয়ার পরামর্শ দেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েই ক্ষান্ত হলে হবে না। আমাদের গতিশীল কর্মকা- দিয়ে দেশকে আরও উন্নত করার তাগিদ থাকতে হবে। ভিয়েতনাম প্রায় আমাদের সমানসম্পদ নিয়ে কতটা উন্নতি করেছে, আমরা তা পারিনি। আমরা যেখানে এখনও মাত্র ৪০ বিলিয়ন রফতানি করি, সেখানে ভিয়েতনাম করে ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০১৭ সালে প্রায় ভিয়েতনামের ৩৮ শতাংশ বৈদ্যুতিক পণ্য রফতানির তথ্য তুলে ধরে তিনি পণ্যের বাজারে বহুমুখীকরণের উপর জোর দেন। অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, টাকা নেই বলে কোন ব্যাংক খাতে কোন চেক রিটার্ন হয়নি। ফারমার্স ব্যাংককে আমরা হাতে নিয়েছি। এটা লুটপাট এবং শেষ হয়ে গেল এমন মন্তব্য করার সুযোগই এ মুহূর্তে নেই। শিক্ষিত বেকারের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা বেকার রয়েছেন তারা এ কাজ করবে না, ময়মনসিংহ যাবে না, গুলশানে না হলে যাবে না, আইটি সেক্টরে কাজ করব না। আমাদের লেবার যারা, কোথাও বেকার নেই। কত ধরনের ব্যবসা যে এই মুহূর্তে ঢাকায় আছে, উবার, সাইকেল উবারও বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি যারা বেকার আছে তারা ইচ্ছা করেই বেকার। এর আগে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু বলেন, ইদানিং দেশের পাঁচ শতাংশ লোকের আয় কতগুণ বেড়েছে তা আমরা জানি না। তবে যা বেড়েছে তা অবিশ্বাস্য। তারা সারাবিশ্বে বাড়িঘর কিনছে। তাদের টাকা রাখার জায়গা নেই। সাধারণ মানুষের ওপর ট্যাক্স কমিয়ে এ পাঁচ শতাংশ মানুষকে ট্যাক্সের আওতায় আনা গেলে, এনবিআরের ট্যাক্স আদায় বহুগুণ বেড় যাবে। তিনি আরও বলেন, যারা ব্যাংক লুট করছে, আপনারা তাদের ট্যাক্স কমিয়ে দিচ্ছেন। আবার যারা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নিচ্ছে না। ব্যাংকিং ডিভিশন বলে আপনারা যে জিনিসটা তৈরি করেছেন, এটাকে অবলোপন করে দেন। দয়া করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজগুলো তাদের করতে দেন। একটি হোটেলে ব্যাংক মালিকদের সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর যাওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নরকে হোটেলে নিয়ে সিআরআর কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। চিন্তা করেন ইনস্টিটিউটশন কোথায় গেছে? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর একটি প্রতিষ্ঠান, ওই প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা প্রশ্নাতীত। সেই গবর্নরকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হোটেলে। কারা হোটেলে? সব ব্যাংকের মালিকরা বসে আছে। তাদের বড় অংশই ব্যাংক লুটেরা। অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতা আমীর খসরুকে উদ্দেশ করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আপনাদের (বিএনপি সরকারের আমলে) সময় কত মাস ব্যাংকে গিয়ে টাকা পাওয়া যায়নি। আমাদের সময় অনিয়ম হয়নি এমন কথা বলব না। তবে আমরা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের রিফর্মস আনব। রিফর্মস এনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও শক্তিশালী করব। তিনি বলেন, আমরা কোন ব্যবস্থায় নেইনি এমন অভিযোগ সঠিক না। যারা ভাল তাদের যত প্রকারের উৎসাহ দেয়া যায় দেয়া হবে। আর খারাপ যারা আছে, তারা যত বড়ই হোক তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং তাদের কাছ থেকে পাওনা আদায় করা হবে। ব্যাংক খাতের কর্পোরেট কর কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, রফতানি ও সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। কর্পোরেট ট্যাক্স অনেক বেশি। এ ট্যাক্স নেট যদি আমরা না কমায় বিদেশীরা বিনিয়োগ করবে কেন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবেশী দেশকে বাংলাদেশ ঋণ দেবে উল্লেখ করে কামাল বলেন, ২০২৩ সাল নাগাদ আমাদের আর অন্য দেশ থেকে টাকা ধার করতে হবে না। আমরা বরং টাকা ধার দেব। চীন আমাদের ঋণ দিচ্ছে, অথচ ওদের ঋণের পরিমাণ জিডিপির তুলনায় ১৮৫ শতাংশ। একশ শতাংশের নিচে কোন দেশে নেই। আমার লেখাপড়া যদি সত্য হয়, তাহলে ২০৩০ সাল নাগাদ আমরা আশপাশের দেশকে ঋণ দেব। নতুন অর্থবছরের (২০১৮-১৯) প্রস্তাবিত বাজেটের সমালোচনা করে ব্যবসায়ী নেতা মনজুর আহমেদ বলেন, এ বাজেট শুধু ব্যবসায়ী বিরোধী নাই, এটা সরকার বিরোধী বাজেট। যারা ট্যাক্স দিয়ে ব্যবসা করছেন এবং যারা ট্যাক্স দিচ্ছেন না তাদের মধ্যে বিরাট গ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, রাজস্ব বাড়াতে হলে করজাল বাড়াতে হবে। আমরা এ জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়ে ছিলাম। কিন্তু বাজেটে তার কোন প্রতিফল হয়নি। মুক্ত আলোচনায় এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ ও ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়ন করতে হলে বাজেটের আকার বাড়বে। তেমনি এর যোগানের লক্ষ্যে রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার জরুরী। তা না হলে বাজেট বাড়লেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। এনজিও প্রতিনিধি খন্দকার আরিফুল ইসলাম বলে, বাজেটে প্রতিবারই ৫-২৫ শতাংশ বাড়ছে। ১৯৫৮ সালের কাঠামোতে এখন পর্যন্ত কোন পরিবর্তন আসেনি। তাই আকার বাড়ানোর সঙ্গে কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরী। সিপিডির সম্মানিত ফেলো রওনক জাহান বলেন, অনেকে এবারের বাজেটকে নির্বাচনী বাজেট বলেছেন। দারিদ্র্য মানুষের জন্য প্রতিবার বরাদ্দ থাকে। সামাজিক সুরক্ষায় বাজেট বাড়ছে। এটি সত্য হলেও এদিয়ে ভোটার টানা যাবে না। সরকারের নয় বছরে সাধারণ মানুষের বৈষম্য বেড়েছে। ফলে এ বাজেটে ভোটার আকৃষ্ট করার কিছু নাই’। অতিথিদের বক্তব্যে এমসিসিআই প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার নিহাদ কবির বলেন, দেশে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। কারণ ব্যবসায় ব্যয় বাড়ছে। সরকারী অফিসে সময় বেশি লাগছে, ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা বলা হলেও তা দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া সরকারে নীতির ধারাবাহিকতা না এবং ব্যবসায়ীরা কর জটিলতার জন্য সবসময় ভয়ে থাকে। এসব বিষয়ে সরকারের নজর থাকা দরকার। বাজেট বাস্তবায়নে কর আদায় সহজীকরণ, প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
×