ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাস চাপায় পা হারানো রোজিনাকে বাঁচানো গেল না

প্রকাশিত: ০৫:০১, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

বাস চাপায় পা হারানো রোজিনাকে  বাঁচানো গেল না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বনানীতে বাসের চাপায় পা হারানো রোজিনা আক্তারকেও (২১) বাঁচানো গেল না। নয় দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে রবিবার সকাল সাতটা ২০ মিনিটে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক আবুল কালাম জানান, আঘাত থেকেই রোজিনা আক্তারের মৃত্যু হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়ার রসুল মিয়ার মেয়ে রোজিনা গত ১০ বছর ধরে গাজী টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। ইশতিয়াক রেজা জানান, রোজিনা তার পরিবারেরই একজন হয়ে উঠেছিলেন। গত ২০ এপ্রিল রাতে বনানীতে রাস্তা পার হওয়ার সময় বিআরটিসির একটি বাসের চাপায় তার ডান পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে তাকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। সেখানে দুই দফা অস্ত্রোপচার করে তার ডান পা উরুর গোড়া থেকে ফেলে দিতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা। পরে অবস্থার অবনতি হতে থাকায় গত ২৫ এপ্রিল রোজিনাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করে হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) রাখা হয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসকদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। রোআক্তারের জন্য গঠিত ৯ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান আবুল কালাম আজাদ জানান, গত বুধবার রোজিনাকে যখন পঙ্গু হাসপাতাল থেকে এখানে পাঠানো হয়। তখনই তার শ্বাসকষ্টের উপসর্গ দেখা যাচ্ছিল। বড় আঘাত, বড় অস্ত্রোপচারের পর এমনটা হয়ে থাকে। কিডও ফুসফুস ঠিকমতো কাজ করলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার থেকেই তার শ্বাসকষ্টটা বাড়ছিল। তিনি জানান, রোজিনাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়ে। পরে আর ওই অক্সিজেনেও কুলোচ্ছল না। শনিবার থেকে জ্বর আসে। ধারণা কর, সংক্রমণ বা রক্তে জীবাণু ঢুকে পড়ে। শনিবার রাতেই তাকে ভেন্টিলেশনে দেয়া হয়। তবে বাঁচানো যায়। এদিকে রোজিনার দুর্ঘটনার পর থেকেই তার বাবা ও স্বজনরা হাসপাতালে এসেছিলেন। মেয়ের জীবন নিয়ে প্রতিনিয়ত শঙ্কায় থেকেছেন বাবা রসুল মিয়া। মেয়ে যেন সুস্থভাবে ফিরে আসে তাদের কাছে। তবে তাদের সেই চাওয়া পূর্ণ হলো না। রোজিনার বাবা ধোবাউড়ার রসুল মিয়া পরের জমি চাষ করেন। রসুল মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আর কারও ভ্যা যেন এমন না হয়। তবে তিনি তার মেয়ের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের কাছে ক্ষতিপূরণ দাকরেছেন। রোজিনার চাচা সুরুজ মিয়া জানান, পা হারিয়ে টানা আটদিন হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে বারবার আঁতকে উঠত রোজিনা। প্রথম কয়েক দিন জানত না যে তার পা নেই। যখন জানল তখন থেকেই রোজিনা বলত, যে আমার পা কেড়ে নিয়েছে দেখবেন ঠিকই সে সবার সামনে ঘুরে বেড়াবে। আর আমি ঘরে বন্দী হয়ে থাকব। সে সবসময় বলত যেন অপরাধীর শাস্তি হয়। তার একটাই ইচ্ছা ছিল যেন অপরাধীর শাস্তিটা নিজ চোখে দেখে যেতে পারে। সুরুজ মিয়া জানান, কই আর শাস্তি হলো। উল্টো মেয়েটার প্রাণটাই চলে গেল। তার স্বপ্নটা অপূর্ণই থেকে গেল। তার কাছে রোজিনা ছিল অন্য আট-দশটা মেয়ের চেয়ে আলাদা। সুরুজ মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, রোজিনা অভাব অনটনে বড় হলেও তার ছিল অসাধারণ গুণাবলী। সে অন্যের বাসায় কাজ করে নিজের পাশাপাশি পরিবারও চালাত। যে বাসায় সে কাজ করত সেখানে সবাই তাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখত। কখনও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি ওই পরিবার। সবাই প্রশংসা করত। কিন্তু এত ভাল মেয়ে এভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাবে তা কেউ ভাবতে পারিনি। একথা বলতেই কণ্ঠ যেন ধরে আসছিল তার। সম্প্রতি কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনায় রোজিনার মতো কয়েকটি হতাহতের ঘটনা নিয়ে সড়কের বিশৃঙ্খলার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে। রাজধানীর কাওরানবাজারে গত ৩ এপ্রিল দুই বাসের রেষারেষিতে পড়ে হাত হারান তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন। ওই ঘটনায় তিনি মাথায়ও আঘাত পান। ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ এপ্রিল রাতে মৃত্যু হয় ওই তরুণের। রাজীবের ওই দুর্ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে আলোড়িত করে। এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই ১৭ এপ্রিল গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় হৃদয় মিনার নামের ৩০ বছর বয়সী এক বাসযাত্রীর হাত বাহু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ সময় একটি ট্রাক ওই বাসের গা ঘেঁষে যাবার সময় এই দুর্ঘটনা ঘটে। এরপর সপ্তাহ না ঘুরতেই গত ২০ এপ্রিল রাতে রাজধানীর বনানীতে বিআরটিসি বাসের (ঢাকা মেট্রো ব-১১-৫৭৩৩) দুর্ঘটনায় রোজিনার ডান পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোজিনা জানিয়েছিলেন, রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি গাড়ির ধাক্কায় তিনি পড়ে যাওয়ার পর বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাস তার ওপর দিয়ে চলে যায়। সে সময় বাসটি থামানো হলে তার এই পরিণতি হতো না। সে সময় আশপাশে পুলিশসহ অনেকে ছিল জানিয়ে রোজিনা জানান, দুইবার আমার ওপর দিয়ে চাকা চলে গেছে। আমি শুধু বলছিলাম, আমাকে একটু হসপিটালে নিয়ে যান। এরপর আর কিছু জানি না। অনেক মানুষকে বলছি আমাকে একটু হসপিটালে নিয়ে যেতে। সার্জেন্টও ছিল। কিন্তু ধরে নাই। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করান। ওই ঘটনায় গাজী টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার মহিউদ্দিন আহমেদ রাজধানীর বনানী থানায় মামলা দায়ের করেন।
×