ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘সা-ধু সা-ধু’ ধ্বনি ॥ রাঙ্গামাটিতে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা

বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলায় প্রকাশ হলো

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৬ আগস্ট ২০১৭

বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলায় প্রকাশ হলো

নিজস্ব সংবাদদাতা, রাঙ্গামাটি, ২৫ আগস্ট ॥ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবং ধর্মীয় ভাবগম্ভীরতার পাশাপাশি আনন্দ উল্লাসমুখর পরিবেশে এর মোড়ক উন্মোচন করা হয় শুক্রবার দুপুরে রাঙ্গামাটির রাজবন বিহারে। এ সময় ‘সা-ধু সা-ধু’ ধ্বনিতে পুরো রাজবন বিহার অঙ্গন মুখরিত হয়। ইতোপূর্বে পালি ভাষায় রচিত ৫৯ গ্রন্থের ত্রিপিটক গ্রন্থকে বাংলায় সাবলীল ভাষায় ২৫ খ-ে বিভক্ত করে পবিত্র এ ধর্মগ্রন্থকে প্রকাশ করেছে ত্রিপিটক পাবলিশিং সোসাইটি। বাংলায় সমগ্র ত্রিপিটক প্রকাশনা অনুষ্ঠান-২০১৭ নামে দুইপর্বে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। প্রথমপর্বে ছিলÑ বৌদ্ধ পতাকা উত্তোলন, পূজনীয় ভিক্ষু সম্মেলন মঞ্চে আগমন, ত্রিশরণসহ পঞ্চশীগ্রহণ, সংঘদান, অস্ত পরিষ্কার দান ও বুদ্ধমূর্তি দান প্রভৃতি, ভিক্ষুদের ধর্মদেশনা, ভিক্ষু সংঘকে পি-দান। দুপুরের পর বৌদ্ধ ধর্মীয় উদ্বোধনী সঙ্গীতের মাধ্যমে দ্বিতীয়পর্বের অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এ পর্বে ছিল ত্রিশরণসহ পঞ্চশীল গ্রহণ ও পবিত্র ত্রিপিটক উৎসর্গ, ত্রিপিটকের মোড়ক উন্মোচন, আমন্ত্রিতদের ত্রিপিটক সেট হস্তান্তর ও ভিক্ষুদের ধর্মদেশনা। রাজবন বিহার মাঠে ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকের বাংলা সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বনভান্তে শিষ্য সংঘের শীর্ষগুরু ও রাজবন বিহারের প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞলংকার মহাস্থবির ও চাকমা রাজার স্ত্রী রানী ইয়ান ইয়ান রায়সহ হাজারো ভক্তের সাধু সাধু ধ্বনির মধ্য দিয়ে ভিন্ন আবহের সৃষ্টি করে। ত্রিপিটকের মোড়ক উন্মোচনের পরপর বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের নিকট ত্রিপিটকের শুভেচ্ছা কপি তুলে দেয়া হয়। এর প্রথম কপি তুলে দেয়া হয় রাজবন বিহারের প্রধান ধর্মীয় গুরু প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবিরকে। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য ত্রিপিটকের একসেট কপি প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও এ সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা তা গ্রহণ করেন। রানী ইয়ানকে ও বান্দরবানের রাজাকে একসেট করে ত্রিপিটক তুলে দেন। এরপর অনুষ্ঠানে আগতদের উদ্দেশে শুভেচ্ছা ভাষণ দেন ত্রিপিটক প্রকাশনা কমিটির সভাপতি মধু মঙ্গল চাকমা। এতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ডঃ দিলীপ কুমার বড়ুয়া, সভাপতি দি ওয়ারেল্ড বুড্ডিস্ট ওয়েলফের এর সভাপতি মেজর অব. অজয় চাকমা, গৌতম দেওয়ান প্রমুখ। বাংলায় রচিত এ ত্রিপিটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলোÑ এটি সাবলীল বাংলায় প্রকাশিত। এর বানান প্রমিত বাংলায় করা হয়েছে, যাতে করে পড়ার ক্ষেত্রে সকল বয়সের মানুষের জন্য সহজ হয়। বৌদ্ধ পরিভাষাগুলো বানান অর্থপূর্ণ সমম্বয় সাধন করা হয়েছে। এ গ্রন্থের সূচীপত্র সুন্দরভাবে বিন্যাস্ত করা হয়েছে। বাংলা ভাষার হাজারো বছরের ইতিহাসে এই প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও সমগ্র ত্রিপিটক প্রকাশ করা হলো। তাই এ দিনটি বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের । ইতোপূর্বে বাংলা ভাষায় খ- খ-ভাবে ত্রিপিটক সংস্করণ বের করা হলেও পূর্ণাঙ্গভাবে এটির কোন সংস্করণ বের করা হয়নি। বিগত ১৩০ বছরে ত্রিপিটকের মাত্র ৩৬টি খ- বাংলায় প্রকাশ করা হয়েছিল। এটি বাংলা ভাষায় প্রকাশ করায় ভগবান গৌতম বুদ্ধের অমূল্য উপদেশবাণী বাংলা ভাষাভাষীদের জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ।এটি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে বলে পাবলিশিং সোসাইটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। ত্রিপিটক প্রকাশনা কমিটি সূত্রে জানা যায়, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভগবান গৌতম বুদ্ধ আরহৎ লাভের পর মানবমুক্তির জন্য ধর্ম প্রচার করেছিলেন। সেই সাধনালব্ধ অর্জিত জ্ঞানদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিনি জীব জগতে হিত-সুখ কামনায় প্রচার করেছিলেন তারই সমন্বিত রূপ হলোÑ ত্রিপিটক। এটি বৌদ্ধদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ। এটি তিনটি পিটকের সমন্বয়ে রচিত। এখানে রয়েছে সর্বমোট ৫৯টি গ্রন্থ। ত্রিপিটক কেবল বৌদ্ধদের নিকট নিখাট ধর্মীয় গ্রন্থ নয়। এইটির জ্ঞানগর্ভ ও সর্বজনীন। যার কারণে সর্বদেশে ও সর্বজনের জ্ঞান অনুসন্ধিসু মনকে আলোড়িত, আর্কষণ, পুলকিত ও বিমুগ্ধ করে। তাই এটি সার্বজনীন। ত্রিপিটক বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অক্সফোর্ডভিত্তিক একটি সংস্থা লন্ডন পালি টেক্স সোসাইটি ত্রিপিটকের পালি ও ইংরেজী সংস্করণ প্রকাশ করে। পরবর্তী সময়ে থাইল্যান্ড, বার্মিজ, চীন, জাপানি, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, সিংহলী, তিব্বতী, ভিয়েতনামী, জার্মান, ফ্রান্স, রুশ, মঙ্গোলিয়ান, নেপালী সংস্কৃতি, তৈলঙ্গি ও হিন্দি ভাষায় অনুবাদ হলেও দীর্ঘদিন ধরে বাংলায় অনুবাদ হয়নি নানা দেশে বহু ভাষায় পূর্ণাঙ্গভাবে এটি প্রকাশিত হলেও বাংলা ভাষায় পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক প্রকাশের ঘটনা এই প্রথম। তবে ত্রিপিটক বিক্ষিপ্তভাবে বাংলানুবাদ শুরু হয় ১৮৮৭ সাল থেকে। সেই সময়ে প্রথম পালি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করা ত্রিপিটকের নাম হলোÑ সুত্তনিপাত গ্রন্থ। এটি অনুবাদ করেন ধর্মরাজ বড়ুয়া। এরপর ১৯১৬ সালে ঈশান চন্দ্র ঘোষ জাতক গ্রন্থটির ৬ খ- বাংলা অনুবাদ করেছেন। ১৯২৮ সালে অগ্রমহাপ-িত প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির সমগ্র ত্রিপিটক বাংলায় প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে কাজ শুরু করে। কিন্তু ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শক্তিশালী বোমার আঘাতে বৌদ্ধ মিশন প্রেস সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেলে সেই উদ্যোগও ভেস্তে যায়। এরপর প্রায় শত বছর পরে এসে রাজবন বিহারের একদল ভিক্ষু এ মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করে পূর্ণাঙ্গ বাংলায় ২৫ খ- ত্রিপিটক প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশের বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রাঙ্গামাটির রাজবন বিহারের প্রধান ও মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্ত আর্যপুরুষ শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভান্তের আশা ও স্বপ্ন ছিল একদিন বাংলা ভাষায় পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক অনুবাদ করা হবে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তারই শিষ্যরা ২০১২ থেকে বাংলায় ত্রিপিটক অনুবাদ করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারই ধারা বাহিকতায় ২০১৫ সালে নয় সদস্যবিশিষ্ট ‘বাংলায় সমগ্র ত্রিপিটক প্রকাশনা কমিটি’ নামক একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি দীর্ঘ দেড় বছর ধরে ত্রিপিটকের পালি ভাষায় রচিত ৫৯টি গ্রন্থকে ২৫ খ-ে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে। তারই ফসল হিসেবে ওইদিন নানা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এর মোড়ক উন্মোচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম বাংলায় পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক প্রকাশিত হলো। অনুষ্ঠানের দেশের বৌদ্ধ প-িরা ছাড়াও ঢাকা ও চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন। ইতোমধ্যে রাঙ্গামাট রাজবন বিহারের নিজস্ব ছাপাখানায় বাংলা ভাষায় পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক গ্রন্থ ছাপানো হয়েছে। এদিকে বাংলা ভাষায় এ প্রথম পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক প্রকাশের জন্য বৌদ্ধ সমাজ স্বাগত ও সাধুবাদ জানিয়ে বলেছেন বাংলায় পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক প্রকাশনা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে নতুন এক ইতিহাস। তাছাড়া পালি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এই প্রথম ত্রিপিটক প্রকাশের ফলে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে গৌতম বুদ্ধের জীবন দর্শন ও শান্তির বাণী মনেপ্রাণে ধারণ করে উপলব্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে তাদের ধারণা। বাংলায় সমগ্র ত্রিপিটক প্রকাশনা কমিটির প্রধান সম্পাদক শ্রীমৎ ইন্দ্রগুপ্ত ভিক্ষু জানান, দশ বছরের অধিক সময় ধরে রাজ বন বিহারের ভিক্ষু শ্রমণ ও ছাপাখানার শ্রমকিরা কাজ করেছেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ধর্মগুরু সাধনা নন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে)’র স্বপ্ন ছিল ত্রিপিটকের সকল খ- বাংলায় প্রকাশ করা। এ প্রকাশনার মাধ্যমে ভান্তের স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় খুশি তার শিষ্যরা। তিনি আরও জানান, ত্রিপিটকের সব খ- রাজবন বিহার থেকে সংগ্রহ করা যাবে। দাম পড়বে ২০ হাজার টাকা। অনুশীলনের জন্য বাংলা একাডেমি, ঢাকা, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয়ে এক সেট করে ত্রিপিটক দেয়া হবে। পার্বত্য নাগরিক কমিটির সভাপতি ও রাজবন বিহার পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, পরম পূজ্য বনভান্তে ইচ্ছা ছিল বাংলা ভাষায় ত্রিপিটক অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়। তারই ইচ্ছা অনুসারে তার শিষ্যম-লীরা ত্রিপিটক প্রকাশনা কমিটি গঠন করে বাংলাদেশে এ প্রথম ২৫ খ-ে সমগ্র ত্রিপিট প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। তবে আগে ত্রিপিটকের বিভিন্ন অংশ বাংলায় আনুবাদ করা হলেও পূর্ণাঙ্গ নেই। তাই একজন বুদ্ধ হিসেবে পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিট প্রকাশে আমরা গর্বিত এবং এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি। সর্বশেষ বিকেলে ধর্মীয় গুদের দেশনার মধ্য দিয়ে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
×