ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে মেয়র আনিসুল হক

শেখ হাসিনার নির্দেশে দু’বছরেই পাল্টে দিয়েছি ঢাকা উত্তর

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৬ মে ২০১৭

শেখ হাসিনার নির্দেশে দু’বছরেই পাল্টে দিয়েছি ঢাকা উত্তর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চলমান উন্নয়ন কর্মকা-, গৃহীত নানা উদ্যোগ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে প্রতি মাসেই ঢাকার বর্তমান চেহারাকে পাল্টে দিয়ে এভারগ্রীন ঢাকা গড়ার ঘোষণা দিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক। একই সঙ্গে ২ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঢাকাকে পাল্টে দেয়ার স্পষ্ট ও কঠোর নির্দেশনার প্রেক্ষিতে অসহনীয় পরিস্থিতিতে চলে যাওয়া রাজধানীকে আপ্রাণ চেষ্টায় সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করেন। তবে এ জন্য গত ২ বছরে সাধারণ নাগরিক, ডিএনসিসির নির্বাচিত সাধারণ ও নারী কাউন্সিলরগণ, সকল দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সরকারের সহায়তায় সম্ভব হয়েছে বলেন মেয়র। সোমবার সকালে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁয়ে ডিএনসিসি কর্তৃক আয়োজিত দেশের সকল গণমাধ্যমের সিনিয়র মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে ‘ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, প্রচেষ্টার ২ বছর’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় মেয়র এসব কথা বলেন। সভায় বিভিন্ন গণমাধ্যমের পরিচালক, সম্পাদক, হেড অব নিউজ, প্রধান বার্তা সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকগণ অংশগ্রহণ করেন। এ সময় মেয়র ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছরে কি কি উন্নয়ন কর্মকা- সম্পাদিত হয়েছে তার বিস্তারিত তুলে ধরেন। মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, একুশে টিভির সিইও মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, চ্যানেল আইয়ের পরিচালক শাইখ সিরাজ, দৈনিক সমকাল সম্পাদক গোলাম সারোয়ার, দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, আরটিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আশিকুর রহমান, এসএ টিভির হেড অব নিউজ মাহমুদ খান ফয়সাল প্রমুখ তাদের ডিএনসিসি সাজাতে করণীয় সম্পর্কে তাদের মতামত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেসবাহুল ইসলাম। এছাড়া ডিএনসিসির সকল উর্ধতন কর্মকর্তাসহ প্রিন্ট, অনলাইন ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন। আনিসুল হক বলেন, গত ২ বছরে পরিকল্পনার প্রায় ৩০ ভাগেরও কম কাজ করেছি বাকি ৭০ ভাগ কর্মকা- চলছে। হাতে নেয়া সকল কর্মকা- শেষ করে পুরো নগরকেই পাল্টে দেব ইনশাআল্লাহ। আগামী ৫ বছর পর ঢাকা হবে আধুনিক ও বাসযোগ্য নগরী। তবে রাজধানীর নাগরিক যন্ত্রণার অন্যতম কারণ হিসেবে সেবা সংস্থার সমন্বয়হীনতা ও সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে বেশকিছু সমস্যার সমাধান তিনি চাইলেও করতে পারেন না বলে আক্ষেপ করেন। মেয়র বলেন, আমরা দুই বছরে অনেক কাজ করেছি তা বলছি না, তবে একটা পরিকল্পনায় পৌঁছেছি। এই দুই বছরে আমি আমার পরিবারকে (ডিএনসিসি) চিনেছি, কাউন্সিলর-কর্মকর্তাদের চিনেছি। মূলত, ঢাকা একটি ভিন্ন ধরনের শহর। ঢাকাকে পৃথিবীর খারাপ শহরগুলোর মধ্যে প্রথম বলা হলেও বর্তমানে তা নিচে নেমে এসেছে। ঢাকা না কি বাসযোগ্য নয়? তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহরের উদাহরণ দিয়ে অবশ্যই ঢাকাকে বাসযোগ্য শহর হিসেবে দাবি করেন। মেয়র বলেন, নানা বাধা সত্ত্বেও রাজধানীতে বিলবোর্ড ও ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণে অনেক মাস্তান ছিল, তাদের তাড়িয়েছি। যাদের কারণে আমাদের বিলবোর্ডে হাত দেয়া যেত না। অনেক হুমকি-ধমকি পেয়েছি। সেই ঢাকাকে আমরা পরিষ্কার করেছি। ঢাকার সড়কে ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন লাগানোর কারণে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করেছি। রাজনৈতিক নেতাদের বাসায় বাসায় গিয়ে হাত ধরে বলেছি। এখন এসব অনেক কমে গেছে। দুই বছরে ২০ হাজার বিলবোর্ড ও ১ লাখ ৭৫ হাজার ব্যানার এবং ফেস্টুন অপসারণ করেছি। বিভিন্ন স্থানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ৫৪টি ভেজালবিরোধী ও অবৈধ দখল ও উচ্ছেদ করতে অভিযান চালিয়েছি। এতে করে আমরা স্থায়ী-অস্থায়ী অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা উৎখাত করেছি। জরিমানা আদায় করেছি প্রায় ৭৭ লাখ টাকা। ডিএনসিসি মেয়র বলেন, এখন পর্যন্ত মোট ৫৪টি অভিযানে ২৬৪টি অভিযোগে ৪৫০টি স্থায়ী অবকাঠামো, ২ হাজার ৭৬৭ অস্থায়ী অবকাঠামো উচ্ছেদ করা হয়েছে। জমি, ফুটপাথ ও ভূমি উদ্ধার করা হয়েছে ৩ লাখ ৩৪ হাজার বর্গফুট। তিনি বলেন, আমরা বুঝে না বুঝেই কিছু সাহসী কাজ করে ফেলেছি। ১০টি স্থানে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করেছি। বিভিন্ন দূতাবাসের দখলে থাকা ফুটপাথ উদ্ধার করছি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সোসাইটি সমিতির প্রশংসা করে বলেন, আমাদের জন্য অসাধারণ কাজ করছে। কোন কোন স্থানে আমরা যা না করেছি, তারা তার চেয়ে বেশি করেছে। ডিএনসিসি এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হিসেবে মেয়র আরও বলেন, আমরা ৫২ মতো সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ করেছি। যাতে বড় ময়লাগুলো এখান থেকে ল্যান্ডফিলে নিয়ে যায়। কয়েকটি ওয়ার্ডে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বেসরকারীভাবে দেয়া হয়েছে। তারা পরিষ্কার করছে। আমিনবাজারের ল্যান্ডফিলটির তিন বছর পর ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমরা সিটি কর্পোরেশনের যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ভেহিকল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করেছি। ফলে একটি যানবাহন সিটি কর্পোরেশনের বাইরে গেলে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা সে সিস্টেম করে দিচ্ছি। প্রশাসনিকভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি। ফুটপাথ বেদখল বিষয়ে আনিসুল হক বলেন, এ দেশে গরিব হকারদের পাশাপাশি বড়লোক হকারও আছেন। যারা বছরের পর বছর জনগণের জায়গা দখল করে রেখেছিলেন। গুলশানের একটি রাস্তায় মোট ১১টি স্থানে হকাররা বসতো তা বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা অনেক জমি ও ফুটপাথ উদ্ধার করেছি। আমরা নাগরিকদের সুবিধার্থে ফাইভস্টার হোটেলের মানের ১২টি পাবলিক টয়লেট তৈরি করেছি। আরও নতুন নতুন স্থানে পাবলিক টয়লেট তৈরি করা হবে। ডিএনসিসির ‘নগর এ্যাপ’ প্রসঙ্গে আনিসুল হক বলেন, আমরা একটি নগর এ্যাপ করেছি। এখানে সবকিছু রয়েছে। আপনি চাইলে কোথায় কী আছে তা সহজেই জানতে পারবেন। এর সঙ্গে পুলিশের একটা সংযোগ থাকবে। চাইলে ওয়াই-ফাইয়ের মাধ্যমে আপনাকে ট্র্যাক করতে পারবে। তিনি বলেন, আবদুল্লাহপুর থেকে ডিএনসিসি এলাকার যানজট নিরসনে আমরা ১১টি ইউলুপ স্থাপন করছি। যা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্মাণকাজ শেষ করা সম্ভব হবে। মেয়র বলেন, পরিবহন সঙ্কট সমস্যার সমাধানে হলি আর্টিজান হোটেলে সন্ত্রাসী হামলার পর গুলশান এলাকায় বিশেষ বাস সার্ভিস ঢাকার চাকা নামে একটি বাস সার্ভিস ও বিশেষ রিক্সা সার্ভিস চালু করেছি। এছাড়া পুরো রাজধানীর জন্য আমরা মোট ৪ হাজার আধুনিক বাস নামানোর কাজ চলমান রয়েছে। আমরা ডিএনসিসি এলাকার মোট ১০টি স্থান যানজটমুক্ত করেছি। এর মধ্যে গাবতলী বাস টার্মিনালের সামনে দখলে থাকা স্থান, তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড অবৈধ দখলমুক্ত করা ও রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়া ফার্মগেট ও মোহাম্মদপুরের বাসস্ট্যান্ড এলাকাকে যানজটমুক্ত করেছি। এছাড়া মিরপুর মাতবর বাড়িতে রাস্তার ওপর থাকা কবরস্থান স্থানান্তর, রায়েরবাজারের এশিয়ার সর্ববৃহৎ কবরস্থান তৈরির কাজ সমাপ্ত করা, বাগে মোনায়েম উচ্ছেদ, গুলশানের মরিয়ম টাওয়ারের জমি উচ্ছেদ করাসহ অসংখ্য জমি দখলমুক্ত করেছি। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত আমরা ১৬৮ কিলোমিটার ড্রেন পরিষ্কার করেছি। এক হাজারটি ওয়েস্টবিন স্থাপন করা হয়েছে। আনিসুল হক বলেন, রাজধানীকে সবুজে সাজানোর জন্য আমরা উত্তরা এলাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সহায়তায় ৩২ হাজার চারা গাছ লাগিয়েছি। পার্ক ও খেলার মাঠকে আধুনিক করতে আমরা মোট ৩২টি পার্ক ও খেলার মাঠকে নতুন করে সাজানো হবে। সর্বসাধারণের জন্য আধুনিক ও প্রতিবন্ধীদের চলার সুবিধার্থে ৬৯ কিলোমিটার ফুটপাথ নির্মাণ করা হয়েছে। মেয়র বলেন, এ পর্যন্ত নতুন পুরাতন মোট ৪০৬টি রাস্তা তৈরি করেছি। এছাড়া আগামী অর্থবছরে এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন আরও ১ হাজার ৩০০ রাস্তা তৈরি করা হবে। পরিবেশ রক্ষায় ২ হাজার ২০০ কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ করা হয়েছে। নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষায় এক হাজার সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আরও ক্যামেরা বসানো হবে। গুলশান বারিধারা বনানী এলাকায় সোসাইটির লোকজন বেসরকারীভাবে একটি রাস্তা একজন ব্যক্তি প্রতিদিন একবেলা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করেছেন। দুই বছরে আমরা প্রায় পৌনে দুই লাখ রোগীকে স্বাস্থ্যসেবার প্রদান করেছি। পথচারীদের সুবিধার্থে ২৭৫টি পথখাবার গাড়ি প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া সৌন্দর্য রক্ষায় বনানী থেকে মহাখালী পর্যন্ত ৩১ বছর ধরে রংবিহীন ৭৮টি ভবনে বাধ্যতামূলকভাবে রং করা হয়েছে। ঠিকাদারদের কাজ সঠিকভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। এমনকি কাজ শেষেও বিল ঠিকাদার না নেন ৪৮ ঘণ্টা পার হলেও ঠিকাদারের ঠিকানায় কাজের বিলের চেক বাসার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিচ্ছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। আনিসুল হক বলেন, আমরা ঢাকার রাস্তায় রাতের বেলায় বাতি জ্বালাতে ৬ মাস পরীক্ষা শেষে প্রায় ৪৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক মানের ইউরোপীয় দেশের মতো স্বাস্থ্যসম্মত এলইডি বাতি লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছি। কারণ আমরা চাই নাগরিকদের চলাচলের জন্য রাতের নিরাপদ রাস্তা। মেয়র বলেন, ঢাকা এগিয়ে যাচ্ছে আর মিডিয়ার পাশাপাশি নাগরিকগণ সহায়তা করলে ঢাকা এগিয়েই যাবে। আগামীর আধুনিক ঢাকা সাজাতে তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
×