ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সমৃদ্ধ লোকশিল্পের সার্থক প্রকাশ, মুগ্ধ শহুরেরাও

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৮ এপ্রিল ২০১৭

সমৃদ্ধ লোকশিল্পের সার্থক প্রকাশ, মুগ্ধ শহুরেরাও

মোরসালিন মিজান ॥ মাটির হাঁড়ি তো কতই হয়। আগে ছিল। এখনও আছে। প্রতিদিনের গ্রামীণ জীবনে মৃৎপাত্রের ব্যবহার খুব লক্ষণীয়। কিন্তু শখের হাঁড়ির কথা আলাদা। বাংলার প্রাচীনতম লোকশিল্পের অন্যতম অনুষঙ্গ এই হাঁড়ি। ব্যবহারের দিক থেকে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তবে হারিয়ে যায়নি এখনও। বরং মুগ্ধ চোখে দেখি, শহুরে শেকড়সন্ধানী মানুষের গৃহকোণে জায়গা করে নিয়েছে শখের হাঁড়ি। আর এখন যখন পহেলা বৈশাখের হাতছানি, সর্বত্রই যখন বাংলা নববর্ষ বরণের প্রস্তুতি চলছে, শখের হাঁড়ি রঙের ফোয়ারা হয়ে ধরা দিচ্ছে! সাধারণত প্রাকৃতিক এবং খুব উজ্জ্বল রঙে আঁকা হয় শখের হাঁড়ি। লাল-হলুদ-সাদাসহ বিভিন্ন রং ব্যবহার করেন শিল্পীরা। ফুল লতা পাতা পাখি জল মাছ ইত্যাদি আঁকেন। অনন্য সাধারণ কারুকাজ দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। মাটির পাত্রে গ্রামীণ জীবনাচার, উৎসব, সংস্কার, ধর্মসহ নানা কিছু ফুটিয়ে তোলা হয়। লোকচিত্রের বর্ণাঢ্য নমুনা বহন করে শখের হাঁড়ি। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ লোকশিল্পের সার্থক প্রকাশ ঘটে এই ধারার কাজে। আকর্ষণীয় দেখতে শখের হাঁড়ি বিশেষ ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হতো। বিয়েতে, এর আগে পরের আনুষ্ঠানিকতায় মিষ্টি না হলেই নয়। মিষ্টি পিঠা ইত্যাদি বহন করা হতো শখের হাঁড়িতে করে। মিষ্টি ছাড়াও, তিলা কদমা নাড়ু মুড়কি মোয়া ও অন্যান্য খাবার হাঁড়িতে পুরে উপহার হিসেবে কুটুম বাড়িতে পাঠানো হতো। গ্রামের বিয়ে বাড়িতে শখের হাঁড়ির ব্যবহার অতি পুরনো। জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে মেয়ে বিদায়ের সময় তার সঙ্গে শখের হাঁড়ি দেয়ার রেওয়াজ ছিল। প্রথম সন্তান প্রসবের পর স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার সময় মেয়েরা বাপের বাড়ি থেকে এই হাঁড়ি নিয়ে যেতেন। এই হাঁড়ি শখের চুকাই ও ঝাঁপি নামেও পরিচিত। এর সঙ্গে সিকরা হাঁড়ি ও বাটা নামে আরও দুটি হাঁড়ি দেয়া হতো। এখন শহুরে শৌখিন মানুষ ড্রইংরুম সাজায় কারুকাজম-িত হাঁড়ি দিয়ে। ১৪০৬ খ্রীস্টাব্দে চীনা পর্যটক মা-হুয়ানের ভ্রমণসাহিত্যে শখের হাঁড়ির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। লোক গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শখের হাঁড়ির দুটি ধারা রয়েছে। বিশেষ এক ধরনের কাজ হয় রাজশাহীর বাঁয়া, বসন্তপুর ও নবাবগঞ্জের বারোঘরিয়ায়। এসব হাঁড়ির হলদে জমিন। সে জমিনের ওপর লাল-নীল-সবুজ ও কালো রঙে আঁকা হয় হাতি, ঘোড়া, মাছ, শাপলা, পদ্ম দলদাম, রাজহাঁস, পাতিহাঁস, পেঁচা, কবুতর ইত্যাদি। ভিন্ন রীতি অনুসরণ করেন নওগাঁর বাঙ্গাল পাড়ার মৃৎশিল্পীরা। তাদের হাঁড়িগুলোর গায়ের রঙ লাল। তার ওপর সাদা কালো ও সরষে ফুলের রঙে আঁকা হয় মাছ, চিরুনি, পাখি, পদ্ম ফুলের মোটিফ। ৮ থেকে ৯টি পরিবার এসব হাঁড়ি তৈরির কাজ করেন। ঢাকার আশপাশের কিছু এলাকায়ও শখের হাঁড়ি তৈরির কাজ হয়। নয়ার হাট, ধামরাই, রায়ের বাজারে কুমোররা যতেœর সঙ্গে এ কাজ করে থাকেন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শখের হাঁড়ি তৈরির কাজ হয়। অঞ্চলভেদে শখের হাঁড়ি আকার ও স্টাইলে পার্থক্য লক্ষ্যণীয়। কোন কোন শখের হাঁড়িতে হাতল থাকে। কোনটি হাতলবিহীন। কোন অঞ্চলের হাঁড়িতে ঢাকনা থাকে। কোনটির আবার হা করা মুখ। তবে সবক’টি হাঁড়িই বাংলার কৃষ্টিকে তুলে ধরে। এখন রাজধানী শহরেও দেখা যায় শখের হাঁড়ি। লোক ঐতিহ্যের উৎসব অনুষ্ঠান ও মেলায় স্বনামধন্য শিল্পীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন আয়োজকরা। শিল্পীরা সবার সামনে বসে হাঁড়ির গায়ে ছবি আঁকেন। লোকজ উৎসব অনুষ্ঠান সামনে রেখে ব্যস্ত হয়ে পড়েন শহরের মৃৎশিল্পীরাও। নিজেদের মতো করে শখের হাঁড়ি গড়ার চেষ্টা করেন। বাংলা নববর্ষে বর্ষবরণের সময় এলে তো কথাই নেই। এখন তাই ফুটপাথের দোকানিরাও রং তুলি নিয়ে বসে গেছেন। শখের হাঁড়ির আদলে কিছু করার চেষ্টা করছেন তারা। তাতেই খুশি ক্রেতা। ঢের বিক্রি হচ্ছে। শহরের মানুষ ব্যবহারিক দিকটি নিয়ে বিশেষ ভাবেন না। সৌন্দর্যে মুগ্ধ। শখের হাঁড়ি বাসায় সাজিয়ে রাখেন তারা। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য নির্মাণ করা তোরণেও শিকেয় করে সুন্দর ঝুলিয়ে দেয়া হয় শখের হাঁড়ি। সুন্দরের প্রতি এই প্রেম শেকড়ের প্রতি এমন টান বলে দেয়Ñ শখের হাঁড়ি হারায়নি। হারাবে না।
×