ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমাইয়া ইসলাম নিপা

আধুনিক শিল্পচর্চার জনক

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

আধুনিক শিল্পচর্চার জনক

বাংলার শিল্প জগতের যে অসীম যাত্রা পথ তারই প্রথম দিকনির্দেশক পথিক হিসেবে যিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন, যার পদচারণায় এবং বিস্মিত তুলির ছন্দিত রেখায় বহু কণ্টক পুষ্প সমাহিত হয়েছে তিনি হলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। শিল্পের সৃজনশীলতায় অত্যাশ্চার্য বিরল প্রতিভা প্রতিষ্ঠার দরুন এবং দক্ষতার শীর্ষতা ও বিস্ময় প্রকাশে শিল্পাচার্য উপাধিটি যুক্ত হয়েছে তার অদ্যনাম হিসেবে। তিনি শিল্পের অঙ্কুর গেঁথেছেন এই ভুবন মৃত্তিকায়, সজীবতার শ্যামল শোভা দিয়ে মনকে সতেজ রেখেছেন। প্রতিনিয়ত প্রতিটি কাজে ফুটিয়ে তুলেছেন লোক ঐতিহ্য। গ্রাম প্রীতির রেশ রেখেছেন প্রতিটি রেখার একক শিল্প সুষমায়। মনকে আবেগের অতি সন্নিকটে দমকা হাওয়া সংবরণে বাস্তবানুগ রাগে সঞ্চারিতে আবদ্ধ করেছে আত্মার উৎপত্তিস্থলকে। ভালবেসে গিয়েছেন স্বদেশকে এবং তারই উপস্থাপন ঘটিয়েছেন কখনও অলীক আশ্চর্যম-িত রেখা আলিঙ্গনে, কখনও বা রঙের আস্ফালনে। প্রতিটি চিত্রপটেই স্বচ্ছতায় ভেসে উঠেছে গোড়া গ্রামের একক বৈশিষ্ট্যমাখা রূপ। আবেগময় মর্মস্পর্শী ঘটনার বর্ণনাতেও দেখা যায় অধিকতর আবেদন, যা দর্শকের মনের জানালাতে কড়া নেড়ে যায় বার বার। অসাধারণ শিল্পমানসিকতা ও কল্পনাশক্তির গভীরতম পর্যবেক্ষণযোগে বুদ্ধি বিবেচনার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে বিষয়বস্তুর সাবলীল উপস্থাপন ঘটিয়েছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাতে শিক্ষা ধারণ করেছেন ঠিকই তবে তাতে দেশীয় লোকজ ঘরানা সংযোজনে নান্দনিকতা দান করেই বাস্তবানুগ চিত্র এঁকেছেন। তার চিত্রে কাল্পনিক স্বপ্নীল বিষয়বস্তু ঠাঁই পায়নি কখনই। কৃষকের কঠোর পরিশ্রম, দুর্ভিক্ষে অনাহারী মৃতপ্রায় মানুষের দুর্দশার মতো কট্টর বাস্তবধর্মী বিষয়কে ঠাঁই দিয়েছেন তার তুলির অপার মহিমায়। সংক্ষিপ্ত কিছু রেখার আলিঙ্গনে অক্ষয় কীর্তি গড়ে সমৃদ্ধি দান করেছেন শিল্পকোষকে। দেশীয় সংস্কৃতির মধ্যেই সৌন্দর্যের সবটুকু নির্যাস খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই বোধহয় তারই সুবাস ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সকলের মধ্যে। কৃষকের ঘামের মূল্য দিতেই পাকা ধান যে দেউলিয়া শুদ্ধ সুগন্ধ বিলায় তাতে কৃষক কৃষাণীর মনের সঙ্গে দর্শকের মনও আউলিয়া হয় তার তুলির ছোঁয়ায় শ্যামবর্ণ সাঁওতাল বালার খোঁপায় যে রাতুল বর্ণ পুষ্প সমাহিত থাকে আর তার যে আভা মনকে জাগিয়ে এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় তার ঠিকানা শিল্পাচার্যের পক্ষেই খুঁজে বের করা সম্ভবপর হয়েছে। কঠোর কায়িক পরিশ্রমের অপর দৃষ্টান্ত মাঝির বৈঠা চালনা ও গুনটানাতে তার শিল্পের উপস্থাপন দ্বারাই ‘এই অনুধাবন অনুভব করা সম্ভব হয়েছে। ভগ্ন কিন্তু সবল গুটিকয়েক রেখাকে আশ্রয় করে অবচেতন মনের মাঝেই অবস্থান করে নিয়েছে শিল্পী জয়নুল আবেদিনের রেখাপ্রাণ ছন্দের সুবর্ণ সৃষ্টিগুলো। কৃষকের ধানবোনা ধানকাটা, নতুন ধান ঘরে তোলার, চাষীবধূর নতুন ধানের পায়েস রান্না, নববধূর নাইওর যাওয়া, আবার খাদ্যের অভাবে তাদেরই অজানার পথে যাত্রা এসব বিষয়ের ধারাবাহিকতায় সাত খ-ে পুস্তকসদৃশ সৃষ্ট তার স্ক্রল চিত্র নবান্ন। নবান্ন উৎসব একান্ত নিজস্ব ধারা সম্পাত ঐতিহ্য যার বিপন্ন হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় আচ্ছাদিত হয়েই রেখে গেছেন এই নজিরসদৃশ চিত্র। শত বছরের দুঃশাসনে এক সময়ের সুখীসমৃদ্ধ গ্রামবাংলার ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া আবার শহরমুখী অনিশ্চয়তার মধ্যে নিপতিত হওয়া সম্পূর্ণটাই তুলে এনেছেন তার রেখার জালে। মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা যুদ্ধের ভয়াবহতা এসবের উপস্থাপনের মধ্যে শিল্পীর সমাজ সচেতন মনোভাবের বহির্প্রকাশ বলে মনে হয়। সাপুড়ে বেদেনীর চিরচেনা রূপটি মাথায় ঝুড়ি হাতে বাঁশি তারই সরল কাব্যটি রচনা করেছেন। শিল্পী তার দক্ষ রেখার সূক্ষ্ম টানে প্রসাধনে নিযুক্ত মহিলার একক, যুগল কখনও বা ত্রয়ী বালা উপস্থাপন করেছেন। শ্যামবালা সৌন্দর্যের স্নানরত মাধুর্যে গুল্মলতার রস পূর্ণতায় সজীব করার অনুরূপ তারই জ্বলন্ত কারিগর জয়নুল আবেদিন। প্রাকৃতিক পরিবেশের রোমান্টিক রূপকার এই শিল্পীর সাঁওতাল সমাজের দৈনন্দিন জীবন প্রবাহের চিত্র বিশেষত কাজ শেষে সাঁওতাল দম্পতির একত্রে ঘরে ফেলার ঊর্মিতোলা অপার অলঙ্কার সত্যিই বিস্ময়কর। প্রচ- শক্তিশালী ও অত্যন্ত সংবেদনশীল শিল্পী জয়নুল আবেদিন সর্বদাই সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন তার শিল্পে। অন্তহীন সংগ্রাম, আশা- আকাক্সক্ষায় ভরপুর তার চিত্র যেখানে নৈরাশ্যের অবস্থান ছিল না কখনই। বহ্মপুত্র প্লাবন অববাহিকায় শান্ত সুনিবিড় রোমান্টিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার দরুন তার প্রথম দিকের কাজের প্রভাব পাওয়া যায়। পরবর্তীতে অর্থাৎ তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষে মানবতার চরম অবমাননা দেখে প্রচ-ভাবে মর্মাহত হন। কলকাতার দুর্ভিক্ষের সেই নারকীয় দৃশ্যাবলীই এঁকেছেন দুর্বল অসহায়ত্বের সবল রেখা কালি ও তুলি সংলেপনে। মানুষ ও কুকুর ডাস্টবিন থেকে উচ্ছিষ্ট খাদ্যান্বেষণে প্রতিযোগিতা চালায় তারই অবস্থান শিল্পীর এই শিল্পে। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার উপস্থাপনে দুর্লভ ও দুর্মূল্য শিল্পসাম ছেড়ে বেছে নেন কালো চীনা কালি এবং তুলি। আর পট হিসেবে নিয়েছিলেন বাজারের অতি সাধারণ সস্তা প্যাকেজিং কাগজ। এই কাগজগুলো ঈষৎপীত বর্ণের ছিল। সস্তা সাধারণ সুলভ উপাদান সংযোগে যা সৃষ্টি হলো দুর্ভিক্ষের আদলে তাই হলো অমূল্য সম্পদ পরিণতি পেল বিশেষ খ্যাতিতে। দুর্ভিক্ষের এই চিত্রগুলোতে যে আকুলতা। বিস্ময় আবহ ও আবেগের উপস্থাপন তা সত্যিই ভূয়সী প্রশংসার দাবিদার। কঙ্কালসার মা মরে পড়ে আছে, রাস্তায় অবুঝ শিশুর মায়ের দুধ খাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা, কুকুর, কাক ও মানুষের ডাস্টবিন থেকে খাবার খোঁজা, এমনকি পড়ে থাকা লাশের ওপর বিরাজমান কাকের চোখ, মুখ ও পাঁজরের মাংস ঠুকরে ভক্ষণের মর্মান্তিক দৃশ্য ফুটে উঠেছে, তাঁর ‘ম্যাডোনা ৪৩’ নামক চিত্রগুলোতে। সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঝড় যা আঘাত হেনে ছিল, এ দেশের উপকূলীয় এলাকায়। এই ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস তিন লক্ষাধিক প্রাণ কেড়ে নেয়। আর এমন ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রচ- মানসিক ধাক্কার সম্মুখীন হন শিল্পী জয়নুল। তাদের সহায়তা করার মতো পূর্ণ সামর্থ্য না থাকলেও অসহায় এই মানুষদের পাশে দাঁড়ান মানবতাবাদী এই শিল্পী। তাদের পাশে থেকেই সেই মর্মস্পর্শী দৃশ্যের স্ক্রল চিত্র নির্মাণ করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। আর নবান্ন অনুরূপ এই স্ক্রল চিত্রের নাম দেন ‘মনপুরা ৭০’। কালো কালি ও মোম সহযোগে এঁকেছেন স্তূপীকৃত লাশের দৃশ্য জলোচ্ছ্বাসে ভেসে বেড়াচ্ছে গৃহপালিত পশু, গাছ, মানুষের দেহ। মা ও শিশু, কলসি কাখে নারী, স্নানরতা রমণী, আয়নাসহ বধূ, কেশ বিন্যাসরত নারী, একাকী নারী বিশ্রামরত ভঙ্গি বিভিন্ন ধারা ভিন্ন কর্ম ব্যস্ত কোমল, পেলা, নমনীয় রমণীর উপস্থাপন ঘটিয়েছেন কখনও তেল রং কখনও জল রং বা বালি-তুলির রেখা ব্যবহারে। প্রকৃতি ও মানুষের সর্বাঙ্গীন। একাত্ম সৌন্দর্য দ্বারা প্রগতিশীল নান্দনিক চারুচত্বর নির্মাণের প্রজ্বলিত শিখা জয়নুল, যিনি মানব হৃদয়ে সহস্র কাল আলো ছড়াবেন।
×