ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাতি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও প্রতিহত করবে- একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি

ট্রাইব্যুনাল স্থানান্তর সমীচীন হবে না ॥ আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠি

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

ট্রাইব্যুনাল স্থানান্তর সমীচীন হবে না ॥ আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠি

আরাফাত মুন্না ॥ পুরাতন হাইকোর্ট ভবন থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অন্য কোথাও সরানো হলে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে বলে সুপ্রীমকোর্টকে জানিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। আইন মন্ত্রণালয় বলেছে, ট্রাইব্যুনাল স্থানান্তর করলে তা সর্বজনগ্রাহ্য হবে না বরং সুপ্রীমকোর্ট দেশবাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বৃহস্পতিবার আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব কাজী মুশফিক মাহবুব রবিন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এসব কথা বলা হয়। চিঠিটি সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর পাঠানো হয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠিতে ট্রাইব্যুনাল সরানোর বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনারও অনুরোধ জানানো হয়েছে। এর আগে গত ৪ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল সরাতে আইন মন্ত্রণালয়কে দ্বিতীয় দফা চিঠি পাঠায় সুপ্রীমকোর্ট। প্রথম দফায় গত ১৮ আগস্ট চিঠি দেয়া হয়েছিল। এদিকে, বর্তমান ভবন থেকে ট্রাইব্যুনাল অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের সিদ্ধান্তকে যুদ্ধাপরাধীদের দল ও তাদের সহযোগীদের ‘চক্রান্তের’ অংশ হিসেবে দেখছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। বৃহস্পতিবার সংগঠনটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, ‘পুরাতন হাইকোর্ট ভবনটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক স্থাপনা। ভবনটি ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলা ও অসম প্রদেশের গবর্নরের সরকারী বাসভবন হিসেবে নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে এ ভবনটিকে পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টে রূপান্তর করা হয়।’ চিঠিতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারকার্য পরিচালনার জন্য বর্তমান সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় অন্য কোথাও যৌক্তিক ও নিরাপদ স্থাপনা না পাওয়ায় সরকার পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে।’ আইন মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য শুরুর পর অনেক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারকাজ সুসম্পন্ন হয়। এ কারণে এই ভবনটির ঐতিহ্য ও গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।’ চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশের জনগণ চায় ঐতিহাসিক ভবনটির মর্যাদা সমুন্নত রেখে অত্র ভবনেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ অব্যাহত থাকুক। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ ভবন থেকে অন্যত্র সরানো হলে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে এবং সর্বজনগ্রাহ্য হবে না। বরং বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট দেশবাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’ ‘সকল বিষয় বিবেচনা করে পুরাতন হাইকোর্ট ভবন থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থানান্তর করে ভবনটি বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের অনুকূলে দখল হস্তান্তর করা সমীচীন হবে না’ বলেও সুপ্রীমকোর্টকে জানায় আইন মন্ত্রণালয়। এর আগে গত ৪ ডিসেম্বর ও ১৮ আগস্ট সুপ্রীমকোর্টের জায়গা সঙ্কুলানের কথা উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল সরাতে আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় সুপ্রীমকোর্ট। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিবৃতি ॥ বর্তমান ভবন থেকে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ (আইসিটি) সরানোর বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের উদ্যোগের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। বৃহস্পতিবার সংগঠনের সভাপতি বিচারপতি গোলাম রাব্বানী, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, সহ-সভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, চলচ্চিত্র নির্মাতা শামীম আখতার ও সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ নিন্দা জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা অত্যন্ত ক্ষোভ ও উদ্যোগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, ’৭১-এর গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল’ বর্তমান ভবন থেকে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রীমকোর্ট। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘিœত ও বানচাল করার জন্য দেশে-বিদেশে যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীরা যে বহুমাত্রিক চক্রান্ত করছে, আমরা মনে করি বর্তমান ভবন থেকে ট্রাইব্যুনাল উৎখাতের উদ্যোগ সেই চক্রান্তেরই অন্তর্গত। কারণ আমরা সবাই জানি ২০০৯ সালে রাজধানীর সম্ভাব্য সকল ভবন যাচাই করে আমাদের অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান ভবনে ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রধানমন্ত্রী এই বিজয়ের মাসে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আবারও ঘোষণা করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান থাকবে, কোন ষড়যন্ত্র এই বিচার বন্ধ করতে পারবে না। বর্তমান ভবন থেকে ট্রাইব্যুনাল উৎখাত করার অর্থ হচ্ছে চিরদিনের মতো এই বিচার বন্ধ হয়ে যাওয়া।” বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “গত ১৮ আগস্ট সুপ্রীমকোর্ট যখন প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নেয়ার নোটিস দিয়েছিল তখন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত আটটি মুক্তিযোদ্ধা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও শহীদ পরিবারের সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করে প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে জানায়, আমরা আশা করেছিলাম আপনি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার আরও গতিশীল হবে, কারণ এটি নিছক ’৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়, ৩০ লাখ শহীদের প্রতি গোটা জাতির দায়বদ্ধতাও বটে। আপনি এই বিচারকার্যকে কতটা গুরুত্বহীন মনে করেন তার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে ৩১ অক্টোবরের ভেতর পুরনো হাইকোর্ট ভবন থেকে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল’ সরিয়ে নেয়ার নোটিস।” প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘সুপ্রীমকোর্টের স্থান সঙ্কুলানের জন্য আরও বহু জায়গা আছে, যেখানে ভবন সম্প্রসারিত হতে পারে। ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা যত বাড়ছে ’৭১-এর গণহত্যার ভয়াবহতা নতুন নতুন মাত্রায় দেশবাসীসহ বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। যখন ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা ও সচলতা আরও বৃদ্ধি প্রয়োজন তখন আপনার নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ’৭১-এর গণহত্যাকারীরা যেমন উল্লসিত হবে, একই ভাবে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবার ও ভুক্তভোগীদের চার দশকেরও অধিক সময়ের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আরও বৃদ্ধি করবে।’ বর্তমান আইসিটি ভবনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন জড়িয়ে গেছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যুরেমবার্গের যে ভবনে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের প্রথম বিচার হয়েছিল সেই ‘প্যালেস অব জাস্টিস’ পরে জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে, উত্তর প্রজন্মকে যা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে নাৎসিদের নৃশংসতার কথা। গণহত্যার বিচারের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ভবিষ্যতের গণহত্যা নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি গণহত্যাকে জাদুঘরের বিষয়ে পরিণত করা। এই উদ্দেশ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে ২০০৯ সালে লেখা চিঠিতে আমরা বলেছিলাম, এই ভবনকে ভবিষ্যতে আমরা ’৭১-এর গণহত্যা এবং বিচারের জাদুঘর ও আর্কাইভ হিসেবে দেখতে চাই। আপনার প্রতি (প্রধান বিচারপতি) আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার এবং এই বিচারিক ভবন কেন্দ্র করে ৩০ লাখ শহীদ পরিবার এবং বিচারবঞ্চিত জাতির আশা, অনুভূতি ও স্বপ্ন পদদলিত করবেন না।” অনুরোধ অগ্রাহ্য করে প্রধান বিচারপতি যদি বর্তমান ভবন থেকে ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন সেক্ষেত্রে এই ট্রাইবুনাল উৎখাতের যে কোন উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের পরিবারের সদস্যবৃন্দসহ বিচারপ্রত্যাশী গোটা জাতি বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তা প্রতিহত করবে বলেও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
×