ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মামুন রশীদ

আলোচিত ক্রিকেটে আলোকিত মিরাজ

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬

আলোচিত ক্রিকেটে আলোকিত মিরাজ

আগের বছর বিশ্ব ক্রিকেটকে বিস্মিত করে টানা সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। নিজেদের ইতিহাসে সেরা বছর কাটিয়েছে। তিন ক্রিকেট পরাশক্তি পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে ওয়ানডে সিরিজে হারিয়ে দেয় টাইগাররা। উঠে যায় আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ের সেরা অবস্থান সাত নম্বরে। তবে চলতি বছর ওয়ানডের সেই সাফল্যটা দেখানোর সুযোগ ছিল না। কারণ, দীর্ঘদিন কোন সিরিজই ছিল না। তবে চলতি বছর সেপ্টেম্বরের শেষে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজ জিতে পুরনো ছন্দে থাকার ইঙ্গিত দেয় টাইগাররা। টানা ৬ সিরিজ জয় করে। পরে অবশ্য ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হেরে টানা জয়ের লাগামে টান পড়ে। বছরটা মূলত ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের টি-২০ ফরমেটেও নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ। বছরের শুরুতে টি-২০ এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলে টাইগাররা। আবার টি-২০ বিশ্বকাপের দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখায়। এসব সাফল্যই এসেছে মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে। আর বছরের শেষভাগে শক্তিশালী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট জিতে বিশ্ব ক্রিকেটকে আরেকটি বড় ধাক্কা দেয় বাংলাদেশ দল। এ সাফল্যটা মুশফিকুর রহীমের নেতৃত্বে পায় বাংলাদেশ। সবমিলিয়ে চলতি বছরে বাংলাদেশ দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তেমন ব্যস্ত না থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে বেশকিছু ক্রিকেটার ছিলেন আলোচনায়। এর মধ্যে টি-২০ বিশ্বকাপে বোলিং এ্যাকশনের ত্রুটি থাকায় পেসার তাসকিন আহমেদ ও বাঁহাতি স্পিনার আরাফাত সানীর নিষিদ্ধ হওয়া এবং ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট বিজয়ের রূপকার বিস্ময় বালক অফস্পিন অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজের রেকর্ডময় কীর্তিগাঁথা ছিল উল্লেখযোগ্য। বছরের শেষে জনপ্রিয় ঘরোয়া আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের (বিপিএল টি-২০) জমজমাট লড়াই ছিল আলোচিত। দেশের ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আলোচিত ঘটনাসমূহ নিয়েই এ আয়োজন- টি-২০ এশিয়া কাপের ফাইনাল ওয়ানডে ক্রিকেটে ক্রমাগত সাফল্য আসলেও ক্ষুদ্র ফরমেটের ক্রিকেট টি-২০-তে বাংলাদেশ দলের সাফল্য নিয়ে ছিল শঙ্কা। নিয়মিত টি-২০ না খেলার কারণটাও ছিল উন্নতির ক্ষেত্রে অনেক বড় একটি বাঁধা। তবে ২০১৫ সালের শেষদিকে বিপিএল এবং বছরের শুরুতে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ৪ ম্যাচের টি-২০ সিরিজে নিজেদের ঝালাই করে নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ক্রিকেটাররা। সেটাই যেন কাজে লেগেছে টি-২০ এশিয়া কাপে। গ্রুপপর্বে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো শক্তিশালী দুটি দলকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ দল। প্রথমবারের মতো কোন আন্তর্জাতিক টি-২০ আসরে সেটিই ছিল বাংলাদেশের সেরা সাফল্য। তবে গ্রুপপর্বের মতোই ফাইনালেও ভারতের কাছে হেরে শেষ পর্যন্ত রানার্সআপ হয় টাইগাররা। কিন্তু এ সাফল্য দেখে বিশ্ব ক্রিকেটের বিশ্লেষকরা ঘোষণাই দিয়েছিলেন টি-২০ বিশ্বকাপে চমক দেখাবে বাংলাদেশ দল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত কিছু অর্জন ছাড়া তেমন কোন সাফল্য আসেনি নানাবিধ ঘটনায়। বিশ্বের বিভিন্ন টি-২০ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশী ক্রিকেটার টানা আন্তর্জাতিক সাফল্য পাওয়া বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক বাজার চড়া হয়ে গেছে এ বছরই। এর আগে নিয়মিত বিশ্বের বিভিন্ন নামী-দামী ক্রিকেট আসরে অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান খেলেছেন। কিন্তু এ বছর আরব আমিরাতে প্রথমবারের মতো আয়োজিক পাকিস্তান সুপার লীগ (পিএসএল) টি-২০ আসরে বাংলাদেশের চার ক্রিকেটারকে উচ্চমূল্যে নেয় ফ্র্যাঞ্চাইজিরা। খেলেন সাকিব, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহীম। তবে পেস বিস্ময় মুস্তাফিজ অবশ্য ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি। এ আসরে দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়ে নজর কাড়েন তামিম। এরপর ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগেও (আইপিএল) মুস্তাফিজ সানরাইজার্স হায়দরাবাদে খেলেন। যথারীতি সাকিব ছিলেন কলকাতা নাইট রাইডার্সে। প্রথম খেলেই বাজিমাত করেন মুস্তাফিজ। সবগুলো ম্যাচ খেলে তিনি হায়দরাবাদকে চ্যাম্পিয়ন করার পেছনে অন্যতম ভূমিকা রাখেন। পরে মুস্তাফিজ ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্লাব সাসেক্স শার্কসের হয়েও টি-২০ আসরে খেলেন একটি ম্যাচ। ইনজুরির কারণে আর খেলা হয়নি তার। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ডকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে গেল বছর বাংলাদেশের ক্রিকেটে যুক্ত হয়েছে আরেকটি স্বর্ণালি সাফল্য। অক্টোবরে মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে ইংলিশদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্টে জয় তুলে নিয়ে ইতিহাস গড়ে লাল-সবুজের দেশ। প্রথমবারের মতো সাদা পোশাকে ক্রিকেটের জনকদের পরাজিত করে টাইগাররা। নবাগত মেহেদি হাসান মিরাজ ও বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের ঘূর্ণিজাদুতে ১০৮ রানে জয় পায় টিম বাংলাদেশ। এটিই ছিল বছরের একমাত্র টেস্ট সিরিজ। তাই অনেক জল্পনা-কল্পনা ছিল টেস্টে ভাল করা নিয়ে। তাছাড়া দলেও ছিল ব্যাপক পরিবর্তন। সেই দলটিই ইংলিশদের হারিয়ে দিয়ে সিরিজ ১-১ সমতায় শেষ করে টেস্ট ক্রিকেটেও নিজেদের শক্তিশালী হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দেয় বাংলাদেশ দল। অনন্য উচ্চতায় মেহেদি মিরাজ ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সিরিজেই ইতিহাসের সাক্ষী হন ডানহাতি অফস্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের ম্যাচে মিরাজ দুই ইনিংসে ৬টি করে ১২ উইকেট কব্জা করেন। এটি কোন বাংলাদেশী বোলারের এক টেস্টের সেরা বোলিং নৈপুণ্য। সবমিলিয়ে সিরিজে ১৯ উইকেট। এর আগে দুই ম্যাচের সিরিজে আর কোন বাংলাদেশী বোলার এমন নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি। ১২৯ বছর আগে অভিষেকের দুই টেস্ট সিরিজে ১৮ উইকেট নিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার পেসার জেমস ফেরিস। সেদিক থেকেও নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়েন মিরাজ। আর অফস্পিনার হিসেবে বিশ্বরেকর্ড গড়েন ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টের তিন ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করে। এ সিরিজের সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কারও লাভ করেন তিনি। আইসিসির সেরা মুস্তাফিজ ওয়ানডেতে ২০১৫ সাল যেমন বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য সোনালি বছর, তেমনি ‘বিস্ময়-বালক’ মুস্তাফিজুর রহমানের জন্যও স্বপ্নের বছর। ওই বছর অভিষেক হওয়ার পরই ক্রিকেটবিশ্বে হৈচৈ ফেলেন দেন চোখ ধাঁধানো বোলিং পারফরমেন্স প্রদর্শন করে। ২০১৫ সালে যারা বল হাতে জ্বলে উঠেন তাদের মধ্যে মুস্তাফিজই ছিলেন সবচেয়ে বিধ্বংসী। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকেই একের পর এক কীর্তি গড়েন এ পেসার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫-১৬ মৌসুমে আইসিসির বর্ষসেরা উদীয়মান ক্রিকেটার হয়ে রেকর্ড গড়েন ‘কাটার মাস্টার’। বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে আইসিসির বর্ষসেরা কোন বিভাগে পুরস্কার জয়ের দৃষ্টান্ত এটি। তাসকিনের মুক্তি গেল বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বোলিং এ্যাকশনের শুদ্ধতার সনদ পান বাংলাদেশী পেসার তাসকিন আহমেদ ও স্পিনার আরাফাত সানি। এর ফলে বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে ফিরে আসে স্বস্তির সুবাতাস। ৯ মার্চ ধর্মশালায় টি-২০ বিশ্বকাপে হল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাসকিন ও সানির বোলিং এ্যাকশন। পরে চেন্নাইয়ে এ্যাকশনের পরীক্ষা দেন দু’জন। ১৯ মার্চ অবৈধ এ্যাকশনের দায়ে দু’জনকেই বোলিংয়ে নিষিদ্ধ করে আইসিসি। ২১ মার্চ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আপিল করে বিসিবি। পরে ব্রিসবেনের আইসিসি স্বীকৃত পরীক্ষাগারে বোলিং এ্যাকশনের পরীক্ষা দিয়ে মুক্তি পান এ দুই বোলার। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজে তাসকিন আবার ফেরেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। কিন্তু সানি ফিরতে পারেননি। তাকে পর্যবেক্ষণের জন্য আপাতত ঘরোয়া ক্রিকেটেই খেলার সুযোগ দিয়েছে বিসিবি। তামিমের রেকর্ড বাংলাদেশের একমাত্র ও প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে গত বছর তিন ফরমেটেই (টি-২০, ওয়ানডে, টেস্ট) সেঞ্চুরির কীর্তিগাথা রচনা করেন ড্যাশিং ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল। এবার টি-২০ বিশ্বকাপে ওমানের বিরুদ্ধে অপরাজিত ১০৩ রানের ইনিংস খেলে এ কীর্তি গড়েন তিনি। শুধু তাই নয়, তিন ফরমেটেই দেশের হয়ে সর্বাধিক সেঞ্চুরি ও সর্বাধিক রানের মালিক বন্দরনগরীর বাঁহাতি ওপেনার। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে তিন ফরমেট মিলিয়ে ৯ হাজার রানের মাইলফলক ছুঁয়েছেন তিনি। আর প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে ৫ হাজার রানও করে দেশের পক্ষে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এ বাঁহাতি ওপেনার। আশরাফুলের ফেরা ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ৫ বছরের জন্য সবধরনের ক্রিকেট থেকে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছিলেন বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার রাস্তা খুলে গেছে এ বছর আগস্টে। তিনি জাতীয় ক্রিকেট লীগ (এনসিএল) দিয়ে আবার ক্রিকেটে ফিরেছেন। খেলছেন ঢাকা মেট্রোপলিসের হয়ে। তবে ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক আসরে খেলতে পারবেন না আপাতত। কারণ আরও দুই বছর লাগবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার নিষেধাজ্ঞা উঠতে। সে কারণে এবার বিপিএল খেলেননি তিনি। বিপিএল সেরা ঢাকা ডায়নামাইটস গত বছরের শেষ মাসে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) ক্রিকেটের চতুর্থ আসরের শিরোপা ঘরে তোলে ঢাকা ডায়নামাইটস। ফাইনাল ম্যাচে সাকিব আল হাসানের দল ৫৬ রানে পরাজিত করে রাজশাহী কিংসকে। ফলে এক মৌসুম পর আবারও বিপিএলের শিরোপা পুনরুদ্ধার করে রাজধানীর দল।
×